Robbar

নিয়মক্লান্ত জীবনের ওপর এমন পক্ষীরাজ উড়ুক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 21, 2025 3:22 pm
  • Updated:June 21, 2025 4:36 pm  
Flm review of bengali film Pokkhirajer Dim

‘পক্ষীরাজের ডিম’ চায় আমাদের নিয়মমাফিক দেখাকে বদলে দিতে। এই যে যারা ঘোঁতনের মতো ফেলুরাম, তাদের অন্য আলোয় দেখাতে চায় এই ছবি। ঘোঁতনের মনের ভেতর উঁকি মেরে তার ভেতরের ম্যাজিককে চিনিয়ে দিতে চায়। যত সব হতচ্ছাড়া উদ্ভট আছে এই জগতে, যাদের আমরা অনিয়ম ভেবে খরচ করে ফেলি, তাদের সমানাধিকারের দাবি জানায় সৌকর্যর ছবি। সুকুমার রায়ের মতো সোচ্চারে আহ্বান জানিয়ে বলে ‘আয়রে পাগল, আবোল তাবোল, মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়’। এই তার রূপকথার রাজনীতি। তার ম্যাজিক রিয়াল আসলেই রিয়াল। কারণ তা মানুষে মানুষে ভাগ করে না। মানুষের ভালোয় আর মানুষের সাম্যে বিশ্বাস করে। ঘোঁতনের জন্য পপিন্স তাই থেকে যায়। আরও পরিষ্কার করে বললে, অঙ্কে ফেল ঘোঁতনকে কখনও ছেড়ে যায় না ফার্স্ট গার্ল পপিন্স। বন্ধুত্বর সঙ্গে মার্কশিটের তো কোনও সম্পর্ক নেই তাই না ?

বিশ্বাবসু বিশ্বাস

ঘোড়ার ডিম হয়? না। পক্ষীরাজের তো ডিম (Pokkhirajer Dim Review) হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! সৌকর্য ঘোষালের নতুন বাংলা ছবি ‘পক্ষীরাজের ডিম’ আসলে এই না-হওয়াদেরই গল্প। এই সংসারে যত ‘না হওয়া’ আছে, এই যাদের আমরা ‘ওরকম তো হয় না’ বলে অসম্ভবের খাতায় ফেলে রেখেছি, তথাকথিত বাস্তব, নিয়মসম্মত পৃথিবীতে যেসব অনিয়মকে আমরা মান্যতা দিতে চাইনি কখনও, সেইসব ‘না হওয়া’রই সত্যি হয়ে যাওয়ার গল্প সৌকর্যর এই সিনেমা।

Pokkhirajer Dim (2025) - IMDb

এর আগে ‘রেইনবো জেলি’তে ঘোঁতন আর পপিন্সের রূপকথা আমরা দেখেছি। পরিচয় হয়েছে তাদের ম্যাজিক রিয়াল দুনিয়ার সঙ্গে। এবারের প্রেক্ষাপট আকাশগঞ্জ। ছোট ছোট পাহাড়, জঙ্গল আর মালভূমির মাঝখানে এক ছোট্ট কাল্পনিক গ্রাম। ঘোঁতন সেখানে থাকে, ইশকুলে পড়ে, অঙ্কে নিয়মিত গোল্লা পায় আর রূপকথার গল্প শোনে। আকাশগঞ্জে নাকি এককালে নেমেছিল এক ভিনগ্রহের মহাকাশযান। আর এসেছিল এক পক্ষীরাজ। রেখে গিয়েছিল এক ম্যাজিক ডিম। এক রাজা খবর পেয়ে সেই ডিমটা নিয়ে যেতে আসে। তখনই বজ্রপাতে সেই রাজার মরণ এবং ডিম ভেঙে দু’টুকরো। সেই মহাকাশযানের আদলে এক প্রাচীন মন্দির আজও আছে আকাশগঞ্জে। সেই মন্দির পাহারা দেয় এক ত্রিকালজ্ঞ সাধু– ‘সাপরাজ বাবা’। তা সেই মন্দিরে হঠাৎ একদিন ঘোঁতন খুঁজে পায় এক পাথর। পক্ষীরাজের ভেঙে যাওয়া ম্যাজিক ডিমের টুকরো। নিয়ে যায় গ্রামের খ্যাপা মাস্টার বটব্যাল স্যরের কাছে। এদিকে সেই পাথরের খোঁজে গ্রামে আসে বিদেশি খলনায়ক। মিস্টার ভিলেন। শুরু হয় ঘোঁতন, পপিন্স আর বটব্যাল স্যরের আশ্চর্য জার্নি। আর ঠিক তারপরেই সৌকর্য তার ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেন। বুনতে থাকেন গল্পের মধ্যে গল্প, তার মধ্যে গল্প। সত্যি মিশে যায় ম্যাজিকে, ম্যাজিক চুইয়ে পড়ে সত্যির গায়ে।

…………………………………

রূপকথা আমরা ছোটবেলা থেকেই কমবেশি পড়েছি সবাই। কিন্তু রূপকথা তো শুধুই শিশু মনের কিছু আজগুবি ইচ্ছেপূরণের কাহিনি হয়। রূপকথা তো আসলে রূপক কথা।  আকাশগঞ্জে যখন হঠাৎ করে ভিনগ্রহের জ্যান্ত পাথর বা লিভিং স্টোন পাওয়া যায় এবং সেই পাথরের সঙ্গে সঙ্গে আকাশগঞ্জে ঢোকে লোভ, হিংসা, অপরাধ তখন কি আমাদের স্কটিশ বৈজ্ঞানিক-অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোনের কথা মনে পড়ে না? মনে পড়ে না বহিরাগত শক্তির দ্বারা আমাদের নিজস্ব জমি, জঙ্গল এবং সংস্কৃতি অধিকৃত হওয়ার গল্প? গ্রামের নেতা এবং তার সহকারীরা যখন বিলিতি অর্থের লোভে নিজেদের গ্রাম, গ্রামের মানুষদের প্রতারণা করতে শুরু করে, মনে করুন তো স্থান-কাল-নির্বিশেষে এমন বিক্রি হয়ে যাওয়া মধ্যপন্থীদের আপনি চিনতে শুরু করেন কি না?

…………………………………

আমরা আমাদের একদম ছোটবেলায় মাল্টিলেয়ার্ড কেক দেখিনি। খানিক বড় হওয়ার পর হঠাৎ একই কেকের পেটের ভেতর নানা রকমের ক্রিম, নানা রঙের জেলি দেখে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, এই ছবির কাহিনি বিন্যাস একইরকম সারপ্রাইজ এফেক্ট তৈরি করে। বাংলা ছবিতে এই ধরনের এমবেডেড ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ খুব কম। সৌকর্য করেছেন। তাও আবার শিশুকাহিনিধর্মী সিনেমায়।

এই ছবির গল্প বা গল্প বলার ধরন এর বেশি ফাঁস করা চলে না। কিন্তু যেটা ফাঁস করা চলে, সেটা হল কেন ‘পক্ষীরাজের ডিম’ জরুরি সিনেমা।

রূপকথা আমরা ছোটবেলা থেকেই কমবেশি পড়েছি সবাই। কিন্তু রূপকথা তো শুধুই শিশুমনের কিছু আজগুবি ইচ্ছেপূরণের কাহিনি হয়। রূপকথা তো আসলে রূপক কথা।  আকাশগঞ্জে যখন হঠাৎ করে ভিনগ্রহের জ্যান্ত পাথর বা লিভিং স্টোন পাওয়া যায় এবং সেই পাথরের সঙ্গে সঙ্গে আকাশগঞ্জে ঢোকে লোভ, হিংসা, অপরাধ– তখন কি আমাদের স্কটিশ বৈজ্ঞানিক-অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোনের কথা মনে পড়ে না? মনে পড়ে না বহিরাগত শক্তির দ্বারা আমাদের নিজস্ব জমি, জঙ্গল এবং সংস্কৃতি অধিকৃত হওয়ার গল্প? গ্রামের নেতা এবং তার সহকারীরা যখন বিলিতি অর্থের লোভে নিজেদের গ্রাম, গ্রামের মানুষদের প্রতারণা করতে শুরু করে, মনে করুন তো স্থান-কাল-নির্বিশেষে এমন বিক্রি হয়ে যাওয়া মধ্যপন্থীদের আপনি চিনতে শুরু করেন কি না?

Pokkhirajer Dim": Soukarya's Magical Children's Fantasy | t2ONLINE

আবার এইসব নেতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকে বটব্যালের মতো শিক্ষকরা। যিনি বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন আলো আসলে সরলরেখায় চলে না। না, তত্ত্ব নতুন নয়।  আইনস্টাইনের জিভ কাটা ছবি আপনারা সিনেমার মধ্যেই দেখতে পাবেন। কিন্তু বটব্যাল তো শুধু তত্ত্ব প্রমাণ করতে চান না।  তিনি চান প্র্যাক্টিকাল। তিনি বিজ্ঞানের থিয়োরি হাতে কলমে শেখাতে গিয়ে স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। তিনি বুঝে নিতে চান আলো যখন বক্ররেখায় চলে, সেই অন্য আলোয় মানুষকে দেখলে কেমন লাগে। তিনি আমাদের মানুষকে দেখার, বোঝার, জাজ করার চিরাচরিত ধারণাকে প্রশ্ন করতে চান। ঠিক যেমন প্রশ্ন করতে চায় ঘোঁতন। অঙ্কে শূন্য পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে এই বিরাট বড় ইউনিভার্সে ছোট্ট একটা পৃথিবীর ছোট্ট একটা আকাশগঞ্জের আরও ছোট্ট একটা স্কুলে অঙ্কে গোল্লা পেলেই কি কেউ জীবনের হিসেবে ফেল? আমাদের এই মানুষজীবন কি কয়েকজনের ঠিক করে দেওয়া পাশ-ফেলের নিয়মেই চলবে? আই কিউ আর নম্বরই শুধু মানুষের একমাত্র পরিচয়?

ঠিক এইখানেই সৌকর্যর রূপকথার সাফল্য।

children films in bengali industry Soukarya Ghosal - Soukarya Ghosal Exclusive: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কেন ছোটদের ছবি এত কম? টলিউড নিয়ে অকপট সৌকর্য - Soukarya Ghosal tollywood filmmaker talks about ...

‘পক্ষীরাজের ডিম’ চায় আমাদের নিয়মমাফিক দেখাকে বদলে দিতে। এই যে যারা ঘোঁতনের মতো ফেলুরাম, তাদের অন্য আলোয় দেখাতে চায় এই ছবি। ঘোঁতনের মনের ভেতর উঁকি মেরে তার ভেতরের ম্যাজিককে চিনিয়ে দিতে চায়। যত সব হতচ্ছাড়া উদ্ভট আছে এই জগতে, যাদের আমরা অনিয়ম ভেবে খরচ করে ফেলি, তাদের সমানাধিকারের দাবি জানায় সৌকর্যর ছবি। সুকুমার রায়ের মতো সোচ্চারে আহ্বান জানিয়ে বলে ‘আয়রে পাগল, আবোল তাবোল, মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়’। এই তার রূপকথার রাজনীতি। তার ম্যাজিক রিয়াল আসলেই রিয়াল। কারণ তা মানুষে মানুষে ভাগ করে না। মানুষের ভালোয় আর মানুষের সাম্যে বিশ্বাস করে। ঘোঁতনের জন্য পপিন্স তাই থেকে যায়। আরও পরিষ্কার করে বললে, অঙ্কে ফেল ঘোঁতনকে কখনও ছেড়ে যায় না ফার্স্ট গার্ল পপিন্স। বন্ধুত্বর সঙ্গে মার্কশিটের তো কোনও সম্পর্ক নেই তাই না ?

children films in bengali industry Soukarya Ghosal - Soukarya Ghosal Exclusive: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কেন ছোটদের ছবি এত কম? টলিউড নিয়ে অকপট সৌকর্য - Soukarya Ghosal tollywood filmmaker talks about ...

বটব্যালের চরিত্রে সান্টাক্লজের মতো মন ভালো করা এক আধা সত্যি-আধা ম্যাজিক অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। তার শরীরী ভাষায়, চেহারায় যে সামান্য অতিরেকের ব্যবহার হয়েছে তা এই অতিসত্যি অতিগল্পের সঙ্গে দিব্যি মিশে যায়। বড্ড যত্ন করে এই চরিত্রের মন এবং সারল্যকে নির্মাণ করেছেন অভিনেতা। তবে এই ছবির প্রাণ অবশ্যই ‘ঘোঁতন’ মহাব্রত বসু এবং ‘পপিন্স’ অনুমেঘা ব্যানার্জীর অভিনয়। কষ্ট, দুঃখ, মনখারাপ, ভালোবাসা, বন্ধুতা আর একরাশ মায়া কি সহজে জ্যান্ত হয়ে থাকে এই দুই সদ্য কিশোর-কিশোরীর চোখে। এ-ও কি কিছু কম রূপকথা? দেবেশ রায়চৌধুরী এবং অনুজয় চট্টোপাধ্যায় অভিজ্ঞ অভিনেতা। ম্যাজিক গল্পের ম্যাজিক ভিলেন হিসেবে দু’জনেই জমিয়ে দিয়েছেন। দেবেশ রায়চৌধুরীর মতো অভিনেতাকে বাংলা ছবিতে কম দেখা যায়, এ আমাদের দুর্ভাগ্য।

সৌমিক হালদারের ক্যামেরা এবং সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা ভীষণ যত্ন করে এই মায়াদুনিয়ার দৃশ্য এবং ছন্দ নির্মাণ করেছে। ‘বাজেট’ শব্দটা খুব নির্মম। বিশেষ করে সায়েন্স-ফিকশন, ফ্যান্টাসি ছবির ক্রাফটে অর্থের সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ খুব বেশি থাকে। এই ছবিতে ধরা পড়েনি। সেই কৃতিত্ব অনেকটাই এই দু’টি মানুষের এবং অবশ্যই সংগীত নির্মাতা নবারুণ বোসের।

সবশেষে আর একটা কথা। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ কিন্তু প্রেমের ছবিও বটে। কৈশোরের প্রেম, আহা! আমরা তো ভুলতেই বসেছিলাম। কতদিন পর বাংলা ছবি তার প্রেমের গানে বয়ঃসন্ধি দেখল।

সাবাশ সৌকর্য। আমাদের বৈষয়িক, নিয়মক্লান্ত জীবনের ওপর এমন পক্ষীরাজ উড়ুক। বারবার উড়ুক।