সবে সোভিয়েত ভেঙেছে সে-বছর। কয়েক দশক জারি থাকা ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তাপ নিভে এসেছে। সেই দশকেরই একেবারে শেষ প্রান্তে জন হ্যামন্ড নামে এক কল্পনাবিলাসী বুড়ো কোস্টারিকার ১৪০ মাইল পূর্বে বানিয়ে ফেলেছিল একটা জবরদস্ত পার্ক। আমরা, যারা জন্ম ইস্তক বাড়ির পাশের চিলড্রেনস পার্ককে ভেবেছি এলডোরাডো, ধীরে ধীরে জুলজিক্যাল পার্ক থেকে বড়জোর ন্যাশনাল পার্ক অবধি ছড়িয়েছে যাদের রোমাঞ্চের বিস্তার, তাদের একেবারে তাক লাগিয়ে জন হ্যামন্ড একখানা এমন পার্ক বানাল, যার কাছে ফিকে হয়ে গেল সব আরণ্যক, রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। বার্লিন দেওয়াল, বাবরি মসজিদ, মুক্ত অর্থনীতি ও গ্যাট চুক্তির-র হাতুড়িতে ভাঙা ক্লাসিক বুর্জোয়াতন্ত্রের বাঁধ– ভাঙনের সেই দশকে সে ছিল এক অন্য ভাঙনের মহা-আখ্যান।
মাইকেল ক্রিকটন যখন ‘জুরাসিক পার্ক’ লিখেছেন, তখন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। ‘ক্রেজি সায়েন্স’ বা ‘ম্যাড সায়েন্স’ বলে যাকে অভিহিত করা হয়, সেই মাত্রাছাড়া আবিষ্কার-মানস তখন বেশ কিছুটা ফুলেফেঁপে উঠেছে। চাঁদে যাওয়া থেকে স্পুটনিকে চড়ে লাইকা নামক কুকুরটির মহাকাশযাত্রা, সবই সম্ভব হয়েছে সেই শতকে। আবার চর্চা চলেছে ইউফোলজি, অর্থাৎ অজানা উড়ন্ত চাকতি নিয়েও। আটের দশকে রিডলি স্কট ‘এলিয়েন’ বানিয়ে ফেলেছিলেন, অন্যদিকে স্পিলবার্গ বানিয়েছেন ‘ক্লোজ এনকাউন্টারস অফ দ্য থার্ড কাইন্ড’ এবং অবশ্যই, ‘ইটি’, সত্যজিৎ সরাসরি যে ছবিকে তাঁর মার্লন ব্র্যান্ডোকে নিয়ে বানাতে চাওয়া ‘দ্য এলিয়েন’-এর চিত্রনাট্য চুরি করে বানানো বলে দাগিয়ে দিয়েছেন সাক্ষাৎকারে। অন্যদিকে চাঞ্চল্যকর কনস্পিরেসি থিওরি বলছে, ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসি’-র মতো ছবির নির্মাতা স্ট্যানলি কুব্রিক সেট বানিয়ে ছবি তুলেছেন, তাকেই চাঁদে যাওয়ার ছবি বলে চালিয়ে দিয়েছে আমেরিকা। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের সেই দুরন্ত ঘোড়ার দৌড়ে হলিউডের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আটের দশকেই ‘স্টার ওয়ারস’ ট্রিলজির জরুরি দু’টি ছবি নিয়ে আসছেন জর্জ লুকাস, বিভিন্ন পরিচালকের হাত ধরে, ‘ব্লেড রানার’ বানাচ্ছেন রিডলি স্কট। ক্রিকটন সেই দশকেরই শেষে লিখলেন তাঁর এই ম্যাগনাম ওপাস, যা পরবর্তী দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবিটির ভিত্তিভূমি তো রচনা করলই, সঙ্গে সঙ্গে খুলে দিল তিন দশকব্যাপী চলতে থাকা মাল্টিমিডিয়া ফ্র্যাঞ্চাইজির দরজা।
জন হ্যামন্ড উপন্যাসে যেমনটিই থাকুক (উপন্যাসে তার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন ক্রিকটন), স্টিভেন স্পিলবার্গ তাকে বানালেন এক মানবতাবাদী পুঁজিপতি, যে ক্যাপিটালিজমের শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে, পা পিছলে গেলেই সে হয়ে উঠবে পরিবেশরক্ষক। এই চরিত্রে প্রাণ দিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো। শুরু থেকেই তাঁর উপস্থিতি এত মোলায়েম যে, জন হ্যামন্ডকে একরকম সান্তাক্লজ বললে ভুল হবে না। সান্তা তো বটেই, কারণ তামাম দুনিয়ার নতুন প্রজন্মকে হ্যামন্ড উপহার দিতে চায় হারিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক জীবজগৎ। ক্রিটেসিয়াস পিরিয়ডের ডাইনোসর থেকে গাছপালা, সবই জ্যান্ত করে তুলেছে সে, বিশ শতকের শেষভাগের প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে। এই পার্ক সরেজমিনে দেখতে গিয়েছে প্যালিয়েন্টোলজিস্ট অ্যালান গ্রান্ট, এলি স্যাটলার ও গণিতবিদ ইয়ান ম্যালকম, যার কাজ ক্যাওস থিওরি নিয়ে। যে তত্ত্ব জানায়, বিশৃঙ্খলারও শৃঙ্খল আছে, আছে সমীকরণ। এই যে জিন প্রযুক্তির চূড়ান্ত অগ্রগতি, তা কাজে লাগছে কীসে? ৬৫ মিলিয়ন বছর পিছিয়ে যেতে। প্রকৃতির নিয়মে বিলুপ্ত প্রাণীদের ফিরে পেতে। কিন্তু সেই প্রাক-সভ্যতাকে কি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আদৌ রাখে আধুনিক সভ্যতা? এইখানেই ক্যাওসের সার্থকতা। যা অতীত, তাকে বর্তমানে টেনে আনতে গিয়ে অবধারিত হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খলা, টাইম ট্রাভেলেও ঠিক যেমনটা হয়। বিজ্ঞানের বেড়াজালে এক বিপুল প্রাগ-ইতিহাসকে বাঁধা যায় না। যে সভ্যতা অরণ্যের ওপর তুলেছে ইমারত, সেখানে বিপুল টি-রেক্সের চলাফেরার সীমানা বাঁধা যাবে? জুরাসিক পার্কেরই এক কর্মচারী ডেনিস নার্ডি নেহাত লোভের বশে এই ৬৫ মিলিয়ন বছরের সঙ্গে মানবসভ্যতার যে দূরত্বটুকু ছিল, তা ঘুচিয়ে দেয়। মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তিই এই নিয়মতান্ত্রিকতাকে কাঁচকলা দেখায়। ভেঙে যায় ইলেকট্রিক বেড়া। দাপিয়ে বেরিয়ে আসে টি-রেক্স। বেরিয়ে আসে হিংস্র ভেলোসির্যাপ্টররা। এরপর মানুষের আর হাতে কিছুই থাকে না। কম্পিউটার প্রোগ্রামের কোড একটি দৃশ্যে ভেসে ওঠে র্যাপ্টরের চোখে। বোঝা যায়, বিবর্তনের ধারাবাহিকতা মুছে গিয়েছে। এর চেয়ে বড় নৈরাজ্য আর কী হয়? টি-রেক্স শেষ দৃশ্যে চিৎকার করে জানান দেয় তার অস্তিত্ব, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফ্লেক্স, যেখানে লেখা, ‘ওয়ান্স ডাইনোসরস রুলড দ্য আর্থ’। অর্থাৎ, একদা এক ডাইনোসরের গলায় হাড় ফুটে যাওয়ার কিস্সা আর চলবে না। তারা মানুষের পাশে পাশেই হাঁটবে। তাদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করবে ভেবেছিল বিজ্ঞান, কিন্তু জেফ গোল্ডব্লাম অভিনীত ইয়ান ম্যালকমের কথাই সত্যি হল, ‘লাইফ ফাইন্ডস আ ওয়ে’, জীবন ঠিক তার পথ খুঁজে নিল।
এরপরের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-ও স্পিলবার্গের নিজের ছবি। সেখানে স্যান ডিয়েগো-তে ঢুকে পড়ে ডাইনোসর। মানুষের লোভ সেখানেও ভিলেন। আর সেইসব লোভীরা মূলত বিগ কর্পোরেশন। তাদের শাস্তি দেয় খোদ টি-রেক্স। তারপর নানা ঘাটে জল গড়িয়েছে, এসেছে ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ ফ্র্যাঞ্চাইজি। সেখানে তৈরি হয়েছে জেনেটিক হাইব্রিড। হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর ফিরে আসা নয়, একেবারে কাল্পনিক দানব তৈরি করায় মন দিয়েছে মার্কিন পুঁজিবাদ। সেসব জেনেটিক দৈত্যকেও শায়েস্তা করেছে আসলি টি-রেক্স আর র্যাপ্টররা। তার শেষতম ছবিতে রীতিমতো দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, ডাইনোসররা এখন মানুষেরই সহ-অস্তিত্ব। তাই অতিমারী আর যুদ্ধের দামামা দেখা এই প্রজন্মের কাছে আর জুরাসিক পার্কের সেই বিস্ময় নেই, যে বিস্ময় নিয়ে আমরা চোখে থ্রিডি রিল মেশিন লাগিয়ে ডাইনোসর দেখতাম। টুইন টাওয়ারের মতোই মার্কিনিদের সেই বিস্ময়-প্রাসাদ ভেঙেছে। এখন ডাইনোসররা বাড়ির মধ্যেই থাকে ঠাসাঠাসি করে। হয়তো টেরোড্যাকটিল এসে বসে আমাদের বিলুপ্ত টিভি অ্যান্টেনায় বা পরিত্যক্ত ভোমায়। বনধের দিন রাস্তায় ঘোরে স্পাইনোসোর্যাস বা অ্যালোসোর্যাসরা। এখন জুরাসিক পার্কের দরজা খোলার সঙ্গে জন উইলিয়ামস-এর কালজয়ী সুরে সেই গা-ছমছম নেই।
একজনকে স্মরণ করে এই জুরাসিক-সফর শেষ হোক। ইরফান খান। ১৯৯৩ সালে যিনি অর্থাভাবে দেখতে পারেননি ‘জুরাসিক পার্ক’, বাইশ বছর পর ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’-এ তিনি ছিলেন প্রায়-প্রধান চরিত্রে। সেই ছবিতে তাঁর মৃত্যুদৃশ্য বিষণ্ণ করেছিল। ডাইনোসর আর এখন সত্যি হয় না, ইরফানের মৃত্যু কি সত্যি হতেই হত?