যে দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হন, সেদেশে ধর্মীয় স্থানে ধর্ষণের এমন ঘটনা কি জাস্ট র্যান্ডম ইন্সিডেন্ট নয়? আমার মতে নয়। হলে, আশ্রম বাপু থেকে রাম রহিম, ইচ্ছাধারী ভিমানন্দ থেকে নিত্যানন্দ, রামপাল থেকে বাবা বালকনাথ, জিলাবি বাবা থেকে দয়ানন্দ বাবা– ধর্মকে বর্ম করে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ ও খুনের একাধিক ঘটনা দিনের পর দিন রিপোর্টেড হত না। সর্ব ধর্মে, সর্বকালে, সর্বদেশে ধর্মীয় ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে প্রান্তিক মানুষের ওপর। দক্ষিণ ভারতে হিন্দুধর্মের দেবদাসী প্রথা, ইসলাম ধর্মের খানকা ব্যবস্থা কিংবা হিব্রু বাইবেলে মোজেসের ভোগের উদ্দেশ্যে কুমারী মেয়ে ছাড়া বাকি সকল নারী-পুরুষদের হত্যা করার বিধান কি একই ধর্মীয় সুতোয় বাঁধা নয়?
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
এখন কী হয় জানি না। কিন্তু আমরা যারা নয়ের দশকের কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বড় হয়েছি, তাদের জীবনের প্রথম পাঠই ছিল, ‘বড় হচ্ছ, এবার ছাড়তে শেখো। চাইলেই সব কিছু আর হাতের কাছে পাবে না।’
অন্যের জন্য ছেড়ে দেওয়ার, অল্পেতে খুশি থাকার, এমনকী, সামর্থ্যের থেকেও সাধারণ যাপন সেকালের ভ্যালু সিস্টেমের অন্তর্গত ছিল। ব্যাপারটা ভালো ছিল না মন্দ– তার থেকেও বড় ব্যাপার হল, ব্যাপারটা ছিল। এবং ঘরে ঘরে এমনভাবে ছিল, যে আমরা সেটাকে ‘নিয়ম’-এর মতো অনুসরণ করতাম; প্রশ্ন করতাম না।
এই নিয়মের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ব্যাপারটা প্রথম মনে জাগল, টিভির পর্দায় একদিন এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে। ফরসা, গুঁফো, সুদর্শন ভদ্রলোক, গলায় গেরুয়া কাপড় জড়িয়ে হাত-পা নেড়ে বলছেন, ‘ঔর জিসনে সংকল্প কিয়া হ্যায় কে ত্রিশ অক্টোবরকো ওয়াহা পর পৌঁছকে করসেবা করেঙ্গে, ঔর মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে, উনে কওন রোকেগা?’
আরিব্বাস! সংকল্প করলেই তাহলে সব পাওয়া যায়? কেউ আটকাতে পারে না?
মন্দির-মসজিদের ‘জিরো সাম গেম’ তখন বুঝি না, সংবিধানে ইন্দিরা গান্ধীর সেকুলারিটির ক্লজের অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে তখনও অজ্ঞ, ডেকান হেরাল্ডে এই রথযাত্রার মাশুল হিসেবে শ্যামা রাউফ যে ৫৬৪ জনের মৃত্যুর কথা বলেছেন, সেসব তখন জানি না। ফলে এই উসকানি মনে মনে আমায় ‘অ্যায়সা জেহাদি’ করে তুলল যে, আগামী কয়েক দিন ইশকুল-পাড়া-বাড়ি সব মেতে রইল আমার ‘এটা চাই-সেটা চাই’-এর জেদে। বলা বাহুল্য, কয়েক ডজন কানমলা আর কানচাপাটির পর আমি আবার সিধে হলাম। আসলে আজকালকার বিপরীত মেরুতে বাস করা সেকালের বাপ-মা, কানমলার সঙ্গে ছেলেপুলের মানসিক স্থিতির বৈরিতা বুঝতেন না। তদুপরি, ইশকুলমাস্টার আর পাড়াতুতো মাসিমা-জ্যেঠিমাদের ওপর তাঁদের অগাধ আস্থা ছিল।
এদিকে, আমার নিতান্ত পার্থিব জেদাজেদির ব্যাপারটাকে সাইড লাইন করে পরবর্তী কয়েকদিন আমায় নাগাড়ে শেখানো হল, ধর্ম কী, ধর্মের রাজনীতি কী, ধর্মীয় মেরুকরণ আর অসহিষ্ণুতা কী কিংবা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস কীভাবে মানুষে মানুষে বিভেদের অস্থিমজ্জা তৈরি করে। যদিও তখন আমার বয়স মাত্র আট, কিন্তু সেকালের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারে, ধর্মীয় উদারীকরণের পাঠ শেখানোর জন্য কোনও বয়সকেই কম ভাবা হত না। আর আজ তার প্রায় ৩০ বছর পর, জীবন বেঁচে থাকার জন্য আমায় যেটুকু কার্যকরী দানাপানি জোগাতে পেরেছে, তা যে সর্বান্তকরণে সেদিনের ওই ধর্মীয় উদারীকরণের শিক্ষাসঞ্জাত, এ-কথা জোর গলায় বলতে পারি।
আমার কাছে ধর্ম ব্যাপারটা তাই– একটা বর্ম বই কিছু নয়। একটা লাইফ লাইন, যা আমাকে এমন কিছু ক্ষমতা আর সুরক্ষা দেয়, নিজের মুরদে যা আমি কখনওই অন্য কোনও উপায়েই অর্জন করতে পারতাম না। এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা ক্ষমতা মানুষকে পাওয়ার স্ট্রাকচারের এমন এক চূড়ায় বসায়, যেখানে শুধু ক্ষমতাই নেই, ক্ষমতার অপব্যবহারে সুরক্ষার নিশ্চয়তাও আছে।
……………………………….
অপরাধের ক্ষেত্রে সব ধর্মই আসলে মিলেমিশে যায়। আঞ্জনেয় স্বামী মন্দির প্রাঙ্গণে কয়েকদিন আগের যে ধর্ষণের ঘটনা বললাম, সেখানে ধর্ষকের তালিকায় ২০ বছরের কার্তিকের সঙ্গে ছিলেন ২৮ বছরের মহম্মদ সাদ্দিক। ধরা না পড়লে দু’দিন পরেই হয়তো তারা নিজ নিজ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘আল্লাহ আকবর’ বলে!
……………………………….
এখন কথা হল যে, এই ক্ষমতা দিয়ে আমি করবটা কী? ক্ষমতার প্রয়োগ ছাড়া ক্ষমতা তো ক্ষমতাই নয়। আর ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক মানুষের ওপর। তাই রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার ছ’-মাসের মধ্যেই লিঙ্গপ্রান্তিক ও জাতিপ্রান্তিক এক দলিত সাফাইকর্মী মেয়েকে একাধিকবার গণধর্ষণ করা হয়, নিকটবর্তী গেস্ট হাউসে আর তারপর মন্দির প্রাঙ্গণেই। ভয় দেখানো হয় যে, মুখ খুললেই তার বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলা হবে। ফলে মেয়েটিও চুপ করে থাকে। তারপর একদিন এই অবিরাম অত্যাচার আর সহ্য করতে না-পেরে চলে যায় পুলিশের কাছে। কিন্তু ধর্ম যেখানে একবার ঘুঁটি সাজিয়েছে, সেখানে জাস্টিস দেবে কোন পুলিশ? এফআইআর করতে গিয়ে মেয়েটি তাই শুধু প্রত্যাখ্যাতই হয় না, উল্টে দোষ চাপে তার ঘাড়েই। দোষ চাপে তাঁর চরিত্রের ওপর, পরিবারের ওপর, প্রান্তিক বংশপরিচয়ের ওপর।
এ হল ক্ষমতার উদযাপন। রামজন্মভূমির মতো পবিত্র স্থানে ঘটে যাওয়া এসব অপরাধ, যদি ক্ষমতার জোরে নাই মুছতে পারলাম, যদি ধর্মীয় স্থানকে কলুষিত করার দায় উল্টে ধর্ষিতের ঘাড়েই না-চাপাতে পারলাম, যদি আমার পোষ্য গুন্ডাবাহিনীকে এসব ‘ছুটকোছাটকা’ মহিলাবাজির ঘটনা ঘটানোর পাওয়ার আর প্রোটেকশন না-ই দিতে পারলাম, তবে আর ক্ষমতা কী?
এই ক্ষমতার আস্ফালন তাই চলতে থাকে। উত্তরপ্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ থেকে চেন্নাই, ইন্দোর থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ– গোটা ভারতে। এই তো গেল বছর, তেলেঙ্গানার এক মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন পুত্রবধূটিকে। সহ্য করতে না পেরে, একসময় থানায় অভিযোগ জানান বধূটি। চেন্নাইয়ের এক মন্দিরের পুরোহিত কার্তিক মুনুস্বামী, তার ইঞ্জিনিয়র প্রেমিকাটির সঙ্গে দীর্ঘদিন সহবাসের পর তাকে ধর্মের নামে ঠেলে দেয় পতিতাবৃত্তিতে। তদন্তের মুখে ইন্দোরের এক পুরোহিত স্বীকার করেন যে, ২১ বছরের দর্শনার্থী মেয়েটিকে তিনিই ধর্ষণ করেন নিজের মন্দির সংলগ্ন ঘরে। তার আগের বছরই মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলায় মন্দির ট্রাস্টের দুই কর্মচারী ধর্ষণ করে ১২ বছরের এক কিশোরীকে। ২০২২ সালে চেন্নাই এর কান্দাস্বামী নগরের ৫৫ বছরের পুরোহিত দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন মন্দির চত্বরে বসবাসকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের। সাত বছরের শিশুটিকে মধ্যপ্রদেশের মন্দির চত্বরেই ধর্ষণ করা হয় ২০১৮ সালে। কয়েকদিন আগেই আঞ্জনেয় স্বামী মন্দিরের সামনে ধর্ষিত হন ২৭ বছরের এক বধূ, মন্দিরেরই এক কর্মচারী আর তার সাঙ্গপাঙ্গের হাতে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যে দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হন, সেদেশে ধর্মীয় স্থানে ধর্ষণের এমন ঘটনা কি জাস্ট র্যান্ডম ইন্সিডেন্ট নয়? আমার মতে নয়। হলে, আশ্রম বাপু থেকে রাম রহিম, ইচ্ছাধারী ভিমানন্দ থেকে নিত্যানন্দ, রামপাল থেকে বাবা বালকনাথ, জিলাবি বাবা থেকে দয়ানন্দ বাবা– ধর্মকে বর্ম করে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ ও খুনের একাধিক ঘটনা দিনের পর দিন রিপোর্টেড হত না। সর্ব ধর্মে, সর্বকালে, সর্বদেশে ধর্মীয় ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে প্রান্তিক মানুষের ওপর। দক্ষিণ ভারতে হিন্দুধর্মের দেবদাসী প্রথা, ইসলাম ধর্মের খানকা ব্যবস্থা কিংবা হিব্রু বাইবেলে মোজেসের ভোগের উদ্দেশ্যে কুমারী মেয়ে ছাড়া বাকি সকল নারী-পুরুষদের হত্যা করার বিধান কি একই ধর্মীয় সুতোয় বাঁধা নয়?
অপরাধের ক্ষেত্রে সব ধর্মই আসলে মিলেমিশে যায়। আঞ্জনেয় স্বামী মন্দির প্রাঙ্গণে কয়েক দিন আগের যে ধর্ষণের ঘটনা বললাম, সেখানে ধর্ষকের তালিকায় ২০ বছরের কার্তিকের সঙ্গে ছিলেন ২৮ বছরের মহম্মদ সাদ্দিক। ধরা না পড়লে দু’দিন পরেই হয়ত তারা নিজ নিজ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘আল্লাহ আকবর’ বলে!
এসব প্রতিরোধে একটাই জিনিস প্রয়োজন– শিক্ষা। অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা, ধর্মীয় উদারতার শিক্ষা। যাতে ধর্ম নামক বর্মের আড়াল থেকে অপরাধীর অপরাধ চিহ্নিত করতে পারি নিরপেক্ষভাবে। যাতে কোনও মুসলিম ভাইয়ের ভুলের দিকে আঙুল তুললেই আমায় অ্যান্টি-ইসলাম বলে দাগিয়ে না-দেওয়া হয়। যাতে কোনও হিন্দু ভাইয়ের দিকে আঙুল তুললেই আমায় ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ বলে চিহ্নিত না করা হয়। যাতে কোনও খ্রিস্টান ভাইয়ের ভুল শোধরাতে গেলেই সে মনে না-করে যে, আমি তার মাইনরিটি অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছি।
রিলিজিয়াস ট্রায়াল আর রাজনৈতিক মেরুকরণের ঊর্ধ্বে উঠে এই যে নিরপেক্ষতার শিক্ষা, যা এক সময় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক শিক্ষার অন্তর্গত ছিল; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর স্পেস থিওরির নব্য-নতুন চ্যাপ্টারের মাঝে তা যেন হারিয়ে না যায়। বিশ্বাস করুন, এ-শিক্ষায় ব্যয়িত সময়ের জন্য আমার আপনার সন্তানের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র-আইএএস হওয়া আটকাবে না। আটকাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর দাঙ্গা বাধানো সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শাসকের আগ্রাসন।
এটুকু না করতে পারলে, ‘জিসনে সংকল্প কিয়া হ্যায় কে মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’, সত্যি বলুন তো, ‘উনহে কওন রোকেগা?’
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
সম্প্রতি যোধপুর পার্কে প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষের ওপর পাড়া-প্রতিবেশীর আক্রমণ। হেলমেট দিয়ে মেরে, মাটিতে ফেলে ধর্ষণের হুমকি। কোনও বচসার সময় যৌন সম্পর্কিত গালাগাল হচ্ছে তীব্রতম আক্রমণ, এবং ট্রান্স কুইয়ার সম্প্রদায়ের প্রতি এই আক্রমণের উদ্দেশ্য তাঁদের অন্যরকম যৌনতাকে অস্বাভাবিক, অসুস্থ প্রমাণ করা।