ভালোবাসা জিনিসটাকে আমরা কেবল একটি পুরুষ ও নারীর যৌনতাভিত্তিক সম্পর্ক হিসেবে দেখি। এই বিমল বাগানে শুধু তাদেরই অংশীদারিত্ব। এর বাইরে যে কত টান, কত আবেগ, কত রকম যন্ত্রণা থাকতে পারে তার হিসাব আমরা রাখি না। আমাদের জীবনের অনেকটা অংশ ভাইবোনদের সঙ্গে কাটে। কিন্তু ছোটবেলাটা চলে গেলে সেই ভাইবোনদের খোঁজ আমরা আর পাই কি? যে কাকার ছেলেটাকে ছাড়া আমার চলত না, যে ছিল আমার খেলার সঙ্গী, যার সঙ্গে মনের সব কথা ভাগ করে নিতাম, আর যাকে না জড়িয়ে আমি শুতে পারতাম না– আজ স্ত্রী, সন্তান আর সংসার হয়ে যেতে সেই ভাইটার সঙ্গে যোগাযোগ আমরা কতটুকু রাখি?
সিনেমা-শিল্পের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মত আছে। তবে এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অপরিসীম। পর্দায় আমরা নিজেদের জীবন ছুঁয়ে দেখতে চাই কখনও। আবার নিজেদের ক্লান্ত জীবন থেকে দূরে যাব বলে ওই পর্দাতেই শুশ্রুষা খুঁজি। মানুষের নিলয়-অলিন্দে ব্যথার যে পাহাড় জমে থাকে, সিনেমা কখনও সেসবেরও হদিশ দিয়ে যেতে পারে। আমরা তর্ক জুড়ি যে সিনেমা ‘বিনোদন’ দেবে। আমাদের হালকা করবে। আনন্দে-হাসিতে মজাবে। আবার এই আমরাই বহু সময় দু’চোখ জুড়ে কান্নার প্রস্রবণ নামিয়ে আনি সেই সিনেমার মধ্যে দিয়েই।
‘আ রিয়াল পেইন’ (২০২৪) (A Real Pain Review ) ছবিতে ডেভিড কাপলান (জেসি আইসেনবার্গ) আর বেঞ্জামিন কাপলান (কিরান কালকেন) হল দুই তুতো ভাই। তাদের বাবারা তথাকথিত মায়ের পেটের দু’ভাই ছিল। তাদের ঠাকুমা ছিলেন হিটলারের শাসনকালে পোল্যান্ড পালানো, গ্যাস-চেম্বার থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা এক ইহুদি নারী, পরবর্তীকালে যিনি আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। যে-কোনও উদ্বাস্তুর মতো বেঞ্জি-ডেভিডের ঠাকুমাও এক টুকরো আপন দেশ (এক্ষেত্রে পোল্যান্ড) সারাজীবন নিজের মধ্যে বহন করে বেরিয়েছিলেন।
বেঞ্জি আর ডেভিডের নিজেদের মধ্যে ভাগ করা একটা ছোটবেলা আর তার স্মৃতি আছে। ছোটবেলায় আমরা সব ভাই-বোনই একে অপরের মতো হতে চাই। ভাবি আমরা আর বড় হব না। নিজস্ব কুটিরের শান্তি, সুরক্ষা আর লেপ-চাদরের ওম ছাড়তে আমাদের কষ্ট হয়। আত্মীয়তায় আমরা মিলেমিশে থাকি। কিন্তু ভাগ্য কখন আমাদের ছোটবেলা কেড়ে বড় বানিয়ে দেয়, আলাদা করে আর একে অপরের সঙ্গে অজান্তেই আমরা দূরত্ব রচনা করে ফেলি, টের পাই না। বেঞ্জি আর ডেভিডের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাই ঘটেছে। যে দুই তুতো ভাই একে অপরকে জড়িয়ে ছিল পুরো ছেলেবেলাটা, তারা শুধু যে স্বভাব-অভ্যাসে দু’রকম তৈরি হয়েছে– তা নয়, জীবনস্রোতও তাদের ভিন্ন পথে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বেঞ্জি খোলামেলা, অবিবাহিত, প্রায় কোনও ঠিকঠাক কাজ না করা যুবক এখন। ডেভিড নিউ ইয়র্ক শহরে স্ত্রী, কন্যা আর ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম নিয়ে একটা ধীর-স্থির জীবন অতিবাহিত করে।
ঠাকুমা তাঁর মৃত্যুর পর যে টাকা রেখে যান, ডেভিড আর বেঞ্জি সিদ্ধান্ত নেয় যে সেই টাকায় তারা ইহুদি হেরিটেজ ট্যুরে যাবে পোল্যান্ডে। ওয়ারশ-তে পৌঁছে তারা মিলিত হয় মার্ক, ডায়ান, মারসিয়া আর এলোজের সঙ্গে। মার্ক (ড্যানিয়াল ওরেসকেস) আর ডায়ান (লিসা স্যাডোভি) ওহায়ো শহরের এক মধ্যবিত্ত দম্পতি। মারসিয়া (জেনিফার গ্রে) ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকে। সে মধ্যবয়স্কা এবং সদ্য তার ডিভোর্স হয়েছে। আর এলোজ (কার্ট ইগুয়েন) ছেলেটি কৃষ্ণাঙ্গ। রুয়ান্ডার গণহত্যা সে নিজের চোখে দেখেছে। এখন সে ইহুদি ধর্মে আশ্রিত। এদের সঙ্গে যে ট্যুর গাইড, সেই ভদ্র আর সুন্দর ছেলেটি হল ইউকে থেকে আসা জেমস (উইল শার্প)। ছবিতে সাবপ্লট বেশি নেই, কিন্তু আন্দাজ করা যায় যে ডেভিড আর বেঞ্জির মতো এরা সকলেই নিজের নিজের জীবনে জমানো কোনও ব্যথার অঙ্ক বুঝি এই ট্যুরে মেলাতে এসেছে। পোল্যান্ডের বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত স্থান এই ছোট দলটি ঘুরে দেখতে থাকে আর অন্যদিকে ডেভিড-বেঞ্জির সম্পর্কের নানা পরত খুলে যায়।
জেসি আইসেনবার্গ পরিচালক হিসেবে এক কথায় খাসা। প্রসঙ্গত, আমেরিকার সিনেমা-শিল্পে সাম্প্রতিককালে জেসি ছাড়াও বেশ কয়েকজন অভিনেতা খুব শক্তিশালী ফিল্মপরিচালক হিসেবে উঠে এসেছেন; যেমন– গ্রেটা গারউইক, বেন অ্যাফ্লেক কিংবা ব্র্যাডলি কুপার। জেসি আইসেনবার্গের শিল্পেও যথেষ্ট মুনশিয়ানা আছে। আবহ সংগীতের ব্যবহার এ-ছবিতে অনন্যসাধারণ বললে কম বলা হয়। সমগ্র ছবিটি একটা অপূর্ব ভ্রমণের ছন্দে চলে। যেন আমার-আপনার কেরল কিংবা কাশ্মীর বেড়াতে বেরনো। মনে দীর্ঘদিন দাগ কেটে যাওয়ার মতো ছোট ছোট দৃশ্যগুলি যেন প্যাস্টেল রঙে আঁকা একেকটি ছবি। এবং জেসি এমন একটি বিষয় নিয়ে এ-ছবি তৈরি করেছেন, যা সচরাচর চোখে পড়ে না। ভালোবাসা জিনিসটাকে আমরা কেবল একটি পুরুষ ও নারীর যৌনতাভিত্তিক সম্পর্ক হিসেবে দেখি। এই বিমল বাগানে শুধু তাদেরই অংশীদারিত্ব। এর বাইরে যে কত টান, কত আবেগ, কত রকম যন্ত্রণা থাকতে পারে তার হিসাব আমরা রাখি না। আমাদের জীবনের অনেকটা অংশ ভাইবোনদের সঙ্গে কাটে। কিন্তু ছোটবেলাটা চলে গেলে সেই ভাইবোনদের খোঁজ আমরা আর পাই কি? যে কাকার ছেলেটাকে ছাড়া আমার চলত না, যে ছিল আমার খেলার সঙ্গী, যার সঙ্গে মনের সব কথা ভাগ করে নিতাম, আর যাকে না জড়িয়ে আমি শুতে পারতাম না– আজ স্ত্রী, সন্তান আর সংসার হয়ে যেতে সেই ভাইটার সঙ্গে যোগাযোগ আমরা কতটুকু রাখি?
এ-ছবির গল্প শুধু ডেভিড আর বেঞ্জির নয়, আমাদের সকলের, যাদের নিজেদের কিংবা তুতো ভাইবোন আছে। এ-কাহিনি ভীষণরকম সর্বজনীন। জীবনে কিছুই তেমন হয়ে উঠতে না পারা বেঞ্জিকে ভেতর ভেতর দুঃখিত করে তুলেছিল নিশ্চয়ই। তা নয় তো সে কেন এক সময় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল? ডেভিড, ভ্রমণ দলের সকলের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে বেঞ্জির আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এবং সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবার কথা বলে বসে। আসলে ডেভিড কোথাও বেঞ্জির নিজেকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে হতচকিত ছিল। পারিবারিক যে টানে তারা দু’ভাই বড় হয়েছে, সেই সমস্ত সুতো আলগা করে কেন বেঞ্জি পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার চিন্তা করল? তাদের ঠাকুমা একটা ঐতিহাসিক গণহত্যার কবল থেকে বেরিয়ে অন্য দেশে প্রবাসী হয়ে জীবনকে সুখময় করে তুলেছিলেন। সেই রক্তের জোরও কি এত শক্তিশালী ছিল না যে বেঞ্জি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকত? ডেভিডের মতে, বেঞ্জি এত আনন্দ, হাসি আর ঠাট্টা নিয়ে মশগুল থাকা একটা ছেলে, সে ঘরে ঢুকলে ঘর আলোকিত হয়, ডেভিড নিজেও বেঞ্জির প্রতি এই কারণে প্রায় ঈর্ষান্বিত; সেই বেঞ্জির মনে কেন ঘাপটি মেরে থাকবে এত অন্ধকার? কিন্তু ডেভিড কি আর বেঞ্জির শুশ্রুষা হতে পারবে। জীবনস্রোতে জীবনের দু’দিকে ভেসে যাওয়া দু’ ভাই খুব তাড়াতাড়ি হয়তো কাছে আসতে পারে না। এক ঘরে তারা শুতে পারে, এক বাথরুম ভাগ করে নিতে পারে, হোটেলের ছাদে গাঁজা খেতে পারে একসঙ্গে– কিন্তু এত বছরের দূরত্ব এত সহজে মুছে ফেলতে পারে না।
বেঞ্জি চরিত্রে কিরান কালকিনের অভিনয় মনে রাখার মতো। কিরান এ-বছর ওই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর’ বিভাগে অস্কার পেয়েছে। বিষাদরোগ আর আত্মহত্যা প্রবণতায় ভোগা মানুষ বলতে যে আসলে হাসিমুখের মানুষ বোঝায় তা কিরানের অভিনয় না দেখলে জানা যেত না। একটা অজানা কষ্টের ভার তাকে এক জায়গায় বসতে দেয় না। এই মন খুলে সে হাসছে তো পরক্ষণেই কখন দু’চোখ ভরে উঠছে জলে তার, সে ঠাহর করতে পারছে না। ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে ভুক্তভোগী কোনও চরিত্রের এত সুন্দর অভিনয় শেষ দেখা গিয়েছিল বোধ করি ‘ম্যানচেস্টার বাই দ্য সি’ ছবিতে ক্যাসি অ্যাফ্লেকের।
‘আ রিয়াল পেইন’ যেহেতু একটি ভ্রমণকাহিনি এবং পোল্যান্ডে সেই হিটলারের সময়কার হত্যার ইতিহাস ও কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে, দর্শকমন হয়তো পুরো শহরটা ঘুরে দেখতে চাইছিল। ওই ট্যুরের শেষ দিন ছিল গ্যাস-চেম্বার দর্শন। ডেভিড আর বেঞ্জি-সহ পুরো দলটা গ্যাস-চেম্বারে যায় যখন আর দেখে তাদের পূর্বসূরিদের কী বীভৎসতায় সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তারা ব্যথাতুর না হয়ে পারে না। গ্যাস-চেম্বারে ঢোকানোর আগে যে জুতো খোলানো হত ভিক্টিমদের, তাদের স্তূপীকৃত জুতোর পাহাড়ের সামনে এসে সময় যেন থমকে যায়। সেই অত্যাচার, সেই হত্যালীলা, সেই হিংসার কাছে দাঁড়িয়ে বুঝি প্রত্যেকে উপলব্ধি করে তাদের ব্যথার, তাদের কষ্টের তেমন কোনও জোরই নেই। তাই এদের ছোট ছোট আঘাতপ্রাপ্ত জীবনগুলো যেন খানিক লাঘব হয়। ট্যুর শেষ করে ডেভিড আর বেঞ্জি তাদের ঠাকুমার ফেলে আসা বাড়ির খোঁজ করে। পেয়েও যায়। কিন্তু সেই ইতিহাস তো স্মৃতি, কেবল ছুঁয়ে দেখা যায় মাত্র। যাপন করা যায় না। ডেভিড আর বেঞ্জি ওই বাড়িটার বাইরে থেকে একটা নুড়ি তুলে আনে। তারা আমেরিকায় ফিরে আসে। ডেভিড আর বেঞ্জি যে যার জীবনে ঢুকে যায়। ডেভিড নিউইয়র্কে নিজের বাড়ির বাইরে সেই পোল্যান্ড থেকে আনা নুড়িটা রেখে দেয়।
জেসি আইসেনবার্গের ‘আ রিয়াল পেইন’ নামক অভূতপূর্ব সুন্দর এই ছবিটি আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যায় যে আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির দরজার বাইরে ওইরকম একটা নুড়ি পড়ে আছে। যখনই কষ্ট পাব আমাদের ভাবতে হবে আমাদের পূর্বসূরিরা এর থেকেও বেশি ব্যথা নিয়ে পৃথিবীতে টিকেছিলেন। জীবনের রণে ভঙ্গ দিয়ে আমাদের সরে গেলে চলবে না।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………
শান্ত অবস্থা থেকে উত্তেজিত হয়ে পড়া কিংবা হঠাৎ আনন্দ পাওয়ার যে অভিব্যক্তি– তাতেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং এক সুতোও অতি অভিনয় না-করা মানুষ। হাতে একটি কাজ করতে করতে কারও সঙ্গে গপ্প করা কিংবা খাবার খেতে খেতে কথা বলার দৃশ্য তিনি এত ভালো করতেন যে, মনেই হত না পর্দায় কারও অভিনয় দেখছি।