আজও কোথাও প্রতিবন্ধী মানুষেরা বঞ্চিত পরিবারের প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে, কোথাও বিকলাঙ্গ, অন্ধ, মূক ও বধির শিশুকে সাধারণ স্কুল ভর্তি করতে চাইছে না, ভর্তি করলেও স্পেশাল এডুকেটর রাখছে না। কোথাও চাকরিতে সফল হয়েও বিনা কারণে তাঁদের বাতিল করা হয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী-কার্ড’ আছে, কিন্তু প্রতিবন্ধীর সরকারি কার্ডকে গুরুত্ব না দিয়ে হেনস্থা করেছেন বাস কন্ডাক্টর। বাসের ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ আসনে আরামে বসে থাকা ‘সাধারণ’ যাত্রীকে যখন সিট ছেড়ে দিতে হয়, তাঁদের মুখে এখনও ফুটে ওঠে বিরক্তির রেখা।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
সাল ১৭৫৪। প্রকাশিত হয়েছিল উইলিয়াম হে-র ‘ডিফর্মিটি’। উইলিয়াম উচ্চশিক্ষিত, ইংল্যান্ডের এলিট সমাজের মান্যগণ্যদের অন্যতম। তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুট, জন্ম থেকেই পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা। উইলিয়ামের আত্মবিশ্বাসহীন জীবন কেটেছিল একরাশ লজ্জা নিয়ে। কারণ, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেরও তো অবজ্ঞার নিজস্ব ভাষা থাকে। উইলিয়ামের ‘অস্বাভাবিকতা’, শারীরিক বৈকল্যকে সেই ভাষার আঘাতে দীর্ণ হতে হয়েছিল সারাজীবন, পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে। কখনও চাপা হাসি, কখনও দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত করুণা ক্ষতবিক্ষত করেছিল তাঁকে।
দক্ষিণ সুদানের নুয়ের জনজাতির মধ্যে এক রীতি ছিল। যোদ্ধা জাতির নিজস্ব সমাজে সন্তান বিকলাঙ্গ হলে তাকে ছুড়ে ফেলা হত জঙ্গলে, হাতির পায়ের নিচে কিংবা নীল নদের জলে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মালে মনে করা হত, বাবা-মা নিশ্চিত ব্ল্যাক-ম্যাজিক বা ডাইনি-চর্চার সঙ্গে জড়িত। অতএব, সারা জীবনের জন্য গোটা পরিবার চিহ্নিত হয়ে যেত অপরাধী, অভিশপ্ত হিসেবে। স্পার্টায় রুগ্ন, প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্মমাত্র পরিণতি ছিল মৃত্যু। যুদ্ধ করে অস্তিত্ব রক্ষার যুগ পেরিয়ে কৃষির বিকাশ হল, শিল্পবিপ্লব ক্যাপিটালিজ্মের দাপট এল, কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের প্রান্তিকতা ঘুচল না। কারণ তাঁদের দিয়ে চাষের কাজ করানো যায় না, কারখানায় উৎপাদন হয় না। অতএব, তাঁরা ‘অপ্রয়োজনীয়’। এখনও ভারতের বহু প্রান্তের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রতিবন্ধী সন্তান হল বাবা-মায়ের পূর্বজন্মের পাপের ফল, কিংবা মায়ের শরীর বা পরিবারের জিনে কোনও লুকোনো অসুখের ফসল। তাই এমন সন্তানের জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মায়ের উপর শুরু হয় কম-বেশি শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। আর সন্তানটি হয় ব্রাত্য। মর্যাদাহীন। গুরুত্বহীন।
আসলে আবহমান সময় ধরে আমাদের চেতনার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে সুস্থতা, স্বাভাবিকতার ধারণা– যা ছকবাঁধা, সেটাই কাম্য, সেটাই গ্রাহ্য, সেটাই ‘স্বাভাবিক’। তার সামান্য বিচ্যুতি হলেই তাকে বাতিল করো, দেখেও না দেখার ভান করো, করে দাও ‘ইনভিজিবল মাইনরিটি’।
………………………………………………..
১৯৯৫ সালের প্রতিবন্ধকতা আইনেই প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ, অধিকার রক্ষার বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রসংঘের ‘অধিকার বিষয়ক সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছিল ভারতও। যার অর্থ, প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে ভারত দায়বদ্ধ। এর ১০ বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রণীত হয় ‘The Rights of Persons with Disabilities (RPwD) Act’। যা কার্যকর হয় ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ থেকে। এই আইনের উদ্দেশ্য, সমস্ত প্রতিবন্ধী মানুষ যাতে বৈষম্য ছাড়া সমমর্যাদা ও সমান সুযোগের সঙ্গে তাদের জীবনকে চালনা করতে পারে। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়েও তার বাস্তবায়ন কি হয়েছে?
………………………………………………..
আজও কোথাও প্রতিবন্ধী মানুষেরা বঞ্চিত পরিবারের প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে, কোথাও বিকলাঙ্গ, অন্ধ, মূক ও বধির শিশুকে সাধারণ স্কুল ভর্তি করতে চাইছে না, ভর্তি করলেও স্পেশাল এডুকেটর রাখছে না। কোথাও চাকরিতে সফল হয়েও বিনা কারণে তাঁদের বাতিল করা হয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী-কার্ড’ আছে, কিন্তু প্রতিবন্ধীর সরকারি কার্ডকে গুরুত্ব না দিয়ে হেনস্থা করেছেন বাস কন্ডাক্টর। বাসের ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ আসনে আরামে বসে থাকা ‘সাধারণ’ যাত্রীকে যখন সিট ছেড়ে দিতে হয়, তাঁদের মুখে এখনও ফুটে ওঠে বিরক্তির রেখা। রেলের টিকিট কাউন্টারে বা বিমানের দরজায় পরিষেবা পেতে বিরূপ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হয় ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ মানুষদের।
প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক চেতনার এই অবস্থার কারণ কী? মনে করা হয়, প্রতিবন্ধী মানুষেরা সংখ্যালঘু। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাত ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভারতে এমন মানুষদের সংখ্যা ২.২৬%। ২০১১ সালের জনশুমারি মতে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বিশ লক্ষাধিক। কিন্তু ২০১৬ সালের আইনে ২১ ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখিত, সেই অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষদের সংখ্যা ১০ শতাংশ অতিক্রম করবে। ১৯৯৫ সালের প্রতিবন্ধকতা আইনেই প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ, অধিকার রক্ষার বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রসংঘের ‘অধিকার বিষয়ক সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছিল ভারতও। যার অর্থ ছিল, প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে ভারত দায়বদ্ধ। এর ১০ বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রণীত হয় ‘The Rights of Persons with Disabilities (RPwD) Act’। এটি কার্যকর হয় ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ থেকে। এই আইনের উদ্দেশ্য, সমস্ত প্রতিবন্ধী মানুষ যাতে বৈষম্য ছাড়া সমমর্যাদা ও সমান সুযোগের সাথে তাদের জীবনকে চালনা করতে পারে। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়েও তার বাস্তবায়ন কি হয়েছে?
‘প্রতিবন্ধী-কার্ড’ আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া নবনামকরণ ‘দিব্যাঙ্গ’ শব্দটি আছে কিন্তু মানুষের নানা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা কীভাবে অতিক্রম করা যায়, তা নিয়ে কোথাও কোনও গঠনমূলক চিন্তাভাবনা অন্তত রাষ্ট্র বা সরকারের তরফে নেই। তাঁদের প্রতিদিনের চলাফেরা বা কাজ করার মতো পরিকাঠামো নির্মাণ, তাঁদের পুনর্বাসন, শিক্ষা, সমানাধিকার সম্পর্কে নিরাসক্ত, উদাসীন রাষ্ট্রকর্তারা। বাসে-ট্রামে-মেট্রোয় ‘প্রতিবন্ধী-সিট’ আছে কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী বা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী দিব্যাঙ্গদের সেই বাস-ট্রাম, মেট্রো বা পরিবহণের কোনও মাধ্যমে সহজে ওঠানামার কোনও বন্দোবস্ত অন্তত আমাদের চোখে পড়ে না। আবার ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটায় আমাদের মনে ভেসে ওঠেন এমন কিছু মানুষ যাঁরা চলতে ফিরতে পারেন না, চোখে দেখতে পান না, কানে শুনতে পান না কিংবা কথা বলতে পারেন না। এর বাইরেও আরও নানা রকম শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন অধিকাংশ মানুষ এখনও সেরিব্রাল পল্সি, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, অটিজ্ম (Autism), ডিস্লেক্সিয়া (Dislexia) এগুলোর পার্থক্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের কাছে, এঁরা সবাই এক কথায় ‘পাগল’। হয় তাদের পাগলা-গারদে থাকা উচিত, নয়তো বাড়িতে দরজা বন্ধ করে রাখা দরকার।
তাছাড়া, আমরা অনেক সময় মনে করি প্রতিবন্ধী একটা গোষ্ঠীমাত্র– যাঁরা জন্মগতভাবে বা দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং সেজন্য তাঁদের তথাকথিত সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কখনও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দয়া-দাক্ষিণ্যেরও! কিন্তু আমরা মনে রাখি না, তথাকথিত অ-প্রতিবন্ধী যাঁরা, তাঁরা যেকোনও সময়েই প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে পারেন। দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার অনুষঙ্গ তো আছেই এমনকি বার্ধক্যও আমাদের জীবনে প্রতিবন্ধকতা বয়ে আনতে পারে, সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।
আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের আলাদা যানবাহন, সরকারি ও বেসরকারি ভবনে তাঁদের প্রবেশ-প্রস্থানের আলাদা ব্যবস্থা, পার্কিংয়ের বন্দোবস্ত, শৌচাগারের ব্যবস্থা, বসার উপযুক্ত চেয়ার-টেবিল, আগুন লাগলে তাঁদের জন্য উপযুক্ত ইমার্জেন্সি এগ্জিট-এর মতো বিভিন্ন সুবিধা রাখা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশেও তো পুরাণ-মহাকাব্যে আমরা অন্ধ-মুনির কথা পড়েছি। জেনেছি অষ্টবক্র মুনির কথা, যিনি ‘অষ্টবক্র গীতা’ রচনা করেছিলেন। ষোড়শ শতকের কবি সুরদাস অন্ধ ছিলেন কিন্তু তাঁদের তো অসম্মান করা হয়নি। সম্মানীয় হয়ে আছেন হেলেন কেলার, মেক্সিকোর কালজয়ী চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কোহলো, গণিতবিদ জন ন্যাশ, স্টিফেন হকিং-সহ অনেকেই। তাহলে আমাদের দেশে বৃহত্তর নাগরিক সমাজে আজ কেন প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে নেতিবাচক মানসিকতা?
আসলে ‘ওরা আলাদা, ওরা অন্য রকম’– এভাবেই প্রতিবন্ধীদের দিকে দৃষ্টিপাতে আমরা অভ্যস্ত। তাঁদেরকে আমরা অবজ্ঞা করি, বৈষম্যমূলক আচরণ করি। তাঁদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলবে, মিশবে ‘সাধারণ’ মানুষ অনেকেই সেটা বুঝে পায় না। কখনও অসম্ভব দয়া, করুণার পাত্রয় পরিণত হয় ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ মানুষরা। কিছুতেই আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো আমরা তাঁদের ভাবতে পারি না।
কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে, অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে পাথেয় করে নিত্যদিনের যুদ্ধ লড়ছেন, নিজেদের সক্ষমতায় তাঁরা ক্রমশ এগিয়ে চলছেন। ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ নামে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের মূল স্রোতে থাকার অধিকার। বিশেষ চাহিদা পূরণের নামে এই বিচ্ছিন্নতা তাঁদের ক্লান্ত ও বিষণ্ণ করছে। আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে যতদিন ‘প্রতিবন্ধী’ বা ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ শব্দগুলি থাকবে ততদিন আমাদের পরিবেশ প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারবে না।
৩ ডিসেম্বর চলে গেল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতি বছর এই দিনটি আসে, চলে যায় কিন্তু বাস্তবের রুক্ষ পথটার কোনও পরিবর্তন হয় না। বৃহত্তর নাগরিক সমাজও কি কোনও দিন ভেবেছে এঁরা কী চান? করুণা নয়, আসলে তাঁরা চান সম্মান, সম-অধিকারের মর্যাদা। তাঁদের বোঝার জন্য মন চাই। প্রয়োজন মানসিকতা বদলের। সমবেদনা নয়, বরং বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমরা তাঁদের পাশে থাকতে পারি। মনে করতে পারি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথা— ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও, / মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও, /…এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও…’।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………