ভাঙা-ভাঙা কথায় রিক বাগদি রচনা করে তার বিশ্বাসের পৃথিবী। শান্ত তার কথন। শুদ্ধ তার চিন্তা। দৃঢ় তার অবস্থান। সেই অন্তরতম আলোর সামনে এসে এক লহমায় যেন খসে খসে পড়ে বড়দের দুনিয়ার চতুর ইশারাসমূহ। স্বার্থান্ধ জিতে চাওয়ার উদগ্র ইচ্ছের আগ্রাসী দুনিয়ার ভিতর এ এক অন্য উপনিষদ। জিততে না চাওয়াই যেখানে বড় জয়। ক্ষমা মহৎ শক্তি। বোকা, চালাকের বিপরীত শব্দ মাত্র নয়, বিপ্রতীপ দর্শন। কলুষক্লান্ত এই পৃথিবী হয়তো সে গন্তব্য ক্রমাগত ভুল করে। হাওড়া ব্রিজের চূড়ো থেকে নিচে তাকালে তাই শুধু নির্বোধ আর বুদ্ধিমান নয়, আজ চোখে পড়ে, আমাদের পাশটিতে আছে রিকও, কাছেই; আমরা কি কখনও পারব তার একলা-চলোর পৃথিবীতে পৌঁছতে! রিক বাগদি-র সঙ্গে একান্ত গল্প-কথায় রোববার.ইন-এর তরফে উত্তর অনুসন্ধান করছেন সরোজ দরবার।
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে সে যেন এক বেখাপ্পা ‘বড়’ মানুষ। প্রথম বেঞ্চের যাবতীয় সফলতার উচ্ছ্বাস সরিয়ে স্বেচ্ছায় যে আপন করে নেয় শেষ বেঞ্চের নিভৃতিটুকু। বুকের ভিতর তার টলটলে এক সরোবর মায়া। পুরনো দলের জালে গোল জড়াতে মন সরে না। মা বলেন, এই সেয়ানা মুলুকে তুই তো বোকা হয়েই থেকে যাবি রে! বেবাক দুনিয়ার মানুষ তাকে দেয় চালাক হওয়ার মন্ত্র আর মন্ত্রণা; সেইসব সা-রে-গা-মা পিছনে ফেলে তার দু’-চোখে নেমে আসে অপূর্ব সৎ আলো। চোখে পড়তে সে চায় না কিছুতেই। তবু মাস্টারমশাইদের চোখে পড়েই যায়। এ ছেলে তো জিততে চায় না! হেরেও যায় না! সে যেন পা রাখতেই চায় না চেনা পৃথিবীর চেনা-চেনা নিয়মকানুনে। লোকে তাকে বোকা বলে; বলুকগে! সে জানে, যে চালাক-পৃথিবী মানুষকে ঠকায়, দুনিয়াটা কেবল সেই পাকদণ্ডিতে ঘুরতে পারে না। নিজের মতো করে সে তাই তৈরি করে নেয় তার আপন-ভুবন। সেখানে জিতে যাওয়ার বাসনা নেই। হেরে যাওয়ার গ্লানি নেই। চালাক হওয়ার মই নেই। বোকা হওয়ার সাপের মুখ-ও নেই। অলক্ষ্য সাপ-লুডো থেকে দূরের সেই মায়াভুবনে একাকী বালক সে কান পেতে শোনে পৃথিবীর পবিত্র নির্জন একাকীর গান। প্রতিযোগিতায় ক্লান্ত এই দুনিয়াটায় সে যেন বহু কাঙ্ক্ষিত শুদ্ধ অবগাহন। তার ভাবনার আজঁলাভরা জলে যেন সকলে স্বপ্ন দেখে কলুষ ধুয়ে মানুষ হয়ে ওঠার।
রিক বাগদি যেন এই চতুরতায় আক্রান্ত পৃথিবীতে পবিত্রতম ব্যতিক্রম।
মা, সুমিন্দা বাগদি বলছেন, “ছোটবেলা থেকেই ও অন্যরকম। আমি তো ‘বোকা’ বলে ওকে বকাঝকাও করেছি। তবু ও ঠিক অন্যকে নিজের খাবার খাইয়ে দিয়ে আসে। এখনকার দিনে সবাই সেয়ানা। নিজেরটা বুঝে নিতে চায়। ও কোনও দিনই সেরকম নয়। যত যা-ই বলা হোক, ও বদলায় না।”
মাস্টারমশাই ঋপণ আর্য বলছেন, “ছেলেটা যেন কিছুতেই চোখে পড়তে চায় না। অথচ ওর কথাবার্তা শুনলে, কাজকর্ম দেখলে ওর দিকে চোখ যাবেই। আর পাঁচটা ছেলে যা করছে, ও তা করতে চায় না। এমনকী কারও সঙ্গে সামান্য গন্ডগোলেও যেন জড়াতে চায় না। যেন, সব প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর শক্তি ওর সহজাত।’
লাভপুরের শীতলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি যেন এই বড়দের ধ্যানধারণায় মূর্তিমান দ্রোহ। বছর নয়েকের রিক অনায়াসে যে-দর্শনকে আপন করে নিতে পারে, অনেক আয়াসেও হয়তো তা আয়ত্ত করা যায় না। অথচ রিক তিরতিরে স্বচ্ছ নদীর মতোই বইয়ে দিতে পারে তার আপন বিশ্বাসের স্রোতধারা–
রিক, তুমি বলেছ, বড় হয়ে তুমি বোকা হতে চাও। সবাই তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার আরও কত কী হতে চায়। তাহলে তোমার এরকম ভাবনা কেন?
রিক: আমি বাবার মতো হতে চাই। আমার বাবা, সৎ লোক, ভালো মানুষ। আর বাবা বলেছে, প্রকৃত মানুষ কখনও কাউকে ঠকায় না। আমি বাবার মতো সৎ নাগরিক হব। তাই বোকাই থাকব। আমার বাবা তো কাজ করে (দিনমজুর), তবে অনেকে টাকা দেয় না। কাজ করেও টাকা পায় না। বাবাকে অনেকে ঠকায়। দেখে খারাপ লেগেছে। আমি তাই কখনও কাউকে ঠকাতে চাই না।
তোমার এই কথা শুনে বন্ধুরা কী বলে?
রিক: হাসাহাসি করে।
তাতে তোমার খারাপ লাগে?
রিক: খারাপ লাগে না। আমি একটা গল্প শুনেছি স্কুলে। একটা পেয়ারা যদি আমি কাউকে দিই, তাহলে সেটা অন্যের কাছে থাকল। আর যদি সে সেটা না নেয়, তাহলে তো আমার কাছেই থেকে গেল। বন্ধুরা তাই বোকা বলে আমাকে যা-ই বলুক, ওদের কথায় উত্তর করি না। ওদের কথা তাহলে ওদের কাছেই থেকে গেল। আমি ওদের বলি, তোরা যদি কাউকে ঠকাস, তাহলে ঠকানোর শাস্তি পাবি।
তোমাকে তো বড় হয়ে চাকরি-বাকরি করতে হবে। তখন বোকা হয়ে থাকলে অসুবিধা হবে না?
রিক: বড় হয়ে চাকরি করব। তবে, কাউকে ঠকাব না। অন্য কেউ যদি ঠকিয়ে নিতে চায় তো নেবে। আমি অন্য টিমে গোল দিতেও চাই না।
সে কী! কেন?
রিক: আমি পরপর ক’দিন এক টিমে খেললাম। তারপর অন্য টিমে চলে গেলাম। তখন পুরনোদের গোল দিতে হলে খারাপ লাগে।
তোমার কথা যে এখন অনেকে শুনেছে, তাতে বাড়ির লোক কী বলছেন?
রিক: মা আমাকে বলত, তুই এরকম থাকলে লোকে তোকে ঠকিয়ে নেবে। কিছু না পারলে বলত, তুই বড় হয়েও বোকাই থেকে যাবি। গ্রামের অনেকেও বলত। আমি বলতাম, বোকাই থাকব। এখন মা-বাবা সবাই আনন্দ পাচ্ছে। জ্যেঠু, জ্যেঠিমা, কাকু, কাকিমা, ভাই, বোন আছে, (যৌথ পরিবার) বাড়ির সকলেই এখন আনন্দ পেয়েছে।
আর স্কুলের স্যরেরা কী বলছেন?
রিক: সবাই প্রশংসা করেছেন। স্যরেরা না থাকলে আমি অনেক কিছু জানতাম না। আমার অঙ্ক ভালো লাগে। একবার দেখিয়ে দিলে শিখে যাই।
আর খেলাধুলো করতে ভালো লাগে না?
রিক: খেলি তো। চোরপুলিশ, কাবাডি… ফুটবল, ক্রিকেট… খেলতে ভালো লাগে।
রিক, তুমি যেভাবে ভাবতে পারো, বড়রাও তা পারে না। তাদের তুমি কিছু বলবে?
রিক: আমি চাই, পৃথিবীর কেউ যেন কাউকে না ঠকায়। আর যদি কেউ ঠকায়, তাহলে ক্ষমা করে দিতে হবে। তাকে ঠকাতে নেই। প্রতিশোধ নিতে নেই। বাবা বলেছে, ভালো মানুষ কাউকে ঠকায় না।