Robbar

বিয়ে ও লিভ-ইন, হিংসা যখন দু’ক্ষেত্রেই, তখন শুধু লিভ-ইনে আপত্তি আসলে পিতৃতান্ত্রিক চোখরাঙানি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 24, 2025 3:42 pm
  • Updated:October 24, 2025 3:43 pm  

ভারতে সহবাস সম্পর্ক বা ‘লিভ-ইন’-কে ঘিরে সামাজিক ট্যাবু ও আইনি অনিশ্চয়তা আসলে এক বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। এই কাঠামোয় বিয়ে শুধু দু’জন ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গড়ে তোলা সম্পর্ক নয়, বরং লিঙ্গ, জাতি ও শ্রেণিভিত্তিক এক সামাজিক চুক্তি, যেখানে নারীর শরীর জাতির পবিত্রতা ও উত্তরাধিকার রক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে সমাজে, এমনকী আইনের চোখেও একমাত্র বৈধ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হিসেবে স্বীকৃতি পায় স্বজাতির মধ্যে এবং নারী-পুরুষের বিয়ে। সমাজ ও আইন স্বীকৃত বিয়ের এই মডেল আসলে পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মতো নীপিড়নমূলক দু’টি ভাবধারার আঁতাতের মূল ভিত্তি, যেখানে নারীদের গৃহ ও যত্নের অবৈতনিক শ্রমে বেঁধে রাখা হয় আর সেই অদৃশ্য শ্রম থেকেই পুঁজিবাদ নিজের মুনাফা তোলে।

সম্প্রীতি মুখার্জি

উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেল সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে ছাত্রীদের লিভ-ইন অর্থাৎ সহবাসের সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। সতর্কবার্তা হিসেবে মনে করিয়েছেন সহবাসে বাঁচা মেয়েদের শরীর ৫০ টুকরোয় ছিন্নভিন্ন হয়ে পাওয়ার কথা। খবরে প্রকাশ, আনন্দীবেন অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা হিংসা নিয়ে চিন্তা দেখাতে গিয়ে এ মন্তব্য করেছেন এবং মেয়েদের সহবাসের সম্পর্কে থাকা যে তাঁকে ভাবায় এমনকী, ব্যথিতও করে– একথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে এসে আনন্দীবেন সহবাসের সম্পর্কে মেয়েদের অংশ নেওয়া নিয়ে উদ্বেগ জাহির করলেন। রাজ্যপালের পদাধিকার বলে তিনি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপাচার্যও বটে। এই মন্তব্যের দিনদুয়েক আগে অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন অনাথ আশ্রমগুলিতে গেলে নাকি লিভ-ইন সম্পর্কের পরিণতি দেখা যায়! আনন্দীবেনের মতো করে ভাবেন আমাদের চারপাশে অনেকেই। এমনকী, বিচারব্যবস্থা ও সংসদের প্রতিনিধিদের মধ্যেও এই মানসিকতার ছাপ আমরা দেখি।

জাতীয় অপরাধ সূচির তথ্য বলছে, ভারতে মেয়েদের ওপর হিংসার সবচেয়ে বেশি ঘটনাই গৃহহিংসা এবং তথাকথিত বিয়ের সম্পর্কের মধ্যে হয়ে থাকে। বেশিদিন আগে নয়, এ বছরের আগস্ট মাসেই হায়দরাবাদের বাসিন্দা মহেন্দর রেড্ডি নিজের ‘স্ত্রী’-কে মুসী নদীর জলে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দিয়েছিল। ওই একই মাসে নয়ডায় ২৮ বছরের নিক্কি ভাটিকে তাঁর ‘স্বামী’ ও শ্বশুরবাড়ির মানুষজন পণের জন্য জ্যান্ত জ্বালিয়ে মেরে দিয়েছিল। এই তালিকা অন্তহীন। সহবাসের সম্পর্কে থাকা একজন পুরুষসঙ্গীর, মহিলাসঙ্গীকে নিঠুরতমভাবে হত্যা করা যদি লিভ-ইন সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ তৈরির কারণ হয়, তাহলে বিয়ে নিয়ে তো জনমানসে ত্রাস ছড়িয়ে পড়ার কথা! সহবাসের সম্পর্ককে ঘিরে এই দ্বিচারিতার মানসিকতা কেন?

 

This may contain: a drawing of a woman sitting on the ground with her arms crossed and hands painted red
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

আনন্দীবেনের মতো যাঁরা ভাবেন, তাঁরা কি আদৌ মেয়েদের ৫০ খণ্ডে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্য চিন্তিত, নাকি চিন্তিত ছিন্নভিন্ন শরীরের মালিকানা নিয়ে? ওই শরীরে চাপিয়ে দেওয়া সম্মান হারানোর ভয় নিয়ে? যদি প্রাথমিক চিন্তা মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে হয়, তবে বিয়ের সম্পর্কে যৌনহিংসা এখনও অপরাধ নয় কেন ভারতে? তথ্য অন্য কথা বললেও কেন সহবাসের সম্পর্ক নিয়ে এত আতঙ্ক আমাদের মধ্যে? এই পৃথিবীতে পুরুষের সঙ্গে এমন কোনও সম্পর্ক আছে, যেখানে মেয়েরা হিংসার শিকার হয়নি? এমন কোনও প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত? মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা দেখানোর নামে বারবার মেয়েদের পায় শিকল পরানোর জন্য উদগ্রীব কেন প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থা থেকে সমাজ?

ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

 

ভারতে সহবাস সম্পর্ক বা ‘লিভ-ইন’-কে ঘিরে সামাজিক ট্যাবু ও আইনি অনিশ্চয়তা আসলে এক বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। এই কাঠামোয় বিয়ে শুধু দু’জন ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গড়ে তোলা সম্পর্ক নয়, বরং লিঙ্গ, জাতি ও শ্রেণিভিত্তিক এক সামাজিক চুক্তি, যেখানে নারীর শরীর জাতির পবিত্রতা ও উত্তরাধিকার রক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে সমাজে, এমনকী আইনের চোখেও একমাত্র বৈধ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হিসেবে স্বীকৃতি পায় স্বজাতির মধ্যে এবং নারী-পুরুষের বিয়ে। সমাজ ও আইন স্বীকৃত বিয়ের এই মডেল আসলে পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মতো নিপীড়নমূলক দু’টি ভাবধারার আঁতাঁতের মূল ভিত্তি, যেখানে নারীদের গৃহ ও যত্নের অবৈতনিক শ্রমে বেঁধে রাখা হয় আর সেই অদৃশ্য শ্রম থেকেই পুঁজিবাদ নিজের মুনাফা তোলে।

This may contain: a drawing of a woman hugging another woman's head in a glass box with blue border
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সহবাস সম্পর্ক বিয়ের সমাজস্বীকৃত মডেলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। কারণ এখানে সম্পর্ক শুরু বা শেষ হয় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে। সহবাসের সম্পর্ক নিজের শরীর ও জীবনের বিষয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে জায়গা দেয়। এই স্বাধীনতা পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদ, উভয়ের স্বার্থে আঘাত হানে, কারণ এটি নারীর বিনামূল্যের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল পারিবারিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে নাড়িয়ে দেয়। তাই আনন্দীবেন প্যাটেল যখন যৌন-হিংসার আশঙ্কা দেখিয়ে নারীদের ‘সতর্ক’ করতে চান, তিনি এক পরিচিত পিতৃতান্ত্রিক কৌশলের আশ্রয় নেন, যার মূল উদ্দেশ্য ভয় দেখিয়ে ‘লক্ষ্মণরেখা’ টেনে দেওয়ার মাধ্যমে নারীর চলাফেরা, সম্পর্ক ও শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। সহবাসের সম্পর্ক সমাজের নৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেয় বটে কিন্ত আইনি থেকে সামাজিক পরিসরের নকশা এই ‘লিভ-ইন’-কে ঝুঁকিপূর্ণ ও কোণঠাসা করে রাখে।

This may contain: a black and white drawing of a woman in a house
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার, নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে অন্তরঙ্গতা ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে আইন আশ্রয় হতে পারত। কিন্তু ভারতের বিচারব্যবস্থা এখনও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের টানাপোড়েনে আটকে আছে। ২০০৫ সালের গার্হস্থ্য হিংসা থেকে নারীদের সুরক্ষা আইন (PWDV Act) এবং উত্তরাখণ্ডে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (UCC),  উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, লিভ-ইন বা সহবাসের সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই স্বীকৃতি বিসমকামী বিয়ের মোড়কে সেজে থাকার শর্তে আবদ্ধ।

This may contain: a drawing of a woman wrapped up in a black blanket with her back turned to the camera
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

গার্হস্থ্য হিংসা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি, PWDV Act, 2005-এর ২(এফ) ধারা অনুযায়ী ‘গার্হস্থ্য সম্পর্ক’ বলতে বোঝানো হয়েছে রক্তসম্পর্ক, বিবাহ বা ‘বিবাহ-সদৃশ সম্পর্ক’-এর মধ্যে সহবাস। ডি. ভেলুসামি বনাম ডি. প্যাচাইম্মাল (২০১০) মামলা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা মহিলাদের ভরণপোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সময় ‘বিবাহ-সদৃশ’ সম্পর্কের আইনি সংজ্ঞা হিসেবে এমন সম্পর্ককে বোঝায়, যেখানে সমাজে স্বীকৃত বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন বাধ্যতামূলক যেমন, দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা, যৌন সম্পর্ক, আর্থিক ভাগবাঁটোয়ারা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি থাকা আবশ্যক। ফলে, আইনের সুরক্ষা পেতে হলে সহবাসকারী ব্যক্তিদের প্রথাগত বৈবাহিক সম্পর্কের রীতি-নীতিতে নিজেদের প্রকাশ করতে হবে।

This may contain: a painting of a man in red and white
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবরের সুপ্রিয় চক্রবর্তী বনাম ভারত সরকার মামলার রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গের বিবাহের সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করে তবে সমলিঙ্গের যুগলদের একসঙ্গে বসবাস করার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। পাশাপাশি, সমলিঙ্গের বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি সংসদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে বলে জানায় সর্বোচ্চ আদালত।

ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সমলিঙ্গ বা ক্যুয়ার সম্পর্কে সহবাস আইনিভাবে স্বীকৃত হলেও তার বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ, বিশেষ করে উত্তরাধিকার, স্বাস্থ্যবিমা বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পরিসরে হিংসা থেকে সুরক্ষার অধিকার অস্বীকৃত। একইভাবে, সামাজিক বিরোধিতা ও পুলিশি নজরদারির কারণে আন্তঃজাতি বা আন্তঃধর্ম সহবাসের ক্ষেত্রেও বিয়ের মত থাকার প্রমাণ দেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এভাবে, রাষ্ট্র আইনের আড়ালে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে নৈতিকতার ছাঁচে বন্দি করে মনুবাদী পিতৃতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য সুবিধা করে দেয়।

ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরাখণ্ডে লাগু হওয়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এক ধাপ এগিয়ে ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কের অপরাধীকরণকে আইনি শিলমোহর দিয়ে দিয়েছে। নারী অধিকারকর্মী, মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও উত্তরাখণ্ডের সরকার এটি পাশ করে এবং এখন মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশও একই পথে হাঁটছে। এই আইনটির অধ্যায় ১৪ (ধারা ৩৭৮–৩৯০) স্পষ্ট করে দেয়, এটি নারী-স্বাধীনতা নয়, বরং ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিসরে রাষ্ট্রের নজরদারি আর দখলদারির ভয়ানক রূপ।

This may contain: an image of people with their hands on each other's shoulders and the word no to racism
ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এই আইনটি যে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছে, তারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, লিভ-ইন সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতি না থাকায় এই সম্পর্কের মানুষরা ‘আইন ভঙ্গ করলেও নজর এড়িয়ে যান’, তাই এসব সম্পর্কের একটি রেকর্ড রাখা প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিবেদনে কোথাও বলা হয়নি, এহেন মানুষরা সহবাসের মাধ্যমে কোনও আইন লঙ্ঘন করছেন। সুপ্রিম কোর্ট এস. খুশবু বনাম কান্নিয়াম্মাল (২০১০) মামলায় স্পষ্ট করেছে– লিভ-ইন সম্পর্ক কোনও অপরাধ নয়, এবং আইনের পরিপন্থীও নয়। তবু ইউসিসি-র ধারা ৩৮১-৩৮৭ অনুযায়ী, প্রত্যেক লিভ-ইন সম্পর্ককে এক মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রারের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে; তা না করলে তিন থেকে ছয় মাসের জেল বা দশ হাজার থেকে পঁচিশ হাজার টাকার জরিমানার শাস্তি নির্ধারিত। নিবন্ধনের সময় সহবাসের সঙ্গীদের আধার, বয়স, যৌথ বাসস্থান, বিগত সম্পর্কের তথ্য, মহিলা সঙ্গী গর্ভবতী কি না তার তথ্য এবং একত্রে থাকার প্রমাণ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক, যে তথ্যগুলি স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়।  জমা দেওয়া কোনও তথ্য রেজিস্ট্রার বা পুলিশের ভুল বা অসম্পূর্ণ মনে হলে, তারা সহবাসকারী যুগলের নিবন্ধন বাতিল করা থেকে শুরু করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। ভারতে যুগলরা স্বীকৃতভাবে বিয়ে করলেও তাদের একত্রে থাকার প্রমাণ, আগের সম্পর্কের তথ্য বা মহিলার মাতৃত্বসংক্রান্ত তথ্য দিতে হয় না; কিন্তু সহবাসের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ধরনের রক্ষণশীল নিয়ম শুধু পারিবারিক ও সামাজিক হস্তক্ষেপকে আইনি বৈধতা দিল তা নয়, তাদের অপরাধীকরণের পথও আরও সহজ করে দিল। বিশেষ করে আন্তঃজাতি বা আন্তঃধর্ম সহবাসের ক্ষেত্রে ইউসিসি একপ্রকার রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নীতি-পুলিশিকে আইনি অনুমোদন দিল। ইউসিসি-র মতো আইন সারা দেশে লাগু হলে এই ধরনের যুগলদের ওপর পরিবার ও জাতির সম্মান রক্ষার নামে হিংসার শিকার হলেও তারা পুলিশ ও আইনের কাছে আশ্রয় চাইতে পারবেন না। কারণ এক্ষেত্রে পুলিশকেই আইনি পথে তাদের ভক্ষক বানানো হয়েছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, ইউসিসি-তে বর্ণিত ‘নিষিদ্ধ সম্পর্ক’-র আওতাভুক্ত যুগলদের ধর্মীয় বা সামাজিক নেতার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে– অর্থাৎ, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বৈধতা শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। অন্যদিকে, এই আইনে সহবাসের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে কেবল ‘একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে সম্পর্ক’ হিসেবে, ফলে সমলিঙ্গ বা ক্যুয়ার দম্পতিদের সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সংজ্ঞা সুপ্রিয় বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (২০২৩) এবং ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (২০১৪)-এর মতো রায় প্রান্তিকায়িত লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষদের বহু লড়াইয়ে অর্জিত অধিকারকে খণ্ডন করে এবং তাদের জন্য আইন তৈরির সংসদীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে।

এইভাবে, ভারতের বিচারব্যবস্থা, সংসদ, প্রশাসনের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিতে যারা ক্ষমতায়, তারা মেয়েদের নিরাপত্তার কথা বলে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের স্বার্থসিদ্ধির কাজ করে, কারণ তাতে তাদের গদি আরও শক্ত হবে। ভারতে আনন্দীবেনের মতো মনুবাদী পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরা যেমন আছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিপদ ও অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনই আছে সমাজের মেকি শেকল আর আনুষ্ঠানিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে অবদমিত মেয়েদের, প্রান্তিকায়িত মানুষদের নিজের শর্তে নির্ভয় বাঁচার জন্য আকাঙ্ক্ষা ও সংহতি। ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া মরতে মরতেও বলেছিল ন্যায়বিচারের কথা; তার ন্যায়বিচারের আন্দোলন থেকে ওঠে নির্ভয় স্বাধীনতার ‘বেখউফ আজাদি’র স্লোগান, যেখানে চিৎকৃত আওয়াজ উঠেছিল– ‘শাদি করনে কি অউর না করনে কি আজাদি’, ‘প্যায়ার করনে কি আজাদি’, ‘সাথী চুননে কি আজাদি’। মেয়েদের ন্যায়বিচারের অন্তরায় মেয়েদের আজাদি নয়, বরং নিঃশর্ত নির্ভয় স্বাধীনতাই পারে মেয়েদের নিরাপত্তার পথ, মেয়েদের মানুষ হয়ে বাঁচার পরিবেশ তৈরি করতে।