Robbar

রবীন্দ্রনাথ এ যুগের রামায়ণ রচনা করে রেখেছেন গীতবিতানে!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 27, 2025 2:48 am
  • Updated:November 27, 2025 2:48 am  

রবীন্দ্রসংগীত গাই, তাঁর সুর বাজাই, এই আমার বড় সম্পদ। আমাকে পতাকা নিয়ে পথে পথে “দিতে হবে দিতে হবে” বলে চেঁচিয়ে মরতে হয় না। শ্বেতশুভ্র রবীন্দ্রপতাকার তলে “আমরা সবাই রাজা!” এই তালে নাচতেই ভাল লাগে কারণ “আমাদের এই রাজার রাজত্বে” “কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।” এই সীমার মাঝে অসীম তিনি আপন সুর বাজিয়ে চলেছেন, আমরা সেই সুরে গা ভাসিয়ে দিয়েছি, অমল-ধবল-পালে মন্দ মধুর হাওয়া লেগেছে, আমরা ভেসে চলেছি সেই কাণ্ডারীর হাল ধরা নৌকায় বসে, আর আমাদের মন ভেবে মরছে– রবীন্দ্রনাথই কি সেই মহর্ষি বাল্মীকি? যিনি এ যুগের রামায়ণ রচনা করে রেখেছেন গীতবিতানে!

অন্নদা মুন্সী

জাগ্রত ভগবান! রবীন্দ্রনাথ আমার দৃষ্টিতে ভারতের জাগ্রত ভগবান, যেমন আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ শ্রীচৈতন্য এবং আরও অনেক মহাপুরুষ যাঁদের আবির্ভাবে বাংলাদেশ জগতের তীর্থস্থান হয়ে পড়েছে। এক ব্রহ্ম বহু হয়েছেন, তাই আমরা শত দুঃখেও প্রচণ্ড বলীয়ান, লক্ষ মৃত্যুকেও ডর পাই না, অবহেলিত, পদদলিত হয়েও নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি কারণ আমরা ব্রহ্মসমুদ্রে সাঁতার কাটি কিন্তু কখনও তলিয়ে যাই না, কারণ আমরা জানি পিতা ব্রহ্ম আমাদের হাত ধরে আছেন। কিংবা জানি না। তবে এইটুকু জানি যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের বহুযুগের পরিচয়। তাঁর গানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। আমাদের দেশের বাড়ি যশোর জেলায় হলেও কুষ্টিয়ায় ট্রেন থেকে নেমে স্টীমারে কিংবা নৌকায় গড়াই নদী বয়ে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল যেতে হ’ত। আর কুষ্টিয়ার অপর পারেই তো শিলাইদহ, যেখানে কাছারী বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ লেখনী চালাতেন, জমিদারির হিসেবের খাতা সরিয়ে রেখে। বাঁধানো খাতায় আমাদের জন্য গান লিখে ভরতি করতেন, সেই-সব গান কলকাতায় ছাপা হ’ত, স্বরলিপি প্রকাশ হ’ত, আমার ছোটকাকা অমূল্যচরণ সেই গান মাগুরায় বসে সাধনা করতেন এবং ছুটিতে যখন বাড়িতে আসতেন তখন গাঁয়ের চাষাদের ছেলেরা সন্ধ্যাবেলায় এসে জড়ো হ’ত আমাদের কাছারী ঘরে, অবাক হয়ে শুনত কাকার কণ্ঠের সুমধুর রবীন্দ্রসংগীত– “দেখা পেলেম ফাল্গুনে…”। তারপর ওই গান মুখে মুখে উঠে যেত সব ছেলেদের কণ্ঠে, ভেসে আসত চাষের মাঠ থেকে সুললিত আওয়াজ– “এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুণে।”

রবিচ্ছবি

সে কালে আমাদের গ্রামটা সংগীতসিদ্ধ ছিল বলা যেতে পারে। আমাদের গ্রামে স্কুল ছিল না, তাই আমাকে যেতে হ’ত পাবনা শহরে মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে। ছোটবেলা থেকেই আমার গানের গলা ছিল খুব ভালো, তাই পাবনা শহরের ন্যাশন‌্যাল স্কুলে প্রতিদিন স্বদেশী সংগীত গাইতে হ’ত, এবং তার আগে নিয়ম করে পণ্ডিত মশায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে– ‘স্থানে হৃষীকেশ তব পকীর্ত্যা’– গীতার একাদশ অধ্যায়ের অর্জুনের সম্পূর্ণ স্তবটাই গাইতে হ’ত। ছুটির সময় দেশের বাড়িতে এসে যখন ছেলেদের কণ্ঠে ছোটোকাকার শিক্ষা-দেওয়া রবীন্দ্র-সংগীত শুনতাম, তখন আমি অবাক হয়ে যেতাম সেই তরুণ গলার গান শুনে।

তারপর সিরাজগঞ্জে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা চলে আসি, গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভরতি হই, সেখানে দুবছর কাটিয়ে ইংরেজদের কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে বোম্বাই পাড়ি দিই, সঙ্গে আমার সেই ক’খানি গান! এইখানে এসে আমি এক বাঙালির কণ্ঠে যে গান শুনেছি, তার তুলনা কোথাও নেই। গাইয়ের নাম বিনয়ভূষণ গোস্বামী, শান্তিপুরের অদ্বৈত প্রভুর বংশধর এবং কৃষ্ণনাম কীর্তনে তিনি এক মহাপ্রভু! তাঁর কণ্ঠের “বন্দেমাতরম” যে শুনেছে, সে-ই অভিভূত হয়ে পড়েছে। এ যেন ভগবানের এক অপূর্ব কৌশল, বম্বের সভাসমূহে প্রথমেই বিনয় গোস্বামীর “বন্দেমাতরম” শোনানো! তারপর প্রতি রবিবার ভোরবেলা থেকে শুরু করে এগারোটা অবধি মারাঠি ছেলেমেয়েদের প্রভাতফেরীর সমবেত কণ্ঠের গান– “চরখা চালা চালাকে লেংগে স্বরাজ লেংগে” সমস্ত শহরবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে! আমরা বাঙালিরাও পিছিয়ে থাকি নি, হিন্দুস্থান ইনিসওরেন্স-এর ম্যানেজার নরেন দত্ত মশাইয়ের পরিচালনায় আমরাও বেরিয়েছি হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে একদল ছেলেমেয়ে, যুবা-বৃদ্ধ, বিনয় গোস্বামীর কণ্ঠের– “দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী, / আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি।” এই গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে– “জাগ্রত ভগবান হে জাগ্রত ভগবান” গেয়েছি। আমাদের এই পথ-পরিক্রমা নিশ্চয়ই সার্থক হয়েছে সেদিন…

এই বোম্বাই রেডিও থেকে আমি ও বিনয়ভূষণ প্রথম বাংলা গান, রবীন্দ্র-সংগীত গেয়ে শোনাতাম নিয়মিতভাবে শ্রোতাদের।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার সংগীত দিয়ে যোগসূত্র আজও নিবিড় ভাবে গাঁথা। যদিও তাঁকে আমি দেখি নি, যেমন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকেও দেখি নি, কিন্তু তাঁদের ছাড়া তো আমার অন‌্য পথ নেই। ঠাকুরের কথায়
“গুরুশিষ্যে দেখা নাই
সে বড় কঠিন ঠাঁই।”

এই কঠিন ঠাঁই-এর আমি ভীষণ ভক্ত। যেমন বিবেকানন্দ বলেছেন– সেই বুড়োশিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন, এদেশে চিরকাল। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন– এ এক কঠিন ঠাঁই।– “প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে, হে নটরাজ” কিংবা “আমি হব না ভাই নববঙ্গে নবযুগের চালক, আমি জ্বালাব না আঁধার দেশে সুসভ‌্যতার আলোক, যদি ননী ছানার গাঁয়ে কোথাও অশোক নীপের ছায়ে, আমি কোনও জন্মে হ’তে পারি ব্রজের রাখাল বালক, আমি চাই না হ’তে নববঙ্গে নবযুগের চালক।”

এ কৃষ্ণ-প্রেম রবীন্দ্রনাথেই সম্ভব। তাই তাঁর লেখা কবিতার নির্দেশই আমি বড় বলে মানি। রবীন্দ্রসংগীত গাই, তাঁর সুর বাজাই, এই আমার বড় সম্পদ। আমাকে পতাকা নিয়ে পথে পথে “দিতে হবে দিতে হবে” বলে চেঁচিয়ে মরতে হয় না। শ্বেতশুভ্র রবীন্দ্রপতাকার তলে “আমরা সবাই রাজা!” এই তালে নাচতেই ভাল লাগে কারণ “আমাদের এই রাজার রাজত্বে” “কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।” এই সীমার মাঝে অসীম তিনি আপন সুর বাজিয়ে চলেছেন, আমরা সেই সুরে গা ভাসিয়ে দিয়েছি, অমল-ধবল-পালে মন্দ মধুর হাওয়া লেগেছে, আমরা ভেসে চলেছি সেই কাণ্ডারীর হাল ধরা নৌকায় বসে, আর আমাদের মন ভেবে মরছে– রবীন্দ্রনাথই কি সেই মহর্ষি বাল্মীকি? যিনি এ যুগের রামায়ণ রচনা করে রেখেছেন গীতবিতানে! তিনি কি তাঁর সৃষ্ট এ যুগের রামকে ডেকে বলছেন– আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা?

শ্রী অন্নদা মুন্সী
৪৮ টালাপার্ক অ‌্যাভিনিউ
কলকাতা ৩৭