সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পর কলেজেরই এক ছাত্র তথা মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিক দিনের পর দিন তাঁকে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য উত্যক্ত করতে থাকে। সঙ্গে চলে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে তোলা কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাবলিক করে দেওয়ার থ্রেট। এই চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনের মুখেও কিন্তু ভেঙে পড়েন না প্রকৃতি। সমস্যার বিবরণ-সহ অভিযোগ দায়ের করেন ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অফিসে। তাও একবার নয়; পরপর দু’বার। কিন্তু আমেরিকার এবিএম কোম্পানির মতো, কিট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এই সমস্যা সমাধানে কোনও ব্যবস্থাই নেয় না। একদিকে নিরন্তর নির্যাতন আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা। স্বজন, স্বদেশ থেকে দূরে থাকা মাত্র ২০ বছরের নেপালি মেয়েটি একসময় আশা হারিয়ে ফেলে। আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সান ফ্রান্সিস্কোর সবথেকে ঝাঁ-চকচকে অফিসবাড়ি ‘ফেরি বিল্ডিং’-এ কাজ করত মারিয়া বোহরেকজ। পরিচারিকার কাজ; নাইট শিফট। অফিস ঝাড়পোঁছ, ধোয়ামোছার মতো কাজগুলো এদেশে নাইট শিফটেই হয় বেশি; করে মূলত বোহরেকজের মতো অভিবাসী মেয়েরাই।
তা সে-রাতে ঘটনাটা ঘটল এরকম…
‘ফ্লোরে আমি একাই ছিলাম। ঝাড়পোঁছ করছিলাম। খেয়াল করিনি উনি, মানে সুপারভাইজার কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওর আচার-আচরণ কোনও দিনই আমার বিশেষ সুবিধার ঠেকেনি। অশ্লীলভাবে উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতেই বললাম,
–আমি কিন্তু কমপ্লেন করব স্যর…
–হাঃ, কেউ তোমার কথা শুনবে বলে মনে হয়?
এরপরেই খুব জোর একটা আচমকা ধাক্কায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। অতর্কিত এই আঘাতটা সামলে ওঠার আগেই যা ঘটার তা ঘটে গেল…
অভিযোগ করার কথা ভাবিনি, তা নয়। কিন্তু দুটো বিষয় আমায় আটকে দিয়েছিল।
১. আমার মতো একজন অভিবাসী পরিচারিকার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
২. চাকরিটা যাবে, আর সেটা হলে আমি খেতে পাব না।
‘রেপ অন দ্য নাইট শিফট’ তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায় ২০১৫ সালে। ফ্রন্টলাইন চ্যানেল, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে, ইউনিভিশন ও সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং-এর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি আমেরিকার নাইট শিফটে কর্মরত অভিবাসী মহিলা সাফাইকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার বিবরণী। দস্তুরমতো গবেষণা ও নানা প্রতিবেদন ও তথ্যপ্রমাণকে ভিত্তি করে নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি যেন সুতোয় বোনা সামাজিক অবক্ষয়ের মালা। যা মনে করিয়ে দেয় “মারফি’জ ল”– খারাপ জিনিস প্রতিরোধে যদি সময়মতো ব্যবস্থা না-নেওয়া হয়, তাহলে কোনও বিষয় যতটা বেশি খারাপ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই খারাপ হবে।
‘রেপ অন দ্য নাইট শিফট’– তথ্যচিত্রটিতেও আমরা তাই দেখতে পাই। মারিয়া মাগানা কাজ করতেন আমেরিকার সবথেকে বড় সাফাইকর্মী সরবরাহকারী সংস্থা এবিএম-এ। কোম্পানির সুপারভাইজার মিস্টার ভাসকেজের শারীরিক নির্যাতনের হাত থেকে নিস্তার পেতেন না মহিলা কর্মচারীরা। বিশেষ করে গ্রুপ-ডি স্তরের কর্মীরা, যাদের চাকরির নিশ্চয়তা কম, পেটের দায়ে যারা মুখ খুলবেন না সহজে; তারাই দিনের পর দিন ভাসকেজের সফট টার্গেট হয়ে উঠেছিলেন।
…………………………………..
যেমনটা ঘটল ক’দিন আগে ভুবনেশ্বরের কিট বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের বি. টেক ছাত্রী প্রকৃতি লামসালের সঙ্গে। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরেও ওই কলেজেরই এক ছাত্র তথা মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিক দিনের পর দিন তাঁকে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য উত্যক্ত করতে থাকে। সঙ্গে চলে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে তোলা কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাবলিক করে দেওয়ার থ্রেট। এই চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনের মুখেও কিন্তু ভেঙে পড়েন না প্রকৃতি।
…………………………………..
–‘তা দিনের পর দিন একটা লোক এতজন মহিলাকে নির্যাতন করত, কেউ টের পেল না?’ প্রশ্ন করেন তথ্যচিত্রের সঞ্চালক বার্গম্যান।
–“হ্যাঁ পেয়েছিল। কোম্পানির নামে ৪০টি ল্য স্যুট হয়েছিল। মিস্টার ভাসকেজের বিরুদ্ধেও কোম্পানিতে চিঠি জমা করেছিল কোনও এক নির্যাতিতা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপই নেয়নি।’ একনাগাড়ে বলে খানিকটা থামেন আমেরিকার ইকুয়াল এমপ্লয়মেন্ট অপারচুনিটি কমিশনের অ্যাটর্নি অ্যানা পার্ক।
–‘কোনও পদক্ষেপ নেয়নি?’
–‘না। অথচ সামান্য একটু ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলেই দেখা যেত যে মিস্টার ভাসকেজ আসলে একজন জেল খাটা দাগী আসামি। চাকরিতে ঢোকার আগে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তিনি জেল খেটেছিলেন। এমন একজন দাগী অভিযুক্তের রিপিট অফেন্স কেসেই যদি আমেরিকার সবথেকে বড় সাফাইকর্মী সরবরাহকারী সংস্থা কোনও ব্যবস্থা নিতে না-পারে, তাহলে নির্যাতিতারা অভিযোগ করবেন কোন ভরসায়?’
ঠিকই। অপরাধের শাস্তির নিশ্চয়তা না-থাকার অর্থ অপরাধকে ‘অপরাধ’ বলতে অস্বীকার করা। আর অভিযোগ করলেও দোষী যে মোটের ওপর ঠিক পার পেয়ে যাবে, সে-কথা হাড়ে হাড়ে জানে বিশ্বজুড়ে নাইট শিফটে কাজ করা বা ঘর ছেড়ে দূরে থেকে চাকরি করা, পড়াশুনা করা মেয়েরা। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে, ইউরোপ-আমেরিকা-রাশিয়া-উগান্ডা-চিন কিংবা ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে এই নির্যাতন আর অনিরাপত্তার জায়গাটিতে সব মেয়েই মিলে যায় এক বিন্দুতে।
যেমনটা ঘটল ক’দিন আগে ভুবনেশ্বরের কিট বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের বি. টেক ছাত্রী প্রকৃতি লামসালের সঙ্গে। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরেও ওই কলেজেরই এক ছাত্র তথা মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিক দিনের পর দিন তাঁকে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য উত্যক্ত করতে থাকে। সঙ্গে চলে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে তোলা কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাবলিক করে দেওয়ার থ্রেট। এই চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনের মুখেও কিন্তু ভেঙে পড়েন না প্রকৃতি। সমস্যার বিবরণ-সহ অভিযোগ দায়ের করেন ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অফিসে। তাও একবার নয়; পরপর দু’বার। কিন্তু আমেরিকার এবিএম কোম্পানির মতো, কিট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এই সমস্যা সমাধানে কোনও ব্যবস্থাই নেয় না। একদিকে নিরন্তর নির্যাতন আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা। স্বজন, স্বদেশ থেকে দূরে থাকা মাত্র ২০ বছরের নেপালি মেয়েটি একসময় আশা হারিয়ে ফেলে। আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
অথচ এই মৃত্যু প্রতিরোধের পথটি কি অতি সহজ ছিল না? সহমর্মিতার প্রয়োজন নেই, ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অফিস যদি শুধু তাদের ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করত; যদি অন্তত একবার অভিযুক্ত ছেলেটিকে ডেকে পাঠিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত, তাকে শাসন করত কিংবা কাউন্সেলিং, তাহলেই কি অনেকখানি উপকার হত না? বিশেষ করে অভিযুক্ত ছেলেটি যখন ওই একই কলেজের ছাত্র, তখন কি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কাজটা নিতান্ত মামুলি ছিল না? ছেলেটি যদি তাতে না-ও শুধরোত, বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা একা মেয়েটির মনোবল তো তাতে বাড়ত। সে তো মনে করতে পারত যে, তাঁর অভিযোগগুলো নিয়ে তাঁর মতো তাঁর কলেজও চিন্তিত। বিশ্বাস করতে পারত যে, এ-পরবাসেও তাঁর জন্যে কেউ অন্তত আছে, যার জন্য লড়াইটা আরও একটুখানি টিকিয়ে রাখাই যায়?
এইটুকুখানি; মেয়েদের নিরাপত্তার তাগিদে এইটুকু পদক্ষেপও আমরা কোথাও করে উঠতে পারছি না। মণিপুর থেকে ইম্ফলে নার্সিং পড়তে আসা মেয়েদের তাই হোস্টেলের ঘর থেকে বের করে এনে নির্যাতন করা হলে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ কিছু করতে পারে না। কলকাতার মেডিকেল কলেজের কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তার অন-ডিউটি ধর্ষিত হয়ে খুন হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছু করতে পারে না। পানাগড়ের কাছে ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর ইভটিজিং-এর হাত থেকে বাঁচতে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে পালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে তরুণী মারা গেলে পুলিশ কিছু করতে পারে না। মুম্বইয়ের প্রকাশ্য রাস্তায় কোরিয়ান ইউটিউবারকে বাইকারোহী তরুণের দল শারীরিক নিগ্রহ করলে ট্রাফিক সার্জেন কিছু করতে পারে না।
দক্ষিণ দিল্লির যে মুনিরকা অঞ্চলে ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ড ঘটেছিল, ঠিক সেই জায়গাটিকেই ২০২৩ সালের এক রাতে পরীক্ষামূলকভাবে ‘রি-ভিজিট’ করেন সাংবাদিক তেজশ্রী পুরন্দার। ক্যামেরা নিয়ে তাঁর দল দাঁড়িয়ে থাকে অনতিদূরে। নির্ভয়ার মতোই তিনিও এসে দাঁড়ান বাসস্ট্যান্ডেই। একা। রাত ১২টা থেকে ১২:৩০; গাড়িতে, বাইকে, অটোয় কিংবা হেঁটে- মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে ২০ জন লোক তাঁর দিকে এগিয়ে আসে ও নানা কুপ্রস্তাব দেয়। তেজশ্রী বলেন, ‘সেইসময় কিন্তু অনতিদূরেই পুলিশের পেট্রোলিং ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল।’
এসব দেখলে, শুনলে জর্জ ওরওয়েলের উপন্যাস ১৯৮৪ -র কথা মনে পড়ে। এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র তার হার্মাদবাহিনীকে দিয়ে প্রচার চালাত, ‘ইগ্নোরেন্স ইজ ব্লিস’– অজ্ঞতাই আনন্দ। চারপাশে যত যাই হয়ে যাক না কেন, তা সমন্ধে না-জানা, না-প্রশ্ন করাই হল আনন্দিত জীবনের শর্ত।
মেয়েদের সুরক্ষা আর নিরাপত্তার প্রশ্নে এই ডিস্টোপিয়ান নভেলটিই যে একদিন রিয়েলিটি হয়ে উঠবে, স্বয়ং ওরওয়েল-ও কি তা জানতেন?
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved