দেখতে পেয়েছিলাম আমার বন্ধুকে মারছে দক্ষিণপন্থী দলের সদস্যরা। আমি এগিয়ে গিয়ে বন্ধুকে সরিয়ে আনতে গেলে র্যালির লোকজন আমাকে মারতে শুরু করে। শুনতে পাই ‘হিজড়ে’ বলে গালাগালি করছে, টানা ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে।
আমার নাম ঊর্মি ড্যানিয়েলা আজার। দু’-বছর আগে এ নামটা আমার বন্ধু অনন্যা দিয়েছিল। বেঙ্গালুরুতে আইআইএসসি-তে অঙ্ক নিয়ে পড়তে গিয়ে ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে ‘কাম আউট’ করি। আমি অনেক দিন ধরেই গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। সেই সূত্রে যাদবপুর ইউনির্ভাসিটি ক্যাম্পাসে নানা সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছি। যেদিন আমার ওপর আক্রমণের ঘটনাটি ঘটে, সেদিন আমি যাদবপুর ইউনির্ভাসিটির সামনেই ছিলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি, দু’টি রাজনৈতিক দলের জমায়েত হয়েছে। একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা, মঞ্চ থেকে বিভিন্ন ধরনের অগণতান্ত্রিক কথাবার্তা বলছেন– সেটা শুনতে পাচ্ছি। সেই রাজনৈতিক দল যখন মিছিল করে এগিয়ে আসে, তখন দেখতে পাই, আমার পরিচিত এক বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছাত্রকর্মী ইন্দ্রানুজকে মিছিলের লোকজন পেটাচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ইন্দ্রানুজকে সরিয়ে আনতে গেলে র্যালির লোকজন আমাকে ঘিরে ধরে এবং ঝাঁপিয়ে পড়ে। রীতিমতো মারধর শুরু করে। তারই মধ্যে শুনতে পাই ‘হিজড়ে’ বলে গালাগালি করছে। তারা এ-ও বলছে যাদবপুরকে হিজড়ে মুক্ত করবে। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, আর তাতেই তারা আমাকে টানা ধর্ষণের হুমকি দিতে থাকে। সেদিন আমাকে ‘হিজড়ে’ হিসেবে আইডেন্টিফাই করেছিল বলেই উন্মত্ত জনতা আমাকে পিটিয়েছিল। তারপর পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে যায়। আমাকে তোলার সময় বলে, ‘তোমাকে তো রেসকিউ করছি, বাধা দিচ্ছ কেন?’ যদি উদ্ধার করার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তো এসকর্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা, প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে গিয়ে হ্যারাস করার কথা নয়। এখনও আমি যতদূর জানি, ইন্দ্রানুজ ও আমাকে যারা মেরেছিল, তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। থানাতেও মৌখিকভাবে ভয় দেখানো হয়। সেটা নিয়ে বিশদে কথা বলছি না, কারণ, এই কেস এখন সাবজুডিস অবস্থায় রয়েছে। জনতা যে বেছে বেছে ট্রান্সজেন্ডারদের টার্গেট করে– এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার সোশ্যাল মিডিয়াতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের লোকেরা এসে ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে এবং এ-ও বলেছে আরও মার খাওয়া উচিত ছিল। ওরা ভুলে গিয়েছে আমি মার খেতে অভ্যস্ত। এবং আমি এই লড়াই থেকে সরে আসব না। একজন রূপান্তরকামী মানুষের প্রতি হিংসা দ্বিগুণ হয়ে যায়, যখন সে একজন ট্রান্স-অ্যাক্টিভিস্ট। কারণ, সমাজ মনে করে, এদের তো ভিক্ষে করে খেয়ে পরে বাঁচার কথা। এরা এত কথা বলছে কেন, এত প্রতিবাদ করছে কেন! আমার নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার তো রয়েছে। কিন্তু এ দুটো লড়াই আসলে আলাদা নয়। বরং অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
শহর হিসেবে, সহিষ্ণুতার দিক থেকে কলকাতা অথবা বেঙ্গালুরুর মধ্যে খুব একটা ফারাক আমি দেখিনি। তবে এটাও ঠিক, আমি যে ইনস্টিটিউটে পড়তাম, সেখানে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের প্রতি একটা সহনশীলতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল দীর্ঘদিনের সচেতনতা প্রচারের পর। এবং যাদবপুর ক্যাম্পাসে আমি যতবারই গেছি, কখনও আনসেফ ফিল করিনি। হস্টেলের বিষয়টা হয়তো আলাদা। যে কোনও হোস্টেলেই একটু মেয়েলি ছেলেদের বেশি টর্চার করা হয়। ঠিক যে কারণে ভিড়ের মধ্যে আমাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কানে এসেছে, কেউ বলেছে পালাজো পরে এসেছে মেয়েদের মতো। তেমন, হোস্টেলে একটু কমনীয় স্বভাবের ছেলেদের ওপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার বেশি করা হয়, পৌরুষের প্রমাণ চাওয়া হয়। মনে আছে বেঙ্গালুরুতে আমার একজন সিনিয়রকে ভয় দেখিয়ে টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, টাকা না দিলে তার পরিবারে জানিয়ে দেওয়া হবে তার প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের কথা। আমি ২৩ বছর বয়সে যখন ‘কাম আউট’ করি, তার এক-দু’ বছর পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: শ্রীশ্রীসিসিটিভি-মাহাত্ম্যে কি মুছে যেতে পারে অপরাধ?
এ বিষয়ে আরও একটা কথা বলতে চাই, সাধারণত, স্কুলে বা কলেজে পড়াকালীন নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটির বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়। এবং তখনই প্রান্তিক যৌনতা নিয়ে অনেকেই ‘কাম আউট’ করে। এটা করার ফলে বেশিরভাগ রূপান্তরকামী মানুষকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। বাড়ি ছাড়ার পর যদিও বা একধরনের ন্যূনতম সেফটির ব্যবস্থা করা যায়, কিন্তু তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর দায়ভার কে নেবে? এমন অনেক ট্রান্সজেন্ডার মানুষ আছেন, যাঁরা উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি আর্থিক কারণে। মৌলিক অধিকারের লড়াইয়ে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা– এই দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই দুই ক্ষেত্রেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে বিপদের মুখে পড়তে হয়। আমি ট্রান্সজেন্ডার বলে চাকরি পাচ্ছি না বললে হয়তো অতিকথন হয়ে যাবে, কিন্তু দেশে আসলে চাকরিই নেই। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেখানে রিজারভেশনের ক্ষেত্র শক্তিশালী ছিল, সেখানেও প্রাইভেটাইজেশন হচ্ছে। আমি এই দেশের নাগরিক, সরকারের আমার প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমি এখনও পর্যন্ত যেখানে ইন্টারভিউ দিয়েছি, আগে খোঁজ নিয়ে দেখি ট্রান্সজেন্ডার মানুষ নিযুক্ত করা হয় কি না। সমস্যা এমনিতেই কম নেই। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার বলে আমাদের সমস্যা আরও বেড়ে গিয়েছে।
তাই এটা জোর দিয়ে বলতে চাই, রূপান্তরকামী মানুষদের মৌলিক অধিকারের লড়াই আলাদা– এটা বলে কিন্তু পৃথক করে দেওয়া যাবে না। এই পৃথক করাই ফ্যাসিস্টদের টেকনিক। এ রূপান্তরকামী– একে আলাদা কর, ও দলিত– ওকে আলাদা কর। এইভাবে আলাদা করে দিয়ে ওরা বলে– এইটুকুই তোমার লড়াই। আসলে আমাদের লড়াইগুলো এক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, র্যাগিংয়ে মৃত ছাত্রটিকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীরা যখন তাদের সার্বিক ব্যর্থতা মেনে নিয়ে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার সমানে আক্রমণ করে চলেছে। তারা মিডিয়া ট্রায়ালের ‘মব ভায়োলেন্স’-এর মুখে পড়েছে। যাদবপুরে হিজড়েরা ঘুরে বেড়ায়, এই বয়ান আগেও ছড়ানো হয়েছে। কারণ সবাই এই ধরনের ‘জেন্ডার মার্কার’ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ন্যারেটিভ এমনি এমনি তৈরি হয় না। তৈরি করা হয়। যাদবপুরে কেন কন্ডোম-এর প্যাকেট পাওয়া যায়, কেন মদের বোতল পাওয়া যায়, এখানকার ছেলেমেয়েরা সেক্স করে কেন– এইসব প্রশ্ন এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। কীভাবে র্যাগিং বন্ধ করা যায়, কারা র্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রটি মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী– এই প্রশ্ন থেকে সরে গিয়ে মিডিয়াতে চলছে মরাল পুলিশিং, খাপ পঞ্চায়েত। আমি যেহেতু যাদবপুরের ছাত্র নই, তাই সেখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে পারব না। তবে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের অনুশীলন করার ইতিহাস আমি দেখেছি।
হোস্টেলে ক্ষমতার অনুশীলনের যে ট্র্যাডিশন রয়েছে, সেটার অবসান করার জন্য ছাত্ররা লড়ছে। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের ওপর যে আক্রমণ, তা আসলে গোটা দেশে গণতান্ত্রিক কর্মীর ওপর আক্রমণেরই অংশ। অবিলম্বে মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করে এই মুহূর্তে ছাত্রছাত্রীদের যে দাবি, তার ওপর ফোকাস করতে হবে। র্যাগিং বন্ধ করতে হবে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, হোস্টেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং এই মিডিয়া ট্রায়াল যে বা যারা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে উসকে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে গোটা রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। কারণ আজ রুখে না দাঁড়ালে কাল তোমার বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়বে। ইতিহাস তাই বলে। জে.এন.ইউ-তে তাই হয়েছিল, জে.ইউ-তেও তাই হচ্ছে। সেই বিখ্যাত লাইন আমরা প্রত্যেকেই জানি। ‘প্রথমে তারা সোশ্যালিস্টদের জন্য এল, আমি কথা বলিনি, কারণ আমি সোশ্যালিস্ট নই। তারপর জিউদের জন্য এল, আমি কথা বলিনি, কারণ আমি জিউ নই। তারপর তারা আমার জন্য এল, তখন আর আমার হয়ে কথা বলার জন্য কেউ বেঁচে রইল না।’ তাই যখন আরএসএফ-এর ছাত্রকর্মী ইন্দ্রানুজকে মারছে, আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাব না।
আজ ওর পাশে না দাঁড়ালে, এরা যেদিন আমাকে মারতে আসবে, আমি আমার কাউকে পাশে পাব না।
অনুলিখন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved