ব্যোমকেশ এখন দিল্লিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘আর্জেন্ট’ কল পেয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কলকাতার আকাশে শ্রাবণের মেঘ সৈন্যদলের মতো কুচকাওয়াজ করছে। বৃষ্টি হয়তো শিগগিরি নামবে একচোট। এর মধ্যেই ডিজিটাল মাধ্যমে এসে গেল ‘রোববার’। রিডিং ল্যাম্প জ্বেলে চিঠি লিখতে বসলেন সত্যবতী।
‘আইফোন সিক্স প্লাস’। সত্যবতীকে মাস সাতেক আগে গিফ্ট করেছে ব্যোমকেশ। সেটিকে চার্জে বসিয়ে রাইটিং ডেস্কে এসে বসল সত্যবতী। সামনে ল্যাপটপ। ‘রোববার ডট ইন’-এ খবরটি দেখার পর থেকে মনের ভিতরে উগ্র ঢেউ উঠেছে। উত্তেজনার লাগামটিকে টেনে ধরা দরকার।
পুরনো দিনের জিনের উসকানি এখনও কিছুমিছু রক্তে রয়ে গিয়েছে সত্যবতীর। তাই ব্যোমকেশ কলকাতার বাইরে গেলে সে চিঠি লেখে। ইনল্যান্ডের দিন তো আর নেই। পোস্টকার্ডে বরাবর আগ্রহ কম সত্যবতীর। প্রিভেসির বড় অভাব সেখানে। ফলে যেটা করে, ল্যাপটপে বাংলা ফন্টে টাইপ করে, প্রিন্ট আউট নিয়ে, কুরিয়ার করে দেয়। আগমার্কা চিঠির বেয়াকুল গন্ধ এতে করে উধাও হয় বটে, তবে খানিকটা স্মৃতি তো থেকেও যায়, অস্বীকার করা যাবে না। আর, অনেকেই যেটা জানে না, এমনকী অজিতও নয়, যে, চিঠির উপরে সত্যবতী এখনও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ কথাটি পেন অ্যান্ড পেপারে লেখে। শেষে, ‘তোমার সত্য’ বলে সই করে তারিখ-সহ।
ব্যোমকেশ এখন দিল্লিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘আর্জেন্ট’ কল পেয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কলকাতার আকাশে শ্রাবণের মেঘ সৈন্যদলের মতো কুচকাওয়াজ করছে। বৃষ্টি হয়তো শিগগিরি নামবে একচোট। রিডিং ল্যাম্প জ্বেলে সত্যবতী চিঠির প্রথম বাক্যটি লিখতে শুরু করে–
সাড়ে চুয়াত্তর
নিশ্চয় জানো ব্যোমকেশ যে, ‘রোববার’ সাপ্তাহিকের নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এসেছে। ‘রোববার ডট ইন’। সকালে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে চোখে এল তাদেরই একটি বিজ্ঞাপন। বেশ ঢালাও করে তারা জানিয়েছে– ‘ব্যোমকেশের সত্য-সন্ধান’ নামে নাকি একটি ধারাবাহিক কলাম শুরু হবে সেখানে আর কয়েক দিনের ভেতরে। কে লিখছে জানো সেই কলামটি? অজিত ঠাকুরপো। কলামের বিষয়বস্তু কী হতে পারে, তা-ও সাঁটে দু’-ছত্র বলে দেওয়া হয়েছে। অজিত ঠাকুরপো যেহেতু আমাদের পারিবারিক বন্ধু, তোমাকে ও আমাকে বহুদিন ধরে চেনে, শুধু তা-ই নয়, আমাদেরকে একসঙ্গে সংসার করতেও দেখেছে, তাই আমাদের নিয়ে অজিত ঠাকুরপো একটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নথিভুক্ত করবে। সেই লেখাটির নামই হতে চলেছে ‘ব্যোমকেশের সত্য-সন্ধান’।
কিছু মনে করো না, আমার এই খবরটি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। একটি লেখার বিষয়বস্তু কিনা তুমি ও আমি– মানে, আমাদের কেমিস্ট্রি! এমন একখানা কলামের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে অজিত ঠাকুরপো একবারও আমার সঙ্গে আলোচনা করল না? বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে যে-লোকটা রোজ মেয়েদের কনসেন্ট নিয়ে বক্তিমে ঝাড়ে, সে সামান্যতম প্রয়োজন বোধ করল না এটা জানতে যে, এমন হলে আমি স্বচ্ছন্দ হব কি না? অজিত ঠাকুরপো এবার তবে ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর সাংসারিক কেচ্ছা লিখবে? এত দুঃসাহস তার?
আমার সংসারের হাঁড়ির কথা আমি কেন অন্যকে জানাতে যাব? তোমার সঙ্গে আমার দাম্পত্যের দিনগুলি রাতগুলি কেন কুচিকুচি করে কেটে ‘খবর’ বলে রান্না করে অন্যের প্লেটে সার্ভ করব বলতে পারো? ব্যোমকেশ, তুমি ‘সেলেব’ হতে পারো, অজিত ঠাকুরপোও ‘সেলেব’ হতে পারে, কিন্তু আমি নই। আমার সেলেব হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনাও নেই। আমি ইনস্টাগ্রামের রিলে ভাইরাল হতে চাই না। সেজন্য ‘পারমিশন’ না নেওয়ার প্রশ্নটি আমাকে এত কাঁটার মতো ফুটছে।
যে-কারণে এই চিঠি তোমাকে লিখছি তা হল, আমি জানতে চাই, এমন একটি কলাম লেখার পরিকল্পনা যে অজিত ঠাকুরপো করেছে, তা কি তুমি আগাম জানতে? যদি জানতে, তাহলে সেটা আমাকে জানাওনি কেন? ধরে নিচ্ছি জানতে না, অর্থাৎ এখন জানলে, আমার চিঠি পড়ে, তবে এবার বলো– তুমি কী কী পদক্ষেপ করার কথা ভাবছ? তিনজনে একসঙ্গে বসে পাঁঠার ঘুঘনি খেতে খেতে শুকনো আলোচনায় আর চিঁড়ে ভিজবে না। এমন কিছু করো যাতে এটার সত্যিকারের একটা জবাব আমি পাই তোমার থেকে।
তোমাকে ইমেল করেও জানাতে পারতাম। উত্তরও চটপট পেতাম হয়তো। কিন্তু চিঠি লেখা ও তার উত্তর পাওয়ার মাঝে যে মন্থরতা আছে, যে নির্জনতা আছে, যে একাকীত্ব আছে, মনে হয় এখন– সেটাই হয়তো জীবনের নির্যাস। ভাল থেকো।
আর হ্যাঁ, তুমি বা অজিত ঠাকুরপো দু’জনের কেউ-ই যদি আমাকে এর সদুত্তর দিতে না পারো, তবে এর বিকল্প ভেবে রেখেছি। ‘রোববার ডট ইন’-এর সম্পাদকমণ্ডলীকে জানাব যে, আমিও একটা কলাম লিখতে চাই। তার বিষয় হবে– ব্যোমকেশ ও অজিতের বন্ধুত্ব। বা, বলতে পারো, তোমাদের স্বার্থের সংঘাত, ঝগড়া, হিংসে, যা লোকচক্ষুতে আসে না সহজে। কিন্তু আমি জানি তার পুরোটা। ব্যাক-টু-ব্যাক দুটো সুপারহিট কলাম পেলে ‘রোববার ডট ইন’ যে আরও পপুলারটি পাবে, বলা বাহুল্য।
ইতি
তোমার সত্য
অনৈতিহাসিক চিঠিখানি উদ্ধার করেছেন ভাস্কর লেট।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved