পেশাদারিত্বের এই লাঞ্ছনা আর কতদিন নিত বুকঝিম? কতদিন আবেগের খুড়োর কল দেখিয়ে, স্কিলের সম্মোহনে বেবাক ঠকাতাম তোমাদের? কতদিন অমুকের প্রযোজনা আর তমুকের বিজ্ঞাপনের দুষ্ট হস্তে বিবস্ত্র করতাম আমার এককালের ভালবাসাকে? আর পারছিলাম না। আর হচ্ছিল না। এ বড় ব্যথার গান। একে বেচতে আর ভালো লাগছিল না। কিন্তু ক্ষান্ত দেবার ক্ষমতা আমার নাই। সেই বছর পঁচিশের শ্রমণ, বৃষ্টি চোখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন, তার ঘুমভাঙার প্রয়োজন হল এবার।
সেই সমস্ত ভালোবাসার আট বছর হল। তারা একত্রে হাঁফ ছাড়ল। হাঁফ ছাড়ল বছর পঁচিশের শ্রমণ। গত আট বছরে সে শ্বাস নেয় নাই। আমি তারে শ্বাস নেওয়ার অনুমতি দিই নাই। আজ বছর শেষের এই লেখা যখন তুমি পড়ছ… আমি আর বছর পঁচিশের শ্রমণ একত্রে শ্বাস নিচ্ছি। বুক পেট ভরে। আমাদের বহু বছর পরে দেখা হল।
সেদিন ভোরবেলা থেকে কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিগুণার সামনে। সন্ধ্যার মধ্যে তাকে নদী হতে হবে। নদী হওয়ার কিমিয়া তার কাছে নাই। সন্ধেবেলা আলো জ্বলল। অ্যাম্বার। লাল। হলদে ওয়াশ। ঘুমের আরাম দেওয়া নীল। কিন্তু তার নদী হওয়া হল না।
‘ধরে ধরে বলবি। সবাই যাতে বুঝতে পারে। হড়বড় করবি না। তুই হয়েছিলি যেদিন, সেদিন ভীষণ বৃষ্টি ছিল। তুই বাদুলে। বৃষ্টি থামাতে পারবি না। ধরে ধরে এগোবি, বৃষ্টির সঙ্গে… বৃষ্টি হয়ে যাবি।’
৫০০ বছরের পুরাতন বৃষ্টি। আড়াই ঘণ্টার কিস্তিতে ঝরতে থাকতে হবে শ্রমণকে। সদ্য ২৬ হল। কাউন্টারে সেল বাড়ল। বাড়তে থাকল। আলো বাড়ল ওর গায়ে। আলোর পোকারা ছেঁকে ধরল। মাথা ঘুরতে শুরু করল। বারমহল ভরতে ভরতে সে জানল না কখন ভিতরঘর খালি হয়ে গেছে। বুকঝিম এক ভালোবাসা মঞ্চসফল হল। কল শো বাড়ল। কবিসাহেব কুড়িগ্রামে মাটির ভিতরে শয্যা নিলেন। আমি শ্রমণকে আদেশ দিলাম যে, আর শ্বাস নেওয়া যাবে না। শুধু শো হবে। শো।
ভালোবাসার দোকান দিলাম। ২০১৭ অবধি ১০০, আর ৬০-এর দরে ভালোবাসা, ১৮ থেকে ২০০, ১০০। কোম্পানির বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ৩০০-র টিকিট থাকল না। সস্তায় বুকভরা ভালোবাসা। সস্তার নাটক। সস্তার সোলো অ্যাক্ট। দামের বাজারে একেবারেই অন্ত্যজ শ্রেণি। আস্তে আস্তে প্রেমাখ্যানের মধুভাষায়, দাম না পাওয়ার বিরক্তির কালি লেপে গেল। শিল্প হল চটকে চব্বিশ। আমার তিরিশ পেরোল। শ্বাসরুদ্ধ শ্রমণ নীলচে হয়ে ঘুমিয়ে গেছে ততদিনে। সেসব আমার চোখেও পড়ল না।
দেশে লাগল মড়ক। ধার দিয়ে সব বন্ধ হয়ে গেল। এই প্রথম শ্রমণকে হিংসে হল আমার। নীলচে মড়ার রোগের ভয় নাই। নাই বেকারত্বের ভয়। খুললে ভালো হয়, এমন দরজার প্রতীক্ষা নাই। অবিরাম নিদ্রাভিভূত শ্রমণ জানলোই না বন্ধ বিশ্বের দুর্বিপাক।
২০২১-এ একরকম গা-জোয়ারি করেই হল খোলালাম। বুকঝিম দিয়ে শহরে থিয়েটার শুরু হল। শো-এর মাঝে পুলিশ এল টহল দিতে। দু’জন দর্শকের মাঝে একটি করে সিট ফাঁকা কি না তদারক করতে। প্রেমাখ্যানের উচ্চারণ তাদের কানে পৌঁছল না। পৌঁছলে পুলিশের চাকরি রাখতে পারত না। নাট্যচঞ্চুদের বড্ড গায়ে লাগল। একটি এতিম নাট্যের এত তেজ? যাকে পারে ফোন করে নালিশ করে দিলে তারা। বললে, ‘বুকঝিম? এরা আবার কারা?’
কল শো আসা বন্ধ হল।
ততদিনে বুকঝিম তৈয়ার করে ফেলেছে রক্তবীজের দর্শকবাহিনী! তারা বাড়ে, বাড়তে থাকে। হিংস্রভাবে ভালবাসে তারা এই নাটককে। শো চলতে থাকে। আমার চাওয়াও বাড়তে থাকে আরও। লোভাতুর দাঁত-নখে তখন শুধু বক্স অফিসের রক্তদাগ। আরও, আরও, আরও। কেমন করে জানি, যত্নে বোনা প্রেমের পালা নোট ছাপানোর কল হয়ে গেল।
‘দেখলেন? মাত্র ষোলো দিনে হাউসফুল।’ কেমন নির্লজ্জ, খ্যাতিকামী, স্কিল দেখানো লুম্পেন হয়ে গেলাম! হাউস ঠাসানোর চক্করে আলতো রোদের ছায়াতলে লালিত ভালোবাসার গল্পের অপমৃত্যু ঘটল। শো পেটানোই হয়ে উঠল দস্তুর। সব গোলমাল হয়ে গেল!
শ্রমণের ঘুম ভাঙল ’২৪ সনে। সপাটে একটি থাপ্পড় মেরে সে আমায় বলল শ্বাস নেবে। এই গ্রোটেস্ক বেনিয়াবৃত্তি আর চলবে না। বুকঝিম বন্ধ হতে হবে।
বছর শেষের এই লেখা কি তুমি এখনও পড়ছ? যদি তাই, তবে শোনো। যা কিছু সুন্দর, নিষ্পাপ, অমলিন, সেই সব উপকরণ ঢেলেই তৈরি হয়েছিল সৈয়দ শামসুল হকের ‘বুকঝিম এক ভালোবাসা’।
২০১৬-র এক বসন্তরাতে একঝাঁক বন্ধু সমাবেশে একত্রে পড়েছিলাম এই উপন্যাস। সদ্য যৌবনের তাপে, বসন্তের ব্যভিচারী হাওয়ায়, সেই মুহূর্তে আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ভালোবাসার এক কোমল, স্নিগ্ধ কায়াস্বরূপ। অনুধাবন করেছিলাম ভালোবাসার সাপেক্ষে, ভালবাসে যারা, তারা নিতান্তই ক্ষুদ্র, অপ্রাসঙ্গিক। সেই বিহ্বলতা বুকে চেপে আমাদের বুকঝিমের যাত্রা শুরু। মহড়ার ঘরগুলি ছিল যেন গল্পযাপনের বিবিধ নিসর্গ। চক্রপাণি ঢোলে কাঠি ঠেকালে ঘরের মাঝে গজিয়ে উঠত রোববারের হাট, ধামসায় চাপড় দিলে রচিত হত কারবালার যুদ্ধপ্রান্তর। সুশ্রুতর বাঁশির সুরে উড়াল দিত ধবল বক। নদীর বুকে তিরতিরিয়ে এগিয়ে চলত ছোট্ট একক ডিঙা। সেই নদীতে রাত নামত সুহানিশির গানে, পূর্ণশশী ঝলমিলিয়ে উঠত ফিরোজের উদ্যানে। নদীর পাড়ে শান্ত বসতে শিখিয়েছিল সর্বজিৎ। শব্দের যত্ন করার তালিম নিতাম তার কাছে। সে সব অলীক মুহূর্ত, মনুষ্যজন্মে পাওয়ার কথা না।
আমরা পেয়েছিলাম। রাখতে পারিনি বেশিদিন।
রোজকারের পালা, রোজগারের পালা, আস্তে আস্তে হয়ে উঠল রোজগারের বাধা। ডেট দিতে নাজেহাল হয়ে পড়ি। ডেট পেতে নাকানি চোবানি খাই। এক সময়ের উদযাপন, উৎসবের পালা ক্রমশ হয়ে উঠছিল গলগ্রহ। বিবাহে যেমন প্রেমের মৃত্যু, কতকটা সেরকমই। স্টেজে উঠেও অপেক্ষায় থাকি কখন ফুরোবে। একসময় এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যেতাম ‘তারপরের’ সাঁকো বেয়ে। গত কিছু বছর কেমন যেন উল্টো গুনি। মনে ভাবি, কতটা কভার হল? আর কতক্ষণ!
পেশাদারিত্বের এই লাঞ্ছনা আর কতদিন নিত বুকঝিম? কতদিন আবেগের খুড়োর কল দেখিয়ে, স্কিলের সম্মোহনে বেবাক ঠকাতাম তোমাদের? কতদিন অমুকের প্রযোজনা আর তমুকের বিজ্ঞাপনের দুষ্ট হস্তে বিবস্ত্র করতাম আমার এককালের ভালবাসাকে? আর পারছিলাম না। আর হচ্ছিল না। এ বড় ব্যথার গান। একে বেচতে আর ভালো লাগছিল না। কিন্তু ক্ষান্ত দেবার ক্ষমতা আমার নাই। সেই বছর পঁচিশের শ্রমণ, বৃষ্টি চোখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন, তার ঘুমভাঙার প্রয়োজন হল এবার।
ঘুম ভেঙেই শ্রমণ আমারে মারলে থাপ্পড়! বললে– শ্বাস নেবে। এই শীতের শেষ যে দুটো শো কোম্পানির ধরা, সে দুটো করবে সে নিজে। আমার চাকরি গেল। জমানো টাকা ট্যাঁকভর্তি করে আমি বাড়ি গেলেম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেম একরকম। গল্প শোনার মানুষেরা ভরিয়ে রাখলেন সন্ধ্যার ঘর। বহু বছর পর সৈয়দ শামসুল হকের বুকঝিম এক ভালোবাসা হল। শো নয়। উদযাপন। জানি না সে কেমন সন্ধ্যা ছিল। তাকে আমার দেখা হল না। আজ বছর শেষের সংবাদে শ্রমণ আমাকে সে খবর দিল।
বছর শেষের পাঠক, তুমি যদি এখনও এখানে থেকে থাকো তবে খেয়াল রেখো। যাপনের সাফল্য হয় না। সাফল্য জরিপ করার জিনিস। অঙ্ক কষে বিশ্ব বাঁধেন যাঁরা, তাঁদের খাতায় লেখা থাকে সেসব হিসেব। ভালো তারাও বাসেন। তবে প্রেয়সী অধিকৃত হলে, তবেই সে ভালোবাসা ‘সফল’ বলে গণ্য করে থাকেন। প্রকৃত ভালোবাসা টার্গেট-প্র্যাকটিস নয়। সে নিরন্তরের যাপন।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন বুকঝিম শেষ করলাম কেন। শেষ করলাম কই? আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা! ৫০০ বছরের এ কাহিনি ব্রহ্মপুত্রকে পুরাতন হতে দেখেছে। শ্রুত-অশ্রুত বহু পদে, গীতিকায় তার নায়ক-নায়িকারা চেনা দিয়েছে নানা নামে, নানা রূপে। তারও বহু পরে ব্রহ্মপুত্র শুকায়ে গেছে। আমি তখন কাঠকয়লা লোহায় গড়া একটি শহরে বাংলা অক্ষর চিনছি, শিখছি উচ্চারণ। তালিম নিচ্ছি গল্প কাঁধে তোলার। সে সময়ের কিঞ্চিৎ আগে বোধ করি, বাংলা ভাষার নানা মৃত্যুর কোনওটা হচ্ছিল। আমাদের এ ভাষাকে কাক-শকুনে খাচ্ছিল বোধহয়, যেমন খেয়ে থাকে। সে ধূসর প্রান্তরে যেমন একা দাঁড়ায়ে হারা যুদ্ধের একক লাঠিয়াল আবু হানিফা লাঠির স্রোত তুলেছিল, ভারী অম্ল বাতাসে… তারই কোনও পরজন্ম যেন… লেখনীর ধারে খোদাই করছিল বাংলা ভাষার এক অভয় কায়াস্বরূপ। সুঠাম, নিবিড়, মধুর সে মূর্তি আমায় চেনা দেয় আমার যৌবনের গোড়ায়।
সেই ভাস্কর সৈয়দ শামসুল হক। সে মূর্তি বুকঝিম এক ভালোবাসা। ‘বুকঝিম এক ভালোবাসা’ আমি শুরু করি নাই। সেই ভাষার কারিগরের অপার যাত্রার আগে দিয়ে যাওয়া আদেশ বয়েছি মাত্র। বইব আজীবন। ব্রহ্মপুত্র শুকায়ে গেছে, যমুনায় গাদ জমেছে এতকাল। আমার অস্থি-পেশিতে বিরক্তির টান ধরেছে বহুদিন। শীত বাড়ছে। শীত বাড়ছে। শীত বাড়ছে নিরন্তর। বুকঝিম এক ভালোবাসার শেষ নাই। যাবৎ বাঁচি, তাবৎ গাই। চাঁদের আলোর ওপার নাই।
বছর শেষের পাঠক! প্রিয় আমার, বন্ধু আমার, তোমায় বলি শোনো। শুরু শেষের হিসেব রাখা বিষম ঝকমারি। ওই ঝামেলায় পড়বে না একদম। আমার নিজের শুরু কবে যে ছাই, তাই কি আমি জানি? আমার যখন বছর ষোলো, আমার মায়ের জন্ম হল। ইচ্ছে হয়ে ছিলাম আমি পিতার কৈশোরে। কালের নদী বয়ে চলছে নিরন্তর। যখন যে পাড়ে পড়ব কপালজোরে, প্রাণ ভরে স্নান সারব, আঁজলা ভরে তৃষ্ণা মেটাব। চলতে থাকব। চলতে থাকব। থামতে দেব না। বছর শেষের লেখা পড়লে না মোটেই। পড়লে অধমের ভাবা বছর শুরুর অভিবাদন।
বুকঝিমও আবার শুরু হবে। প্রোডাকশন বন্ধ করে সেই রাস্তাই প্রশস্ত করলাম। তুমিও জাঁকিয়ে শুরু করো। মাঝপথে দেখা হবে।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved