যৌনতা অর্থাৎ প্রজনন, কিংবা যৌনতা অর্থাৎ যৌন সহিংস্রতা বা ধর্ষণ জাতীয় ঘটনা, আর একটু এগোলে বা পিছলে যৌনতা অর্থাৎ ডাউরি ডেথ– এটাকেই আমরা যৌনতা বলে জেনেছিলাম। এর মধ্যে যৌন পছন্দ, যৌনসুখ, যৌন ন্যায়, যৌন অধিকার, ইচ্ছামতো যৌন জীবন কাটানোর দাবি– কোথায়? বরং ছিল ভয়– অজানা, অদেখা, অচেনাকে নিয়ে যে ভয় থাকে মানুষের, যে ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকে ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, যেখান থেকে জন্ম হয় বিবমিষার। অবশ্যই সবাই নন, অনেকেই অন্যরকমভাবেও ভেবেছিলেন, সঙ্গে এসেছিলেন বলেই ‘স্যাফো’র মতো সাপোর্ট গ্রুপ রেজিস্টার্ড সংগঠন হওয়ার জোর পেয়েছিল।
ব্যাপারটা শুনতেই কেমন বিদঘুটে! যৌনতা শব্দটাই একটা অশ্লীল ব্যাপার, তার ওপরে জুড়েছে পাঠশালা, মানে এখানে সেক্স করার বেসিক শিক্ষা দেওয়া হবে নাকি?
এসব মনে পড়লে আজ হাসি পায়, মনে হয় বুঝি বানানো কথা লিখছি, মানে আমরা এত দিকে এতরকম রগড়ানি খেয়েছি ‘স্যাফো’ খুলে বসার পর সেই ১৯৯৯-’০৩ সাল থেকে (প্রথমটা ‘স্যাফো ইনফর্মাল ইমোশনাল সাপোর্ট’ গ্রুপের শুরু আর পরেরটা ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালটি’ নামক রেজিস্টারড সংগঠন হিসাবে পথ চলা চালু), যে নিজেদেরও আর হিসাব থাকে না– কে কবে কত কিছু বলেছিল!
আসলে যেখানে সেক্স বা বাংলায় যৌনতা শব্দটা আছে, তার আশপাশ দিয়ে গেলে যে যা খুশি বলতে পারে। ‘যৌনতার পাঠশালা’র ভাবনা আসলে শুরুই হয়েছিল এই ‘যা খুশি তাই বলা’ বা ভাবার লাইসেন্স নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার জন্য যে, যৌনতা মানে কে কাকে কার সঙ্গে শুয়ে পড়তে চায় সেই সংক্রান্ত তাল পাকানোই শুধু নয়, নিশ্চয়ই যৌনকর্ম এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আলোচিত হতে পারে। কিন্তু গল্পের শুরুও বিছানায় আর শেষও বিছানায়, এতটাও সরল ও একমাত্রিক নয় জিনিসটা।
আসলে পাঠশালা তো অনেক পরের কথা, যা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে, তার আগে সেই ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ অবধি ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র দিন কীভাবে কেটেছিল তারও একটা ইতিহাস আছে। কেন শেষ পর্যন্ত ২০১৩-তে পৌঁছে তারা ‘যৌনতার পাঠশালা’ নামক এই কাণ্ডটি পাকাতে বসল, তাও আবার বাংলায়, এর সূত্রও বুঝতে হবে। সেই যে আমাদের ছোট্টবেলা থেকে রোটি-কাপড়া-মকান তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ করে তোলা হয়েছিল, তার ওপরে আবার সেই রোটি নিখুঁত গোল করে বেলে ও সেঁকে গরমাগরম রাজনৈতিক তত্ত্বালোচনায় রত পুরুষ সহযোদ্ধাদের (?) পাতে তুলে দিতে হয়েছিল, তার মধ্যে যৌনতার কোনও জায়গা কোথাও ছিল কি? আজকের যৌনতার পাঠশালার সূত্র লুকিয়ে আছে ঠিক ওইখানে। কারণ, যৌনতা অর্থাৎ প্রজনন, কিংবা যৌনতা অর্থাৎ যৌন সহিংস্রতা বা ধর্ষণ জাতীয় ঘটনা, আর একটু এগোলে বা পিছলে যৌনতা অর্থাৎ ডাউরি ডেথ– এটাকেই আমরা যৌনতা বলে জেনেছিলাম। এর মধ্যে যৌন পছন্দ, যৌনসুখ, যৌন ন্যায়, যৌন অধিকার, ইচ্ছামতো যৌন জীবন কাটানোর দাবি– কোথায়? বরং ছিল ভয়– অজানা, অদেখা, অচেনাকে নিয়ে যে ভয় থাকে মানুষের, যে ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকে ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, যেখান থেকে জন্ম হয় বিবমিষার– বমন করিবার ইচ্ছার! তাই সাধারণ মানুষ হোক আর স্কুল-কলেজের বন্ধু, মা-বাবা-দাদা-বৌদি থেকে শুরু অফিসকর্মী, কার ইচ্ছা হয়নি বমন করতে? এমনকী তার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন, ছিলেন সমাজকর্মীরাও। অবশ্যই সবাই নন, সবাই হলে তো আর এ গল্প লেখাই যেত না, অনেকেই অন্যরকমভাবেও ভেবেছিলেন, সঙ্গে এসেছিলেন বলেই স্যাফোর মতো সাপোর্ট গ্রুপ রেজিস্টার্ড সংগঠন হওয়ার জোর পেয়েছিল। কিন্তু যে জিনিসটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তা হল সমকামিতা বা রূপান্তরকামিতার কথা ছেড়েই দিলাম, আসলে মানুষ যৌনতা বস্তুটাই বোঝে না। শিশ্ন-যোনির প্রবেশমূলক একটা অ্যাক্ট বোঝে, যা বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে ঘটে, যার ফলে সন্তান আসে। সন্তান না চাইলে নানা ধরনের গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে হয়, নারীরা করে, কারণ কন্ডোম ব্যবহার করলে পুরুষের সুখ হয় না। নারীদের যৌন-সুখ এ প্রসঙ্গে আলোচিত হওয়ার কথা নয়, দুঃখ নিয়ে বরং কথা বলা সম্ভব।
……………………………………….
প্রথমবারের পাঠশালা, যাকে আমরা ইংরেজিতে ডাকি ‘সেক্সুয়ালিটি অ্যাকাডেমি’ বলে, সেটা সাজাতে গিয়ে দেখলাম এত কিছু নিয়ে কথা বলতে হলে গোটা সপ্তাহ কেটে যাবে, তাতেও হবে না, কারণ আমরা আবার সিনেমা দেখানোরও ব্যবস্থা রেখেছিলাম, যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খানিক কথা বললে বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হতে পারে। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল।
……………………………………….
২০১৩ সালে এইসব নানা ভাবনা নিয়ে প্রথম যৌনতার পাঠশালা মাটিতে নেমেছিল আমাদের উর্বর মস্তিষ্ক ভেদ করে। যার মূল কথা ছিল যৌনতাকে কেবলমাত্র কিছু দেহের মধ্যে ঘটা একটা ঘটনা, যার থেকে নতুন মানুষ জন্মাতেও পারে বা নাও পারে, সেই অ্যাক্টের বাইরে দেখার চেষ্টা। প্রথমত যৌনতা কাকে বলে দিয়ে শুরু করে, তার ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও বর্ণভিত্তিক প্রেক্ষাপট, তার আইনি অবস্থান, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি-মিডিয়া কীভাবে তাকে ধরেছে, কী দেখিয়েছে, আমরা ভোক্তা হিসাবে কী বুঝেছি, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক, একক নারীর সঙ্গে বা যৌনকর্মীর সঙ্গে, জীবন-জীবিকার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক– আলোচ্য বিষয় হিসাবে এই সবই ভেবেছিলাম। অর্থাৎ, অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যে যৌনতার অধিকার বলে যে বস্তুটা আছে, সেটা কেবল কে কার সঙ্গে বিছানায় গেল, আর কারা যৌন স্বেচ্ছাচার করে বেরানোর লাইসেন্স চেয়ে আন্দোলনের পবিত্রতা নষ্ট করার চেষ্টা করল, তার বাইরে বেরনোর কথা ভেবেছিলাম আমরা।
অতীব জটিল, এবং বেশ কুটিলও, ফলে প্রথমবারের পাঠশালা, যাকে আমরা ইংরেজিতে ডাকি ‘সেক্সুয়ালিটি অ্যাকাডেমি’ বলে, সেটা সাজাতে গিয়ে দেখলাম এত কিছু নিয়ে কথা বলতে হলে গোটা সপ্তাহ কেটে যাবে, তাতেও হবে না, কারণ আমরা আবার সিনেমা দেখানোরও ব্যবস্থা রেখেছিলাম, যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খানিক কথা বললে বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হতে পারে। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল।
১. এই পাঠশালা কাদের জন্য, ২. (যেটা আগেই ঠিক করে ফেলা হয়েছে) পাঠশালার পাঠ দেওয়া হবে বাংলায়, এবং আলোচনা ও আড্ডাও যতদূর সম্ভব বাংলায় করা হবে। এটা আগে থেকে ঠিক করে রাখার অন্যতম কারণ হল আমরা ২০১৩-র অনেক আগে থেকেই কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জেলার ‘বাংলা মিডিয়াম’ কলেজে ছোট ছোট করে যৌনতা বিষয়ক আলোচনাচক্র চালাতে গিয়ে দেখছিলাম যে বাংলায় এই ধরনের আলোচনা হয় না। যারা যেটুকু জানে বা পড়ে, বা বোঝার চেষ্টা করে, সবটাই ঘটে ইংরেজিতে। ফলে একধরনের ভাষাভিত্তিক-সাংস্কৃতিক-শহুরে ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলে যৌনতা চর্চা চালানো মুশকিল। ৩. পাঠশালায় কী কী নিয়ে আলোচনা হবে, কারণ যে জ্ঞানের বিপুল বেসাতি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সবটা একবারে নামানো যাবে না। ৪. বাংলাভাষী বক্তা ও চিন্তক চাই, যাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও অ্যাক্টিভিস্ট দু’রকম চেতনাই থাকবে! এবং শেষ কথা এই পাঠশালা আবাসিক, অর্থাৎ রেসিডেন্সিয়াল, (গুরু নেই, তার গৃহটুকু থাক), ও যারা আসবে তাদের কোনও রকম খরচ করতে হবে না, রেজিস্ট্রেশন ফি বলেও কিছু রাখা হবে না, টাকা যা লাগবে আমরাই জোগাড় করব।
২০১৩-র প্রথম পাঠশালায় এনজিও কর্মীরাই এগিয়ে এসেছিলেন, কিছু পরিচিত সংগঠন, কিছু অপরিচিতও। এটা দেখে ভালো লেগেছিল যে নারী আন্দোলনের অংশীদার বেশ কিছু সংগঠন, যারা নিজেরা নানা ধরনের নারী অধিকারের স্বপক্ষে কাজ করে ও নারীর প্রতি সহিংস্রতার বিপক্ষেও কাজ করে, তারা মনে করেছিল যৌনতা বস্তুটা ভালো করে না বুঝলে নারীর প্রতি ঘটা সমস্ত ধরনের সহিংস্রতা ও নারীর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের অধিকারের সামগ্রিক ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। যৌনতাকে এইভাবেই নারীর কামনার অধিকারের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল, এবং ওই প্রথমবারের পাঠশালায় যেহেতু সমাজকর্মীরাই ছিলেন বেশি মাত্রায়, তাই সেশনগুলোর চেহারাও অনেকটাই ওয়ার্কশপধর্মী হয়েছিল। এখন যা পার্টিসিপেটরি লেকচার মোডে হয়। বিশেষত আমার মনে পড়ছে প্রথবারের বডি ম্যাপিং-এর একটা সেশনের কথা, যেখানে ফেসিলিটেটর ও অংশগ্রহণকারী সকলেই তাঁদের নিজেদের শরীরের আউট লাইনের মধ্যে বসে বসে হাউহাউ করে কাঁদছেন, শুধু শরীরের যন্ত্রণার কথা ভেবে নয়, আনন্দের কথা ভেবেও।
২০১৩ থেকে আজ ২০২৫, আমরা ত্রয়োদশ পাঠশালা শেষ করে ফিরেছি গত রবিবার, অর্থাৎ ৯ তারিখে। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ এরকম নানা ধরনের প্রোগ্রাম শুরু করেছে বিভিন্ন সময়ে, হাত গুনতিতে হয়তো প্রথম, যেমন ক্যুয়ার কার্নিভ্যাল, যেমন ক্যুয়ার কনফারেন্স, আবার একটা সময়ের পর যখন দেখেছে যে এই ধরনের প্রোগ্রাম আরও অনেক হচ্ছে, অনেকেই করছে, বরং সেই রিসোর্স অন্য জায়গায় ব্যবহার করলে আরেকটা কাজ ভালো ভাবে হতে পারে, তখন কার্নিভ্যাল বা কনফারেন্সের মতো ‘শো কেস’ (অর্থাৎ, লোকের চোখে যা চট করে পড়ে, খ্যাতি বাড়ে) প্রোগ্রামও বন্ধ করে দিয়েছে অনায়াসে। কিন্তু যৌনতার পাঠশালার কথা আলাদা; যেদিন শুরু হয়েছিল সেদিনের হিসাব অনুযায়ী আমাদের যা সামর্থ ছিল সেই মতো আমরা আয়োজন করেছিলাম, বাংলাভাষী হলেও কলকাতার বাইরে থাকা রিসোর্স পার্সনদের আনা সম্ভব হয়নি, শুরুর দিকে, পরে যা সম্ভব হয়েছে। সে সময় আমাদের মনে হত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবারের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেশন চালিয়ে, সিনেমা দেখিয়ে, যতদূর সম্ভব ভাবনার খোরাক ভরে দিই। একসময় তো বুধবার থেকে রবিবার অবধি পাঠশালা চলত, তারপর হা-ক্লান্ত হয়ে বাসের মধ্যে একসঙ্গে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম। এবার আবার বৃহস্পতির কোটায় ফিরে গেছি, পার্টিসিপ্যান্টদের ফিডব্যাক অনুসারে ভার কমানো হয়েছে একটু।
২০১৪ থেকে ধীরে ধীরে ছাত্রী-ছাত্র সম্প্রদায় আসতে শুরু করে এই পাঠশালায়। এদের মধ্যে অনেকেই আমাদের কলেজ-প্রোগ্রাম ‘টুগেদার উই আর’-এর অংশ ছিল। কলেজ প্রোগ্রামে সব মিলিয়ে চার ঘণ্টার মতো কথোপকথনের সুযোগ হত, কিন্তু ওরা আরও জানতে চাইত। তবে ওরা চাইলেই তো হবে না, সবার বয়স আঠারোর বেশি হলেও আসলে সকলেরই, বিশেষত নারীচিহ্নিত দেহের মানুষের প্রাপ্তমনস্কতার বয়স নির্দিষ্ট হয় অভিভাবকের অনুমতি-সাপেক্ষে। এইসব কলেজের অনেক জায়গায় আমাদের ব্যানারে যৌনতা কথাটা না লিখতে অনুরোধ করা হত, শুধু লিঙ্গ, লিঙ্গ বৈষম্য, লিঙ্গ ভিত্তিক হিংসা– এইসব জলচল শব্দ লিখতে বলা হত। সুতরাং এরকম জায়গা থেকে বাচ্চারা (?) যৌনতার পাঠশালায় যেতে চাইলে তার অভিঘাত কেমন হবে, তায় আবার পাঁচ/ছ’দিন ধরে বাড়ির বাইরে, অভিভাবকহীন হয়ে থাকবে তারা কী ভাবে? তবে বাচ্চা(?)গুলো কিন্তু চ্যাম্পিয়ান, ঠিক ম্যানেজ করে নিত, দলে দলে চলে আসত প্রতি বছর। এক সময় তো বুঝলাম, কোনও একটি কলেজের আগের ব্যাচ পরের ব্যাচকে বোঝাচ্ছে যে যৌনতার পাঠশালাটা বলতে গেলে কারিকুলামেরই অংশ, বিশেষ করে সাইকোলজি, সোশিওলজি, উইমেন্স স্টাডি এসব নিয়ে যারা পড়ছে। এদের অনেকেই এখন স্যাফোর সঙ্গে কাজ করে, ভলান্টিয়ার করে, যারা এখন কলেজে পড়াচ্ছে, তারা তাদের স্টুডেন্টদের পাঠায়।
এক বছর, ২০১৫ সালে, এল শুধু বাংলাদেশ, মানে বাংলাদেশ থেকে আগেও দু’-চারজন করে আসত, ফেসবুকে ইস্তেহার দেখে, বা বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে। কিন্তু সে বছর দেখি শুধুই বাংলাদেশি। আমরা সাধারণত জনা পঁচিশেক মানুষকে জায়গা দিতে পারি, বিশেষ বাছাবাছিও করি না, মোটামুটি সে কেন পাঠশালায় যোগ দিতে চায়, আর বাংলা ভাষা বুঝতে, বলতে, পড়তে পারলে তাকে নেওয়া হয়। ওই লেটার অফ ইন্টেনন্টটাই জরুরি। সেবারে আমরা এ বাংলার কাউকে জায়গাই দিতে পারলাম না, এবং রিসোর্স পার্সনদের বোঝাতে হল যে আলোচনাগুলো যেন অনেক বেশি সাউথ এশিয়া ও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক হয়। এইভাবে একদলকে জায়গা দিতে গিয়ে আরেক দলকে বঞ্চিত করা ঠিক কাজ হয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু এরপর এই বাংলাদেশি আন্দোলনকারী বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড়তর হয়, তাঁরা যে তাঁদের দেশে, তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে যৌনতা বিষয়টাকে নিয়ে কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন তাতে আমাদেরও বুক ফুলে ওঠে।
যেসব জায়গায় আমরা যৌনতার পাঠশালা করতে গেছি সেগুলো সবই কলকাতার কাছাকাছি ‘রিসোর্ট’ বলে চিহ্নিত টাইপস জায়গা। যেবার যেমন টাকা জোগাড় করতে পারি সেবার তেমন মানের হয়, কিন্তু মানুষের মান তো ফান্ডের ওপর নির্ভর করে না, তাই দামি বা কমদামি যেমন জায়গাই হোক না কেন, যৌনতার পাঠশালা লেখা ব্যানার ও স্ট্যান্ডি দেখলে ফুর্তিবাজ মানুষেরা আরেকটু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বিশেষত পুংচিহ্নিত শরীরের দল হলে। এটা বেশ কয়েতবার ঘটেছে, নানা ধরনের ইঙ্গিত, হাসি, ফিসফাস উচ্চারণ লেগেই থাকে। বিশেষ করে ২০১৮-য় ৩৭৭ চলে যাওয়ার পরে আমাদের দলের মানুষরাও অনেকেই একটু সাহসী পোশাক পরেন, নিজেদের লিঙ্গানুভূতি একটু সোচ্চারে প্রকাশ করার ঝুঁকি নেন, সেটা ফূর্তিকামী জনতার ভালো লাগে না। সেবারে দক্ষিণবঙ্গের এক নদীর ধারের রিসোর্টে এমনি একটা ঘটনা একটু বেশি টান-টান হয়ে পড়েছিল, মাঝরাত, ভিড় জমেছে মাঠের মাঝখানে, উত্তর-প্রত্যুত্তর চলছে, কোনটা বিকৃতি, কতটা অন্যায়, কীসের অধিকার, কাকে বলে স্বেচ্ছাচার, সেই পুরনো গপ্প। এর মাঝখানে উঠে এলেন আমাদের এক অতি ঠান্ডা মাথার মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, তারপর ইতিহাস। গোটা রাত আমরা সবাই বসে বসে যুযুধান দুই দলের মধ্যে সেক্স-জেন্ডার-সেক্সুয়ালিটি থেকে শুরু করে, পিতৃতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদ, নারীত্ব ও পুরুষত্বের জটিল জটাজাল খুলে সব সেশনই নিয়ে ফেলেছিলাম। এও ঘটেছিল। আর এবারের পাঠশালায়, চা দিতে আসা ছেলেটি একটু লজ্জিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল– এই বইগুলো (স্যাফোর প্রকাশনা) আমি একটু দেখতে পারি দিদি? ওকে আর বলিনি যে আমি নিজেকে ‘দিদি’ হিসাবে আইডেন্টিফাই করি না, বইগুলো ওর বাড়ানো হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
মাত্রই ১৩ বার, যৌনতার পাঠশালা আরও অনেক দিন চলবে, চলতে হবে আমাদের।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….