Robbar

ভায়োলেন্সও একটা সময় পর একঘেয়ে লাগে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 12, 2023 6:12 pm
  • Updated:December 12, 2023 6:12 pm  

অনুরাগের পর অনেকেই এখন অনুরাগ-ঘরানার ছবি বানাতে সিদ্ধহস্ত, তাছাড়া অনুরাগ নিজেই এই ধরনের ছবিতে এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, সেখানে নিজেকে হারাতে গেলে আরেকবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে, আবার নিজেকে ডিকন্সট্রাক্ট করতে হবে। ভায়োলেন্স এই মুহূর্তে সবচেয়ে পপুলার পণ্য, ভায়োলেন্সের বাজার আকাশছোঁয়া। কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ভায়োলেন্সকে অবজেক্টিফাই করতে করতে আমরা তাকে জাস্টিফাই করছি না তো! অনুরাগ কশ্যপের ‘কেনেডি’ সিনেমার পর্যালোচনা।

সোহিনী দাশগুপ্ত

বম্বের হিন্দি ছবি, যার বাজারি নাম ‘বলিউড’, সেই ছবির বহমানতার ধারার নিরিখে দেখলে আমরা নিজেদের বলতে পারি ‘অনুরাগ কাশ্যপ জেনারেশন’। আমরা যখন কলেজের শেষ বছরে, তখন শোনা যেতে থাকে এই ছেলেটির নাম সুধীর মিশ্রর চেলা। সোশাল মিডিয়ার যুগ সেটা নয়, মোবাইল ফোনও হাতে গোনা কিছু লোকের কাছে। ফিরে তাকালে মনে করতে পারি না, ঠিক কীভাবে খবরগুলো অনায়াসে ছড়িয়ে পড়ত সে সময়। কাগজে, ম্যাগাজিনে কিছু লেখালিখি আর বাকিটা মুখে মুখে। শোনা গেল, অনুরাগ কাশ্যপ একটা ছবি বানিয়েছেন, নাম ‘পাঁচ’, ছবিটা সেন্সর পায়নি, কিন্তু সে ছবি নাকি একটা বোমা। সিনেমাপাগল আমরা কোথায় দেখা যায় সে ছবি, ভাবতে ভাবতে গড়িয়াহাট, ফ্যান্সি মার্কেট, ধর্মতলা, শেয়ালদার ফুটপাতের চাকতিওয়ালাদের (পাইরেটেড ফিল্ম সিডি বিক্রেতা) কাছে ছেয়ে গেল ‘পাঁচ’-এর সিডি। হুড়মুড় করে আমরা কিনলাম সেই চাকতি এবং শুধু কিনলাম না, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল ‘পাঁচ’-এর সিডি, সিডি থেকে সিডি কপি হতে থাকল রাতারাতি। ‘পাঁচ’ সুপারহিট নয়, ব্লকবাস্টার হয়ে গেল, আর আমরা পেলাম আমাদের সময়ের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টার ডিরেক্টরকে– রাডিকাল, পলিটিকাল, বন্দুকের নলের মতো। কিছুদিন ধরেই বলিউডের ছকটা পাল্টাচ্ছিল। মেইনস্ট্রিমে থেকেই একটা অন্য ন্যারেটিভ তৈরি করছিলেন কয়েকজন পরিচালক। বাস্তব নির্ভর, রাজনৈতিক বিষয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা, ভয়, স্বপ্ন নিয়ে তাঁদের গল্প। স্টুডিও সেট আপ থেকে বেরিয়ে, বিচিত্র, রহস্যময় বোম্বে শহরের একটা চেহারা তুলে ধরছিলেন তাঁরা ছবিতে। গল্প বলার ভাষাও পাল্টাচ্ছিল আমূল। যেন ইতালিয়ান নিও রিয়ালিজমের আরেকটি অধ্যায়, খুবই দেশজ তার হৃদয়। রাম গোপাল ভার্মা এই নতুন বোম্বাই ছবির হোতা। অনুরাগ এই ধারারই একটি মাইলস্টোন। সুধীরের ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’ পাগল করে দিয়েছে আমাদের প্রজন্মকে, আর তার পরেই ‘পাঁচ’। বলিউডের মরা সিনেমার ওপর অনুরাগের খাঁড়ার ঘা। সিনেমার সিনট্যাক্সটাই আলাদা। মহানগরীর গলিতে গলিতে যে জীবন, তার উল্টোদিকে স্কাই সক্রেপরের যে জীবন– কয়েনের দুটো পিঠ যেন, আর অদ্ভুৎ সব চরিত্র, তাদের বেঁচে থাকা, লুটেপুটে নেওয়া, মেরে ফেলা, মেরে ফেলে উল্লাট নাচতে থাকা, প্রেমে পড়া, চুমু খাওয়া– খুব চেনা, অথচ একদম নতুনভাবে অনুরাগ নিয়ে এলেন তার ছবিতে। পরপর আসে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘গুলাল’, ‘নো স্মোকিং’– কোনও ছবিই সেন্সরশিপ পায় না, হলে রিলিজ করে না অথচ বাম্পার হিট, চাকতি হাত থেকে হাতে ঘোরে চুপিচুপি।
এহেন অনুরাগ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে সিনেমার মেসিহা হয়ে উঠল, তার ফ্যানবেস অকল্পনীয়। কিন্তু, তবুও তাঁর সাম্প্রতিক ছবি আমাকে খুব হতাশ করেছে। ‘কেনেডি’ কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ঘুরে আসা (অনুরাগের প্রচুর ছবিই কান-এ প্রদর্শিত হয়েছে), তুমুল ক্রেজ এই ছবি ঘিরে। আশা তৈরি হয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু ছবিটির গল্প বা প্লটে কোনও নতুনত্ব নেই, অত্যন্ত গড়পড়তা। সেই ট্রিগার-হ্যাপি মারকুটে পুলিশ, সিস্টেমের আপাত ভিক্টিম, একটি অতি জোলো রহস্যজাল, আর কিছু আদ্যিকের বিরক্তিকর trope– যেমন ব্যক্তিগত রিভেঞ্জের চেনা ছক, হিরোর ছেলে গাড়িবোমায় উড়ে গিয়েছিল, তাই সে পৃথিবীর সবাইকে কুপিয়ে, ছুড়ে ফেলে, গুলি করে খুন করে চলেছে আর সেটাকে জাস্টিফাইও করছে, সারা পৃথিবীর ওপর তার খুনে রাগ। ‘বিবেক’রূপী এক ব্যক্তি কিছু পাঞ্চ লাইন ডায়ালগ দিয়ে এই কেনেডিকে মজার মজার জ্ঞান দিচ্ছে। কেনেডি ব্ল্যাঙ্ক মুখে তার সঙ্গে কথা বলছে। মৃত ব্যক্তিরা মাঝে মাঝেই কেনেডিকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে। কেনেডি একইরকম ব্ল্যাঙ্ক মুখে তাদের দেখছে। প্ৰত্যেকটি ট্রিটমেন্টই অতি ব্যবহৃত। সেগুলির উপস্থাপনাতেও নতুনত্ব কিছু নেই, উপরন্তু ভায়োলেন্সের এমনই বাড়াবাড়ি যে একটা সময়ের পর ভায়োলেন্সও একঘেয়ে লাগে, বোর করে আর শেষে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ যেন অনুরাগের নিজের জালে নিজেরই জড়িয়ে পড়া। সেই ‘পাঁচ’, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ এবং আরও অন্য কিছু ছবির মামুলি সাব ভার্সন ‘কেনেডি’। চেনা চরিত্র, চেনা গল্প, চেনা খুন, চেনা কান ফাটানো গুলির আওয়াজ, এমনকী, চেনা চেনা গান। হয়তো আরও উচ্চকিত, আরও প্রবল। নিজের জালে নিজেই লাট খাচ্ছেন পরিচালক। অনুরাগের এ ছবি খুব মন খারাপ করে দেয়। ছবির অপেরাধর্মী মিউজিক আর ছবির শট টেকিং বা শট ডিজাইন-এর কোনও মিলমিশ নেই। যে যার মতো নিজস্ব ছন্দে চলছে। ভয়ানক ওভার পাওয়ারিং এই মিউজিক অনেক সময়ই ছবি থেকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, অথচ আইডিয়াটি ছিল চমৎকার। হতেই পারত একেবারে নতুন কিছু। অনুরাগের ছবির অদ্ভুত, উন্মাদ, কিছুটা সাইকো চরিত্ররা অবশ্যই ‘কেনেডি’তেও রয়েছে। তারা, বিশেষত ওর মহিলা চরিত্ররা বরাবরই দারুণ এন্টারটেনিং।
অনুরাগের পর অনেকেই এখন অনুরাগ-ঘরানার ছবি বানাতে সিদ্ধহস্ত, তাছাড়া অনুরাগ নিজেই এই ধরনের ছবিতে এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, সেখানে নিজেকে হারাতে গেলে আরেকবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে, আবার নিজেকে ডিকন্সট্রাক্ট করতে হবে। ভায়োলেন্স এই মুহূর্তে সবচেয়ে পপুলার পণ্য, ভায়োলেন্সের বাজার আকাশছোঁয়া। কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ভায়োলেন্সকে অবজেক্টিফাই করতে করতে আমরা তাকে জাস্টিফাই করছি না তো, তাকে আচিভমেন্ট বানিয়ে দিচ্ছি না তো– হিরোগিরির প্রতীক করে দিচ্ছি না তো!

প্রোডাকশন হিসেবে ‘কেনেডি’ আন্তর্জাতিক মানের। আর শেষ করব এইটে বলে যে, এই কেওস, বীভৎসতা আর উন্মাদনা, এই লাউডনেস, যা অনুরাগ তাঁর ছবিতে এমন অনায়াসে তুলে ধরেন; his intriguing and pestering relationship with man slaughter and blood, gore, violence– সেটা একেবারেই স্বতন্ত্র। খারাপ হোক, ভাল হোক অনুরাগের ছবি শুধু অনুরাগেরই ছবি, যা একমাত্র অনুরাগের পক্ষেই করা সম্ভব। এই কেওস আর উন্মাদনা তাঁর নিজস্ব এবং নিঃসন্দেহে তাঁর বিশ্বাস।

কেনেডি
পরিচালক: অনুরাগ কাশ্যপ