অক্ষমের হেনস্থার শুরুটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, একান্ত পারিবারিক পরিসর থেকেই শুরু হয়। বয়সে বড় বলে, পুরুষমানুষ বলে, কোনও বিষয়ে ভাল জানাবোঝা আছে বলে, পড়াশোনায় ভাল বলে, খেলাধুলোয় ভাল বলে, কোনও ভাল গুণ আছে বলে– এরকম বিবিধ কারণে ক্ষমতার স্বাদটা প্রথম পাওয়া যায়, হয়তো নিজের কোনও সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়াই, দস্তুর হিসেবে। কিন্তু তারপরে ক্রমশ ক্ষমতার অনুশীলনটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।
ছোটবলায় মধ্যমপাণ্ডব ভীম-কে বিষ খাইয়ে, হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিলেন দুর্যোধন। অশ্বত্থামার দারিদ্রের কারণে, অশ্বত্থামা যে দুধের স্বাদ জানতেন না, সেটাও কুরু-পাণ্ডব কিশোরদের মশকরার বিষয় বলেই সব্যস্ত হয়েছিল। গরিব শিক্ষক বাবা ছল করে ছেলেকে পিটুলি গোলা জল খাওয়ালেন– কিন্তু সেটাও নিষ্ঠুর রসিকতা হয়ে উঠল। শুধু কল্পকাহিনি নয়, ইতিহাস থেকেও এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। ক্ষমতাবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাহীনকে নিয়ে মশকরা করা, হেনস্থা করা-র রেওয়াজ নতুন কিছু নয়।
মেয়েকে নিয়ে এক মা এসে পৌঁছেছিলেন আমাদের অফিসে। মেয়ের গায়ের রং, চেহারা, বুকের মাপ সবকিছু মিলিয়ে মেয়ে-কে যে কোনও ছেলের পছন্দ হবে না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। অথচ ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বিভিন্ন বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্য মেয়েটিকে যথেচ্ছ যৌন লাঞ্ছনা করেছে। মেয়েটি প্রথমে বুঝতে না পারলেও, পরে যখন তার অস্বস্তি, অপছন্দগুলো মা-কে জানিয়েছেন, মা বেশ ভর্ৎসনাই করেছেন মেয়েকে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, মেয়ের হাবভাব যেন আর যথেষ্ট মেয়েলি থাকছে না। তাই কোনও সমাধানসূত্রের খোঁজে এসেছেন। আমার এক সহকর্মীকে দেখেছি, পুরুষ হিসেবে, ঔপনিবেশিক ধারণার মাপকাঠিতে চেহারায় ও ভঙ্গিতে খানিক পেলব, নিজেকে নিয়ে সবসময় অস্বস্তিতে ভুগতে। আমাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ভরসা পেয়ে সেই অস্বস্তি খানিক কমল বটে, কিন্তু পরিচিত সহকর্মীদের বাইরে তিনি একই রকম গুটিয়ে থাকতেন।
মনোরোগ কাটিয়ে সুস্থতার শংসাপত্র পেয়ে গেছেন এমন এক যুবকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, তাঁর গোটা কৈশোরটাই কেটেছে পরিবারের এক বয়োজ্যেষ্ঠর কাছে নিয়মিত লাঞ্ছিত হয়ে। এটা অন্য প্রসঙ্গ যে, এই যুবকের মনোরোগের গোটা চিকিৎসাপর্বে তাঁর শৈশবের এই বিভীষিকার কথা একবারও ওঠেনি।
অক্ষমের হেনস্থার শুরুটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, একান্ত পারিবারিক পরিসর থেকেই শুরু হয়। বয়সে বড় বলে, পুরুষমানুষ বলে, কোনও বিষয়ে ভাল জানাবোঝা আছে বলে, পড়াশোনায় ভাল বলে, খেলাধুলোয় ভাল বলে, কোনও ভাল গুণ আছে বলে– এরকম বিবিধ কারণে ক্ষমতার স্বাদটা প্রথম পাওয়া যায়, হয়তো নিজের কোনও সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়াই, দস্তুর হিসেবে। কিন্তু তারপরে ক্রমশ ক্ষমতার অনুশীলনটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষমতার স্বাদের যেহেতু কোনও বস্তুগত ভিত্তি নেই, তাই ব্যক্তিগত অবস্থান নিরপেক্ষভাবে যে কেউই এই ক্ষমতাচর্চার উত্তরাধিকার স্বীকার করে নিতে পারেন। ফলে দরিদ্র-নিম্ন/মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ সম্পন্নতার ক্ষমতাচর্চা করতে পারেন বা কোনও নারী, বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রের চর্চা করতে পারেন।
এই ভাসা-ভাসা ক্ষমতার অনুশীলন, সামগ্রিক ক্ষমতা-কাঠামোটাকে ধারণ করে ও বহন করতে সাহায্য করে। তাই, যখন প্রয়োজন হয়, তখন ক্ষমতার এই পেয়াদাদের বলি দিতে অসুবিধে হয় না। বরং এই সমস্ত ক্ষমতার বশংবদ অনুচরদের বলি দিয়ে মূল ক্ষমতা-কাঠামো তার গ্রহণযোগ্যতা, মান্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। ক্ষমতা-প্রদর্শনের গা-জোয়ারির, হেনস্থা করার সংস্কৃতিতে তিলমাত্র আঁচ আসতে না দিয়ে, কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর গোটা দায়টা চাপিয়ে দিতে চায়।
বিশেষ করে এই সময়ে, যখন ক্ষমতা তার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক দায়টাকেও অস্বীকার করছে, তখন ক্ষমতার সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে জনজীবনে অনুশীলনের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। ন্যূনতম বিরোধিতা, প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে যে কোনও ছুতোয় শুরুতেই নিকেশ করাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নজরদারির সংস্কৃতিকে গণপরিসরে মান্যতা দেওয়ার। ক্ষমতার প্রয়োজনে সযত্নলালিত ব্যাপক পশ্চাদপদতাকে ব্যবহার করে প্রতিবাদী সম্ভাবনাগুলোকে ‘জনবিরোধী’ বলে দেগে দেওয়ার।
ফলে পশ্চিমবঙ্গেরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে, বাঙালি বিরোধী ইস্তেহার জারি করে ফেলে। আর বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের বাইরে যে ব্যাপক বাঙালি, তাদের জন্য হিন্দি-হিন্দুস্তানের প্রকাশভঙ্গিকে প্রচার করতে যাবতীয় আয়োজন করা হয়। ফলে, বাঙালি জাতির ইতিহাসের বেদনার একটি শব্দ, ‘উদ্বাস্তু’, সমস্ত সংবেদনশীলতা হারিয়ে অন্যকে খাটো করার সামাজিক মান্যতা পেয়ে যায় খেলার মাঠে। নাগরিকত্ব প্রমাণের রাষ্ট্রীয় হুলিয়া, সামাজিক মান্যতা পায়। ঐতিহাসিকতার অজুহাতে, ইতিহাসকে নতুন করে নিজের সুবিধে অনুযায়ী লেখার ফন্দির পিছনে কিছু মানুষকে জড়ো করা যায় ভুল বুঝিয়ে। যেহেতু এগুলো হয় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রয়োজনে, তাই বাকি মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর প্রয়োজনে, অ-রাজনীতি, না-রাজনীতির ঢাক বাজানোটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ফলে ছাত্রসমাজকে রাজনীতি বিমুখ করে তোলার জন্য, প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বদলে, কর্তৃপক্ষের পছন্দসই ছাত্রসংসদ গঠনকে আইনসিদ্ধ করে তোলা হয়। বিশেষ করে সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিরোধী রাজনীতির অনুশীলনের ইতিহাস আছে, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে জনবিচ্ছিন্ন করাটা দরকারি হয়ে পড়ে। হেনস্থার, ক্ষমতা প্রদর্শনের গা-জোয়ারির এই সংস্কৃতির বিরোধিতা করার বদলে, সেই সংস্কৃতিকেই ব্যবহার করা হয় বিরুদ্ধাচরণের অছিলায়।