ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটির রোস্টারও ভীষণরকম প্রচলিত। টানা ডিউটির ক্লান্ত শরীরে কোনও মহিলা চিকিৎসক ‘নিকটতম’ রেস্টরুম খুঁজতে পারেন, ‘নিরাপদতমে’র খোঁজ তাঁর করার কথা নয়। আর নিজের প্রতিদিনের চেনা পরিসরে কোনও জায়গা যে কোনও মানুষের কাছেই বিশ্বাসের আশ্রয়, সেখানে অ-নিরাপদ তকমা লাগারও কথা নয়। যদিও, প্রান্তিক মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত অনেক মহিলা চিকিৎসকের কথা ডাক্তারি মহলে কান পাতলে শোনা যাবে, যাঁরা পকেটে লঙ্কার গুঁড়ো রেখে ডিউটি করেন, বা কোনও পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেন।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
মধ্যরাতে চার যুবকের কলকাতা শাসনের দাবি যতখানি সোচ্চার, যুবতির হাতে সেই দাবিসনদ থাকার জো নেই। সে খাস কলকাতা হোক কি মফস্সল এলাকা। ভিড়ের উৎসব হোক কি ঘুমিয়ে পড়া নিঝুম রাত। সোশাল মিডিয়ায় দেখছিলাম সমাজের উঁচুতলায় থাকা একজন লিখছেন, দুর্গাপুজোর রাতে তাঁর কয়েকজন আত্মীয়াকে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে শুনতে হয়েছিল, ভালো ঘরের মেয়েরা রাতে বাইরে বেরয় না। ভালো ঘরের বহু-বেটির সংজ্ঞা এমনিতেই এ সমাজের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিট ফান্ড। একমাত্র যে শর্তে ‘ভালো মেয়ে’-রাও রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে পারে, তার নাম নাইট ডিউটি।
মেয়েদের জীবনে এই নাইট ডিউটির সংজ্ঞাও নানারকম। গল্প-উপন্যাসের পাতায় পাতায় পড়া যায়, অফিস শেষে ব্রিজ বা তাসের আসরে রাত ভোর করে দিচ্ছেন কোনও কোনও পুরুষ। কেউ বারে গিয়ে রাতের নেশা লাগিয়ে নিচ্ছেন দু’চোখে। তাঁদের জন্য বাড়িতে যে মা কিংবা স্ত্রী জেগে বসে আছেন খাবার আগলে, তাও একরকম নাইট ডিউটি বইকি। ছোট বাচ্চাকে সামলাতে যে মাকে দিনভর পরিশ্রমের পরও সারারাত চোখের পাতা টেনে রাখতে হচ্ছে, কারণ বাচ্চা কাঁদলে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত হবে, তিনিও নাইট ডিউটি দিচ্ছেন। প্রবাসী সন্তানের ঘড়ি মিলিয়ে কল করতে গিয়ে যে মা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকছেন, কিংবা নাইট ডিউটির মাঝে সন্তান একটু ঘুমোলে তাকে কল করে ডেকে দেওয়ার জন্য যে মা ঘুমোচ্ছেন না, তাঁরাও সক্কলে নাইট ডিউটির কর্মী। তবে আপাতত এইসব পারিবারিক ডিউটিকে সরিয়ে রেখে, বাইরের দুনিয়ার, কাজের জগতের নাইট ডিউটির বিষয়েই ফোকাস করা যাক। কেন, সে কথা আপাতত সকলেই জানি। আমরা জেনে গেছি, মেয়েদের রাতে বাইরে থাকার একমাত্র পরোয়ানাও ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছে। রাতের পথে মেয়েরা বিপন্ন আমরা জানতাম, কিন্তু নাইট ডিউটিতে কর্মক্ষেত্রের পরিসরেও যে মেয়েরা নিরাপদ নয়, সে কথা আমাদের ‘প্রায়’ জানা ছিল না।
…………………………………………………………………..
খাস শহরের যদি এই হাল নয়, গ্রাম-মফস্সলের কথা সহজেই অনুমেয়। আর দ্বিতীয় কথা হল, বাড়ি ফেরার গাড়ি যদি বা মেলে, তা কতখানি নিরাপদ? ২০২১ সালে সংসদে বাজেট অধিবেশনে যখন নির্মলা সীতারমণ জানিয়েছিলেন, সমস্ত কর্মক্ষেত্রে, প্রয়োজনে রাতের শিফটেও মহিলাদের কাজে নিতে হবে– তখন নিয়োগের কথায় খুশি হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন মেয়েরা। সেই সময়ে মিডিয়ার একাধিক বাইট কপিতে উঠে আসছিল তাঁদের উদ্বেগের কথা।
……………………………………………………………………
‘প্রায়’ জানা ছিল না বলছি এজন্যেই, কারণ যতক্ষণ না ‘বড়’ ঘটনা ঘটে, ততক্ষণ আমরা কিছু জানতে পারি না। কলকাতার অফিস থেকে বেশি রাতে মফস্সলের বাড়িতে ফিরতে গেলে রাতের ট্রেনে অস্বস্তি হয়, জানি। ফাঁকা লেডিস কামরায় একরকমের ভয় আর জেনারেল কামরায় আরও বেশি ভয় করে, জানি। রাতের স্টেশন থেকে রাতের ফাঁকা পথে একা হাঁটতে ভয় করে, তাই মা নিতে আসেন, জানি। শুধু আমি নই, এ কথা জানেন রাতের শিফটে কাজ করা অনেক মেয়েই। যেখানে রাতের ডিউটি মানে গোটা রাতভর কাজ করে সকালে ফেরা নয়, রাতের কোনও একটা সময়ে ছুটি হয়ে যাওয়া, সেখানেই বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তা মাথায় চেপে বসে মেয়েদের। সে রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটাতেও হতে পারে, আর রাত দুটো কি তিনটে হলে তো বলাই বাহুল্য। এক তো বাড়ি ফেরার জন্য যানবাহন পাওয়ার সমস্যা। কলকাতা হয়তো একদিন কল্লোলিনী হবে, তবে এখনও কলকাতায় রাতে মেট্রো চলে না, সব জায়গায় যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায় না, হলুদ ট্যাক্সি প্রায় ডোডো পাখি, বিপুল ভাড়া আর ক্যানসেল কালচারে অ্যাপ ক্যাব মেলাও দুষ্কর।
খাস শহরের যদি এই হাল হয়, গ্রাম-মফস্সলের কথা সহজেই অনুমেয়। আর দ্বিতীয় কথা হল, বাড়ি ফেরার গাড়ি যদি বা মেলে, তা কতখানি নিরাপদ? ২০২১ সালে সংসদে বাজেট অধিবেশনে যখন নির্মলা সীতারমণ জানিয়েছিলেন, সমস্ত কর্মক্ষেত্রে, প্রয়োজনে রাতের শিফটেও মহিলাদের কাজে নিতে হবে– তখন নিয়োগের কথায় খুশি হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন মেয়েরা। সেই সময়ে মিডিয়ার একাধিক বাইট কপিতে উঠে আসছিল তাঁদের উদ্বেগের কথা। অনেকেই বলছিলেন, শহরের অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থাতেই রাতের দিকে মহিলা কর্মীদের যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা নেই। ফলে রাতে বা ভোরে পুল কার বা বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়ে নানারকম হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। সত্যি বলতে, যেখানে একাধিক কর্মীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অফিসের গাড়ি বরাদ্দ, সেখানেও কোনও মেয়ে একলা হয়ে গেলে যদি অস্বস্তিতে পড়েন, কী বলার আছে তাঁকে? স্কুলবাসে হেনস্তার গল্প কি আমাদের অজানা? অফিসের গাড়ি হয়তো অ্যাপ ক্যাবের তুলনায় আরেকটু নিরাপদ মনে হতে পারে, তবে সেখানেও চালকের অস্বস্তিকর চাহনির কথা আড়ালে আবডালে বলেন কেউ কেউ। হ্যাঁ, সেসব হয়তো ‘বড়’ ঘটনা নয়। তাই গায়ে ওড়নাটা একটু ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, বুকের কাছে ব্যাগ তুলে ধরে কোনওভাবে কাজ চালিয়ে নিতে হয়। তবে কখনও কখনও বড় ঘটনাও ঘটে যায় বইকি। হায়দরাবাদের সেই ডাক্তার, প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির কথা মনে আছে? রাতে চেম্বার সেরে বাড়ি ফেরার পথেই ধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় যাকে। গণপরিবহণও নয়, নিজের স্কুটারেই তো বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল সে মেয়ে।
……………………………….…………………………………………
পড়ুন শতাব্দী দাসের লেখা: আসুন, রাতের দখল নিই
…………………………………………………………………………..
জ্যোতি থেকে প্রিয়াঙ্কা, সবাই রাস্তায় ধর্ষিতা হয়েছিলেন। রাতে। আমরা, মেয়েরা জানতাম, রাতের রাস্তা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে রাতের ডিউটি করার সময় কোনও কর্মী মেয়েই কি তার সেই স্পেসকে অসুরক্ষিত ভাবেন? বিশেষ করে চিকিৎসক, মিডিয়াকর্মী, রেলকর্মী, নানা জরুরি পরিষেবার কর্মীদের কাছে নাইট ডিউটি রোজের রুটিন। এই অবস্থায় কাজের জায়গাটাই এই কর্মীদের আরও একটা বাড়ি হয়ে ওঠে। যে জায়গাটায় ২৪ ঘণ্টা বা তার অনেকটা অংশই কাটছে, সেই জায়গাটা হয়ে ওঠে একান্ত নিজের এলাকা। সেই অধিকারের জায়গা থেকেই সেখানে নিরাপত্তাহীনতা কিংবা আতঙ্কের প্রশ্ন আসে না চট করে। একলা থাকলেও না। উপরন্তু ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটির রোস্টারও ভীষণরকম প্রচলিত। টানা ডিউটির ক্লান্ত শরীরে কোনও মহিলা চিকিৎসক ‘নিকটতম’ রেস্টরুম খুঁজতে পারেন, ‘নিরাপদতমে’-র খোঁজ তাঁর করার কথা নয়। আর নিজের প্রতিদিনের চেনা পরিসরে কোনও জায়গা যে কোনও মানুষের কাছেই বিশ্বাসের আশ্রয়, সেখানে অ-নিরাপদ তকমা লাগারও কথা নয়। যদিও, প্রান্তিক মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত অনেক মহিলা চিকিৎসকের কথা ডাক্তারি মহলে কান পাতলে শোনা যাবে, যাঁরা পকেটে লঙ্কার গুঁড়ো রেখে ডিউটি করেন, বা কোনও পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেন। শহর থেকে দূরে, ফাঁকা চিকিৎসাকেন্দ্রে আগাম সতর্ক থাকার কথা তাঁরা ভাবতে পেরেছেন। বা, তাঁদের ভাবতে হয়েছে। কিন্তু শহরের বুকে একটি হাসপাতাল, যা তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বটে, সেখানে এক পড়ুয়া চিকিৎসক নিজেকে নিরাপত্তাহীন বলে ভাবতে পারেননি। অরুণা শানবাগের ঘটনার পরেও নয়।
এমনটা ভাবা যে ভুল, সে কথা এ শহর নতুন করে শেখাল বটে। তবে এ কথাও আমাদের ‘প্রায়’ জানা থাকারই কথা ছিল। এ ঘটনা প্রায় বছর দুই বাদে মনে পড়িয়ে দিয়েছে, নিজের একতলা বাড়ির বাথরুমে এক রাতে শার্সি নামিয়ে দেওয়া হাতটিকে। আর সে ঘটনার কথা বলায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানলাম আরেক মেয়ের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। রাত্রিবেলা নিজের ঘরে বসে থাকার সময় জানলার কাচ সরিয়ে, পর্দা ফাঁক করে বাইরে থেকে তাকে দেখছিল এক পুরুষ। জানি, এ ঘটনার ট্রমা যতদিন সে মেয়ের মনে দগদগে ঘা হয়ে থাকবে, ততদিন নিজের ঘরে, প্রতি রাতে জানলার দিকে সতর্ক চোখ মেলে রাখতে হবে তাকে। প্রত্যেক রাতে নিজের ঘরেও সজাগ হয়ে থাকতে হবে তাকে, নিজের শরীরকে পাহারা দেওয়ার দায়ে। এ কথা শোনার পর যে সতর্কতা অভ্যাস করছি আমিও। এই নাইট ডিউটি থেকে আমাদের আদৌ ছুটি মিলবে কি কোনও দিন?
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..