Robbar

তোমার আছে বন্দুক, আর আমার কেবল ক্ষুধা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 30, 2025 8:39 pm
  • Updated:July 1, 2025 7:36 pm  

১৯৯৭ থেকে একটানা কথা বলে চলেছি শহরের যৌনকর্মীদের সঙ্গে, বহুকালের আত্মীয়তার সম্পর্ক, আমি ওদের ঘরের ছেলে। প্রায় নিরানব্বই শতাংশ মেয়ে নৃশংস পারিবারিক হিংসার হাত থেকে কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ‘লাইন পাড়ায়’ আশ্রয় নিয়েছে। অন্তত একবেলাও পেট ভরে খেতে পেলে অনেকখানি মার হয়তো সহ্য করত আমার চেনা বেশ কয়েকজন। তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছিল তদ্দিনে, তবু ওইটুকু খোরাকিও বন্ধ হয়ে গেছিল– শুরু হয়েছিল বেদম মার। ‘খালি পেটে দিনের পর দিন মার সহ্য হত না মালু। দুর্বল শরীরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে ওভাবেই ফেলে রাখত।

অমিতাভ মালাকার

৩.

কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রায় ছ’-মাস পর মিঠু হঠাৎ এক বিকেলে হাজির। এদেশের গৃহস্থ বাড়ির মানুষ অত রোগা হতে পারে, আমার জানা ছিল না। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া, দরকারের চেয়ে বেশি মাইনে, জামাকাপড়, থাকার জায়গাওলা মধ্যবিত্তদের সঙ্গে ওঠবসের ফলে পাঁচমণি কৈলাশরা চোখ-সওয়া হয়ে গিয়েছে বহুকাল, খোদার খাসি টাইপের চেহারা না-হলে বাঙালির মন ভরে না। হোঁদোল কুতকুতের মতো পুরুষ-সন্তানদের মা-ঠাকুরমারা আজীবন ‘গায়ে গত্তি লেগেছে’ বলে আশকারা দিলেও ‘কণ্ঠার হাড় বাইরিয়া পড়সে’ বলে ডুকরে ওঠে, মেয়েদের পেট-গলা-পিঠের চর্বি আরও নানা জায়গা দিয়ে ঝুলতে শুরু করলে বান্ধবীরা চোখ ঠেরে কয় ‘বরের আদর’। তবু গেলা কমে না! কষ বেয়ে ঝোল গড়িয়ে পড়ে, আর গোটা জাতি নির্লজ্জের মতো হাসে মুরগির ঠ্যাং বাগিয়ে। সেই এক ‘ব্রিয়ানি চিগেঞ্চাবের’ খোশবাই, সেই এক ঘাম মুছতে মুছতে সিলিসিকেনফাড্রাইসে ‘আর এগডু জুস দিন’ বলে ওয়েটারের হাত কামড়ে দেওয়ার চেষ্টা, সেই একই সর্দিবসা খোনা গলায় প্রেতাত্মা গোছের অতৃপ্ত বউদিরা তেতলার চিলেকোঠা, দোতালার বারান্দা, বাদ্দুমের জানালার শিক বেঁকিয়ে মাথা গলিয়ে ‘পোঁনিঁর খাঁপোঁ, পোঁনিঁর খাঁপোঁ’ কেঁদে চলেছে গত ৩০ বছর– শালারা মনে হয় আলকাট্রাজের গরাদ মুচরিয়ে বেড়িয়ে আসবে ডেইলি ডোজ অফ পনির না পেলে! টায়ারের টুকরো দাও কাদা কাদা মশলার গাদে চুবিয়ে, ‘দালুন হয়েথে, একতু লবালেল মতো’ বলে তাও খেয়ে নেবে ব্লাডি বাগার্স, ছাড়বে না। ওড়িশার খরা-পিড়িত অঞ্চলে যাই না আমরা– পুরীর মন্দির, বাঙালি হোটেল আর কাকাতুয়ার নিম্নমধ্যবিত্ত খাজাবিলাস অবধি আমাদের দৌড়। মকাইবাড়ি-আর্ল গ্রে, ছিটিছি-ছি এত্তা জঞ্জাল, বা দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির আধাপর্নো বিলাস পেরিয়ে কুলি লাইনের মৃত্যুমিছিলও দেখতে হয় না– চা মানে দাজ্জিলিং, দাজ্জিলিং মানে কেভেন্টার্স, দাজ্জিলিং মানে সস্তায় নেপালি মেয়ে। সুরাট, বোম্বাই, দিল্লি, কানপুর, কেরল, তামিলনাড়ু থেকে সমস্ত খুইয়ে, প্রাপ্য মজুরির টাকা চেয়ে মার খেয়ে বাংলায় ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদেরও কি কোভিডের কালে দেখেছি?

COVID-battered Indian migrant workers prefer jobs closer to home
কোভিডকাল ও পরিযায়ী শ্রমিক

অতএব জিডিপি, সেনসেক্স, ‘বডিমাসইন্ডেক্স’ ইত্যাদি অ্যাব্রিভিয়েটেড অশ্লীলতা টপকে একটানা না-খেতে পাওয়া মানুষের কয়েক হাজার মাইল পথ হাঁটার সময় কার কতখানি ‘ফ্যাট’ ঝড়ে, কার ‘স্কিন’ কতখানি ‘টোনড্’ হয়, তাও অজানাই থেকে যাবে। শুধু জানি তাদের পুলিশ পিটিয়েছিল একধারসে, এমনকী, পানীয় জল চাইলেও– শিশুরাও বাদ যায়নি, কারণ কেই বা না জানে যে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। অতএব আম্বানির ছেলের বিয়ের লাড্ডু, নরেনবাবুর মাশরুম আর হেমা মালিনীর দুই মেয়ে-সহ পরিস্রুত পানীয় জলের বিজ্ঞাপনে কাকে কতখানি কামোত্তেজক দেখাল ইত্যাদি বিষয়ে গভীর প্রজ্ঞা ছাড়া মাথায় জমেনি কিছুই।

Migrant Worker Collects Food Food Distribution Editorial Stock Photo - Stock Image | Shutterstock Editorial
ছবিটি প্রতীকী

মিঠুর বরও জানত না তার বাইরে কিছু– ছেলেদের অত হিসেব রাখলে চলে? ওদের বড় সংসার। অনেকগুলো দেওর, ননদ। শ্বশুর-শাশুড়ি ঘরে। আবাদে সেই সকাল থেকে সন্ধে অবধি একটানা খাটত মুনিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবাই। খিদেও তেমনই। জলখাবারে পান্তা, দুপুরের খোরাকি মাঠে যেত চার-পাঁচটা বড় হাঁড়িতে– ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ। কেবল মিঠুকে কিছু খেতে দিত না– ওকেও খাটতে হত। অতগুলো লোকের রান্না। কাঠ কাটা, নারকেল পাতা জোটানো বাগান ঢুঁড়ে, ঘুঁটে দেওয়া, কয়লা ভাঙা, ছাই ঘেঁটে আধপোড়া কয়লা বেছে রাখা, কেরোসিন আনতে পাঁচ মাইল দূরে রেশন দোকানে লাইন দেওয়া। কিছুকাল পর মিঠুর মনে একদিন ভয় ধরেছিল– কেরোসিন কি শুধুই জ্বালানির ইন্তেজাম? তবে ও বিনা খোরাকির চাকর বলেই হয়তো এক কোপে মারেনি। সকলের বাসন মাজা, কাপড় কাচা, জল তোলা, শ্বশুরের পায়ে তেল মাখানো, বরের লগে সোহাগ তো আছেই– বউ-মানুষের কাজ সে নিজে করবে না তো কে করবে? সবটা খালি পেটে, কখনও একগাল মুড়ি দিল। হয়তো দু’দিন পর একথালা ভাত। শুধু নুন-ভাত, বা একটু ঝোল। মিঠুর বাপ ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম কী দেখেছিল সে ঘরে। মিঠু বললে– ‘জোতজমা, খেত খালিয়ান, গোলা ভরা ধান, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গরু– মনে কী আছে তা দেখবে কী করে?’

In Kolkata's Red-Light Area, Women Talk About Abuse Versus Agency, Sex Work as a Choice

মিঠু বললে ‘আমাকে রাখো। আমি আর ফিরে যাব না। ফিরে গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। হাতে মারবে না, ভাতে মারবে।’ মিঠুকে ‘রাখা’ সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। তার পরেরটুকু জানি না। আর কখনও দেখিনি ওকে। না, একটু ভুল হল। ওকে রোজ দেখতাম দুর্বারের মেয়েদের সঙ্গে কাজ শুরুর পর। সোনাগাছি, হড়কাটা, শেঠবাগান, ধুলিয়ান, আসানসোল, খালপাড়া, কালীঘাট– সর্বত্র মিঠুরা দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশে, চড়া লিপস্টিক মাখা ঠোঁট-জিভ-দাঁত দিয়ে আইসক্রিমের কাঠি, আমড়া, চালতার আচার, বুড়ির চুল, গরম ধোঁয়া ওঠা আলুর চপ, চা-বিস্কুট, পান চিবিয়ে চলেছে একটানা। ১৯৯৭ থেকে একটানা কথা বলে চলেছি শহরের যৌনকর্মীদের সঙ্গে, বহুকালের আত্মীয়তার সম্পর্ক, আমি ওদের ঘরের ছেলে। প্রায় ৯৯ শতাংশ মেয়ে নৃশংস পারিবারিক হিংসার হাত থেকে কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ‘লাইন পাড়ায়’ আশ্রয় নিয়েছে। অন্তত একবেলাও পেট ভরে খেতে পেলে অনেকখানি মার হয়তো সহ্য করত আমার চেনা বেশ কয়েকজন। তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছিল তদ্দিনে, তবু ওইটুকু খোরাকিও বন্ধ হয়ে গেছিল– শুরু হয়েছিল বেদম মার। ‘খালি পেটে দিনের পর দিন মার সহ্য হত না মালু। দুর্বল শরীরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে ওভাবেই ফেলে রাখত। মাথা ফেটে গড়ানো রক্তের মধ্যেই পড়ে থাকতাম, তারপর উঠে রক্ত পরিষ্কার করো, ঘর মোছো, কেউ একদিন বলেনি– আয় একটু ওষুধ লাগিয়ে দেই– আগের বউটা অজ্ঞান হয়ে দাওয়ায় পড়ে গেলে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরে দিয়েছিল। ছেলেপুলেগুলোকে খালে বিলে পুঁতে দিলে কেউ আসত খোঁজ নিতে? দেশ গায়ে কে কার খোঁজ নেয়? না পালালে বাঁচতাম না।’

Food aid to Gaza falls as Israel sets new rule – sources | Reuters
খাদ্যসংকটে গাজা

খেতে না দেওয়ার এই মডেলটাই সর্বত্র জনপ্রিয়– এমন একটি নিয়ন্ত্রণের ধাঁচা, যা বাঙালির অন্দরমহল থেকে গাজা অবধি এক। খেতে না দিয়ে শরীরের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করো, তারপর মনের ওপর দখলদারি সময়ের অপেক্ষা। খিদের চোটে ডান-বাঁ খেয়াল থাকবে না, তায় বিপ্লব! মিঠু কীভাবে, কোথায় পালিয়েছে বা খানায় মরে পড়েছিল, শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে– ব্যাচ্যার্থেও– খাওয়ার আগে সে বলতে পারবে না– তবে পালানোর জায়গা থাকে ভাগ্যিস। গাজার শিশুদের সে উপায় নেই।

Tiny Gaza Is Home to Most of the World's Hungriest People - WSJ
খাবার জুটবে? অনিশ্চিত গাজার শিশুটি…

উদ্বাস্তুদের সার সার তাঁবুর ওপর ইজরায়েল বোমা ফেলেছে একটানা, সরকারি হিসেবেই মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজারের খানিক বেশি। তাছাড়া বোমা মেরে তাঁবু ওড়ানো সহজ, খরচাও কম বলে খুনি বোমারু বিমান বহরের ভাড়াটে মার্কিন পাইলটরা মুখিয়ে থাকে ইজিপ্টের পথে ঘরছাড়াদের অস্থায়ী বাসস্থানগুলো লক্ষ করে ইনসেন্ডিয়ারি এবং ক্লাস্টার বোমা ফেলার জন্য। গোটা ব্যাপারটা নিয়ে একদিন মার্কিন পর্ন ইন্ডাস্ট্রি কয়েক লক্ষ কোটি ডলারের ব্যবসা করবে। গাবদা গোবদা সাদা, নর্ডিক, অ্যাংলো স্যাক্সন, ক্যাথলিক, মার্কিন বাপ-মায়েরা ডমিনোর– যারা নেতানিয়াহুকে সরাসরি অর্থ সাহায্য করে– পিৎজা অর্ডার দিয়ে লিভিংরুমের লার্জ স্ক্রিনে ফিলিস্তিন শিশুদের জলকষ্টে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে স্বমেহনে মজে যাবে। তারপর বোমা পড়ার দৃশ্যে উদ্দাম স্তম্ভন, আর শেষে ফাটার তালে তাল মিলিয়ে অর্গাজম। মুশকিল হল, যে যুদ্ধ ওরা শুরু করেছে, তা শেষ করার ক্ষমতা ওদের হাতে নেই আর। খেতে দেওয়া না-দেওয়াও নেই। বাজার ওদের থামতে দেবে না। এই ক্যাথলিকদের মুখে থুতু দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে জাওনিস্টরা। যিশুকে জারজ কুকুর বলে গাল দেয়, মেরি ওদের কাছে নোংরা বেশ্যা। পোপ ফ্রান্সিসের স্বাভাবিক মৃত্যুতে গোটা ক্যাথলিক বিশ্ব যতখানি শোকার্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্মিত। ফিদেলের চেয়ে কোনও একজনকেও যদি খুন করার বেশি চেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে সে অসফল প্রচেষ্টার দায় একদিন হয়তো মোসাদ স্বীকার করবে– বিনা পয়সায় এফ থার্টিফাইভ আর বোমা-মিসাইলের জোগান বন্ধ হয়ে গেলেও করতে পারে সিরিফ ভয় দেখানোর জন্য। ওই একটি বোমার যা দাম, তাতে গোটা গাজার সমস্ত মানুষকে দশদিন পেট ভরে চারবেলা খাওয়ানো যায়। ইথিওপিয়ায় ইউএন কবে, কোথায়– বা আদৌ– ত্রাণ বোঝাই প্লেন পাঠাবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চালানোর সময় সীমায় যে ক’বহর মার্কিন কন্টেনার অতলান্তিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরে খাদ্যশষ্য ফেলেছে, তা দিয়েও আফ্রিকার সমগ্র নিরন্ন মানুষদের কয়েক বছর খাওয়ানো যেত। যুদ্ধের আশ্চর্য সব অছিলা আর মুনাফার নতুন নতুন যুক্তি তৈরি করে চলা বাজারের মাঝে ফেঁসে যাওয়া সাধারণ মানুষের সন্তান শুকনো মাটিতে উবু হয়ে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করে– কিছু দূরে অপেক্ষা করে শকুন, আর তারও পরে, ফোকাসের বাইরে আরও অনেকে। যে বাচ্চাটা এখনও জন্মায়নি, যে কেবল দিন গোনে, তার জবানিতে নিকোলাস গিয়েন লিখে চলেন ‘তোমার আছে বন্দুক, আর আমার কেবল ক্ষুধা।’

…পড়ে নিন নিরন্নর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১: না খেতে পাওয়ার দিনলিপিতে সকলেই ‘উদ্বাস্তু বাঙাল’

পর্ব ২: এদেশে এখনও বিয়ের পর বেশিরভাগ মেয়েদের আধপেটা খেয়ে থাকাই রেওয়াজ