Robbar

সালোঁ-র ইতিহাস কৃষ্ণাঙ্গদের ব্রাত্য করে রাখেনি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 8, 2025 7:26 pm
  • Updated:December 8, 2025 7:26 pm  

ফরাসি বিপ্লব ঘনিয়ে আসার আগে থেকেই ইউরোপের উঁচু তলার মহিলাদের সঙ্গী হিসেবে এঁদের একটা অংশ অভিজাত সমাজে ঘরাফেরা করছিলেন। না হলে প্যারির সালোঁতে সেনেগালের ম্যুলাটো ক্রীতদাস মায়ের সন্তান বিরাট প্রতিভাধারী সংগীতজ্ঞ জোসেফ বোলোনিয়া, শেভালিয়ার দ্যু স্যঁ এরজে (১৭৪৫-১৭৯৯) আর লন্ডনে আফ্রিকা-ক্যারিবিয়ানের ক্রীতদাস নাচে গানে তুখোড় ফেন্সিং চ্যাম্পিয়ন জুলিয়াস সউবিস (১৭৫৪-১৭৯৮) আসতে পারলেন কোথা থেকে?

ঈপ্সিতা হালদার

৬.

এই রিড বিটউইন দ্য লাইনসের চক্করে পড়লে যা হয়, ইতিহাসে ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে দেওয়া জিনিসগুলোর আঁচ পাওয়া যায়। তা সেইবার নেদারল্যান্ডের দ্য হেগ শহরে মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে বিটউইন দ্য রয়াল ডাচেস কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র দেখতে পেয়ে ষোল-সতের শতক যে ওলন্দাজদের দাসপ্রথার স্বর্ণযুগ সে নিয়ে আলাদা করে গবেষণাপত্র পড়তে হয়নি। তবে রং-য়ের কনট্রাস্ট-পরিপূরকতা ও আলো অন্ধকারের প্রাবল্য-সূক্ষ্মতা ক্যানভাসে নিয়ে আসার জন্য সেই সময়ে শিল্পীদের যে আগ্রহ, তাতে অনেকসময়ই একজন কালো বালকের (ও বালিকার) উপস্থিতি ক্রাফট ও আঁকার বিষয়কে এক করে দিয়েছিল। দাসপ্রথায় নিজস্ব ফাইফরমাশ খাটার জন্য বালক ক্রীতদাস রাখা অভিজাত সমাজে মানের চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ডাচ-ডাচেসদের তো কথাই নেই। ফলে কালো দাসবালক হয়ে দাঁড়ায় সতের শতক থেকে ওলন্দাজ চিত্রশিল্পের বাঁধা-ধরা চরিত্র। সে প্রভুর হেলমেট ধরে থাকা থেকে, বিরাট পরিবার আউটিং-এ গেলে মাঝবরাবর ঝুপসি আঁধার কোনায় তথৈবচ অন্ধকার ঘোড়াবরদার কালো বালক, বা ডাচেস মেরি স্টিউয়ার্টের সঙ্গে লেজুড়। এদের দেখলে বোঝা যায়– একদম মাঠে-ঘাটে-খেতে খনিতে বারবাড়ি দেউড়িতে, লোহার রড চাবুক বাঁশ ও বন্দুকে অনাহারে, যৌন অত্যাচারে পিষে রাখা ক্রীতদাসদের থেকে এদের অবস্থান আলাদা ছিল। বিশেষত মহিলাদের সঙ্গে যে সব বালক, তাদের কানের গয়না আর গায়ের রঙিন মখমল দেখে বোঝা যায়, ঘরে-বাইরে সঙ্গে সঙ্গে থাকার জন্য এদের পেশযোগ্য করে রাখা হত। এমনকী মারি স্টিউয়ার্টের বা ফরাসি কলোনি হাইতিতে মাদমোয়াজেল ডেসগো-র সঙ্গের কিশোরটির শারীরিক নৈকট্য লক্ষণীয়। 

না, এখানে কোনও শারীরিকতা উল্লঙ্ঘনের ইশারা পড়ে গল্পকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করা আমার একেবারে ঠিক হবে না। সেই প্রলোভন দমিয়ে এক্ষেত্রে বরং পড়া ভালো যে, কালো বলে এই বালকদের যৌনতার অধিকারী ভাবা হত না। ক্রীতদাস ও পোষমানানো ঘরেলু প্রাণীর মাঝামাঝি ছিল এদের অবস্থান। শিশু থেকে বালক, এরাই টাইপ হিসেবে একের পর এক ছবিতে। হুজুর বা মালকিনের প্রতি কালো বালকটির ঠিক খ্রিস্টীয় ছবির ভক্তিমাখা সমর্পিত তদ্গত মুখের ভাব একটু নিচু থেকে ওপরে মালকিনের একটা ভিজুয়াল ট্রোপ হয়ে যায়। তা দিয়ে রেসের প্রভুত্বও সুন্দর অবলীলায় প্রতিষ্ঠিত।

ডাচেস মেরি স্টিউয়ার্ট

তবে এই কাহনে ‘হাউ ডু দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক’ বা আদৌ তারা কথা কয় কি না জানতে গেলে এইবার আমাদের সালোঁর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। প্রাচ্যবাদী ছবির ধারায় কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুরুষের কমতি নেই। কিন্তু আপাতত তা সরিয়ে রেখে, চলুন ক্রীতদাস থেকে খানসামাদের আলাদা করি প্রথমে। আমরা দেখেছি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মাতিসের ছবিতে একাকী এলিয়ে পড়া মহিলার জন্য কফির পেয়ালা নিয়ে এসেছে যে কালো পুরুষ, সে বাইরে ক্যাফেতেও কাজ করছে। খুব মনোগ্রাহী ভিজুয়াল সাবজেক্ট সে। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম যে, এই সব ছবিতে ইউরোপ আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসর কী করে কফি নামক পানীয়ের নতুন স্বাদে গন্ধে ভরে উঠছে, ক্রমে যা ক্যাফে কালচারে পরিণত হয়ে শহরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলে দেবে, এই নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে ভাবতে সামাজিকতায় আগত কালো মানুষটির আর কী কী ইতিহাস কী হতে পারে সে-সব নজরই করিনি। 

ফরাসি বিপ্লব ঘনিয়ে আসার আগে থেকেই ইউরোপের উঁচু তলার মহিলাদের সঙ্গী হিসেবে এঁদের একটা অংশ অভিজাত সমাজে ঘোরাফেরা করছিলেন। না হলে প্যারির সালোঁতে সেনেগালের ম্যুলাটো ক্রীতদাস মায়ের সন্তান বিরাট প্রতিভাধারী সংগীতজ্ঞ জোসেফ বোলোনিয়া, শেভালিয়ার দ্যু স্যঁ এরজে (১৭৪৫-১৭৯৯) আর লন্ডনে আফ্রিকা-ক্যারিবিয়ানের ক্রীতদাস নাচে গানে তুখোড় ফেন্সিং চ্যাম্পিয়ন জুলিয়াস সউবিস (১৭৫৪-১৭৯৮) আসতে পারলেন কোথা থেকে? 

অত দলিলপত্র নেই, তবে ঐতিহাসিকেরা যেটুকু উদ্ধার করেছেন তা থেকে বলা চলে যে, জোসেফের মা নানোন ছিলেন ক্যারিবিয়নের ফরাসি কলোনি গুয়াদেলোপের বিরাট প্লানটেশান মালিক ইতালির বনেদী পরিবারের বোলোনিয়া দ্যু স্যঁ এরজের বাড়ির ক্রীতদাস। যখন বোলোনিয়া দ্যু স্যঁ এরজে সস্ত্রীক প্যারিতে চলে আসেন, নানোন ও সাত বছরের জোসেফকেও সঙ্গে আনেন। ফরাসি দেশে সেই সময়ের পলিসি অনুযায়ী তাঁরা স্বাধীন হিসেবে চুক্তিপত্র হাতে পান। বোলোনিয়া দ্যু স্যঁ এরজে জোসেফকে নিজের নাম দেন ও তাঁর সহজাত প্রতিভা খেয়াল করে তাঁকে সংগীতের উচ্চশিক্ষায় পাঠান। যদিও অনেক সময়েই কৃষ্ণাঙ্গ বলে তাঁকে কনসার্টে কন্ডাকটর হিসেবে মেনে নিতে রাজি হননি অনেক সংগীতবাদক। পদে পদে বৈষম্য হয়েছে। কিন্তু তাতে করে জোসেফের অতুলনীয় প্রতিভা ঢেকে রাখা যায়নি। এবার আমাদের অবশ্যই ঘোর আপত্তি আছে তাঁকে সম্মান দিতে তাঁর সময়সাময়িক মোৎজার্টের সূত্রে তাঁকে ‘ব্ল্যাক মোৎজার্ট’ বলে ডাকায়। আমাদের স্পষ্ট মনে হয় এতে রেসিজমই দু’গুণা প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু কে কার কথা শুনছে! সে যাই হোক, ‘শেভালিয়ার’ (২০২২) ফিল্মটি জোসেফ ও মোৎজার্টের মধ্যে মিউজিক ডুয়েল দিয়ে বেশ ঘন ঘোর ভাবে শুরু হলেও আদতে এরকম কোনও ঘটনার কথা জানাই যায় না। তবে মিউজিক হিস্টোরিয়ানরা যে বলে থাকেন প্যারির কনসার্ট কম্পোজিশন থেকে মোৎজার্ট বেশ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, সেই সময়ে তো প্যারিতে মূলত জোসেফ শেভালিয়ারের সৃষ্টি দারুণ প্রভাব ফেলেছিল।

‘শেভালিয়ার’ (২০২২)

জোসেফ শেভালিয়ার অদম্য। তিনি আবার দারুণ অ্যাথলিট ছিলেন। ঘোড়ায় চড়ায় অতি দক্ষ। ফেনসিং-য়ে তিনি এমন বিদ্যুচ্চমক হয়ে ওঠেন আর ১৭ বছর হতে না হতে ইয়োরোপের যতেক মাস্টারকে ডুয়েলে এমন হেলায় হারিয়ে ফেলেন যে তাঁকে ষোড়শ ল্যুই কোর্টে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কূটনৈতিক পদ দেন। এর ফল হয় দুটো। প্রথমত সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী আফ্রিকি ও ম্যুল্যাটো ক্রীতদাস ও একদা ক্রীতদাসদের যে ফরাসি সামরিক বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল, বিদ্রোহের সময় জোসেফ শেভালিয়ারকে তার উঁচু সামরিক পদে যেতে হয়। পরে গিলোটিনে না চড়তে হলেও, বাস্তিলে বছর খানেক বন্দি থাকেন জোসেফ। 

তবে আমাদের দরকার অন্য। যখন ভোলতেয়ার এক এক রেসের জৈবিক উৎস এক এক– এই নতুন তত্ত্ব এনে রোম্যান ক্যাথলিক বিশ্বাসে আঘাত হানলেন, সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণাঙ্গ রেস শ্বেতাঙ্গদের থেকে কত হীন এই প্রমাণও দিলেন। আলোকপ্রাপ্তির সেই সুমহান দর্শনের কালে সবার মনেই স্থির বিশ্বাস ছিল যে, দাসপ্রথা প্রাকৃতিক নিয়মেই ন্যায্য। সেই কালে সংগীতবেত্তা আর বেহালায় সিদ্ধহস্ত জোসেফ যে পদমর্যাদা ও অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন সালোঁতে, অর্থাৎ ফরাসি উচ্চকোটিতে– তা খেয়াল করার। তিনি তাঁর প্রতিভার জোরে উচ্চকোটির একজন হয়েছিলেন। তিনি শুধু মারী আতোয়াঁনেতের সংগীত শিক্ষক ছিলেন না, মারী ছিলেন তাঁর অতি গুণগ্রাহী। তাঁর সংগীত, নাচে পটুত্ব, ফেন্সিং, বন্দুক চালানোয় অব্যর্থ দখল তাঁকে এই সময়ের ইতিহাসে অবিসংবাদী ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে। এই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতোই ফ্রান্সে বিপ্লবের সমসময়ে আমেরিকার আরেক কূটনীতিক দূত আর অনুরূপ সালোঁবাজ আর্থার লী জোসেফ, শেভালিয়ারের অদম্য গুণাবলীতে একেবারে হতবাক হয়ে যান। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসের কাছে জোসেফের এমন ভূয়সী প্রশংসা করেন যে অ্যাডামস ডায়েরিতে লেখেন– ‘Lee gave Us an account of St. George at Paris, a Molatto Man,… the most talented man in Europe in horse-riding, shooting, fencing, dancing and music’ (১৭৭৯)।

জোসেফ শেভালিয়ার, ১৭৮৯

কূটনীতিগত কাজ নিয়ে আমাদের জোসেফ শেভালিয়ার পৌঁছন লন্ডন। ১৭৭৯-৮২ ধরে দু’ দফায় অনেকটা সময় তিনি লন্ডনে কাটান। তত দিনে লন্ডনের সালোঁ মহল আগাপাশতলা তোলপাড় করে দেওয়া গুণনিধি জুলিয়াস সউবিসকে জাহাজে তুলে মানে মানে পাচার করে দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। যদিও গোরাদের অত্যাচার বনাম দেশপ্রেম টাইপের উপাদান খুঁজে বের করা যাবে না বলে সেই দুর্ধর্ষ জীবন ও সময় নিয়ে আমাদের দেশে কোনও বায়োপিক হবে না। এই সূত্রে বলতেই হবে তাঁর পাশে জোসেফের জীবন কম নাটকীয়। এবং যাকে বলে বেশি প্রপার। তাই ‘শেভালিয়ার’ সিনেমা বানাতে গিয়ে পরিচালক তো সাফ বলেই দিয়েছিলেন, দিল খুলে একটু তেলমশলা না-মেশালে হলিউড নেবে না। তা আমরা তাতে কিছু মনে করিনি। মুখরোচক গসিপ ছাড়া বিনোদনের মানেটাই বা কী! আর একবার জোসেফকে কিছু লোক ছুরি নিয়ে হামলা করায়, সেই সময়ের গপসপের ট্যাবলয়েড ‘মেমোয়ার্স সিক্রেটস’ লেখে যে জোসেফ শেভালিয়ার আর মারকুইস মারি-জোসেফিন মঁতল্যাম্বার্ত প্রেম করছিলেন বলে, ঈর্ষাকাতর স্বামী মারকুইস দ্য মঁতল্যাম্বার্ত সুপারি কিলার লাগিয়েছিলেন। যদিও মারকুইস যে কত স্ত্রী-প্রেমে মগ্ন এমন পরিচয় কোথাওই পাওয়া যায়নি। আর যে সালোঁ-লেডিদের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের জমানায় জোসেফিনের সালোঁ প্যারিতে বিশেষ রমরমিয়ে চলছে, তখন পতিদেবতার এই ধরনের ড্রামা আমাদের অনাবশ্যকই মনে হয়েছে। জোসেফের জীবনে মসল্লা মাখিয়ে হলিউডে হিট করানোর মতো এটাও হয়ত ট্যাবলয়েডীয় রেসিপি হবে। গসিপ কলাম ছাড়া এই ছুরি মারা এটসেটেরার কোনও পুলিশি রেকর্ডও মেলে না। তবে মশলা মাখানোর জেরে জোসেফ আর মারকুইস মারি-জোসেফিনের এক অবৈধ সন্তান হয়। যে প্যারিতে অবৈধ সন্তানরা বেশ করে খাচ্ছেন, বাবারা নাম বা লেখাপড়ার খরচ সবই দিচ্ছেন, এমনকী স্ত্রীর কাছেও রেখে দিচ্ছেন বা আর কিছু না হলে তাদের চার্চের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কে জানে এই জোসেফ শেভালিয়ারের অবৈধ সন্তানটি (যদি সে আদৌ জন্মে থাকে) বিশেষ কী অপরাধ করল যে, তার বাবা, মা, মায়ের স্বামী সবাই তার উপর অতি নৃশংস হয়ে প্রেক্ষাগৃহ চোখের জলে আকুল করে ছাড়ল!

‘শেভালিয়ার’ (২০২২) ফিল্মে জোসেফ শেভালিয়ার আর মারকুইস মারি-জোসেফিন

তবে জোসেফ শেভালিয়ারের ওপর ছুরি নিয়ে হামলা করার একটা পুলিশি নজির আছে। সেটা লন্ডনে। ঐতিহাসিকরা বলেন, অভিজাত মহলের একজন হয়ে ওঠা জোসেফের দাসপ্রথা বিরোধী অবস্থানের জন্য তাঁকে আক্রমণ করা হয়। কিন্তু সেই দল জোসেফের বিদ্যুৎগতি বিষয়ে সম্যক জানলে নিশ্চয়ই আরও প্রস্তুতি নিয়ে আসত। জোসেফ প্যারিতেই Société des Amis des Noirs (কৃষ্ণাঙ্গদের বন্ধু সমিতি) এই দাসপ্রথা বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি সেখানের দাসপ্রথার বিলোপ আন্দোলনের বিশেষ নেতা উইলিয়ান উইলবারফোর্স ও টমাস ক্লার্কসনের সঙ্গে Sociétéর পদক্ষেপের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করতেন। ইশতেহারগুলি ওঁরা এক সঙ্গে ইংরিজি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করছিলেন। জোসেফ প্যারিতে ফিরে সেগুলি ছড়িয়ে দিতে থাকেন। 

সেইসময় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মহিলাদের শিক্ষার অধিকার না থাকলেও, লন্ডনে বুদ্ধিবৃত্তির জগতে ও নারী অধিকার আন্দোলনে অভিজাত মহিলাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আর সেই সময় উইলবারফোর্স ও ক্লার্কসনের সংগে লন্ডনে সালোঁতে জড় হয়ে হানা মোর (১৭৪৫-১৮৩৩) দাসপ্রথা নির্মূলে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। অনবরত লেখালেখি করে, প্যামফ্লেট ছাপিয়ে ছড়িয়ে এঁরা দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়ে সমাজে যে সমানাধিকার চাইছিলেন, সেখানে মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ, ভোটাধিকার সব কিছুর দাবি প্রবলভাবেই ছিল। মহিলাদের অধিকারের প্রশ্ন ব্লু স্টকিং মুভমেন্টের মধ্যে দিয়ে সমানে উঠছে তখন। ফ্যাশান নয়, বুদ্ধিবৃত্তি। যখন মেয়েদের জন্য শিক্ষা বলতে বরাদ্দ ছিল খালি সূচিশিল্প, মেরি বেরি ও এলিজাবেথ রবিনসন মন্টেগু চালিত সালোঁতে যে ব্লু স্টকিং লেখক কবিরা আসতেন, তাঁরা শিক্ষা, সামাজিক প্রতিস্থানে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির জ্ঞান ও ভোটাধিকার চাইছিলেন। রিচার্ড স্যামুয়েলের ‘Portraits in the Characters of the Muses in the Temple of Apollo’ ছবিতে এঁদের মুখ্য সব চরিত্রকেই দেখা যায়। ঠিক, যে নামটি এই প্রসঙ্গে মাথায় চলে এসেছে সেই মারী উলস্টোনক্রাফট (১৭৫৭-১৭৯৭), তিনিও এই সময়ের। তবে তাঁর সঙ্গে হানা মোর, ব্লু স্টকিং বা অন্য কোনও সালোঁর গভীর যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায় না। আর হানা, উইলফোর্স এঁরা বিশেষভাবে ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল অ্যাংলিকান ভাবধারার ছিলেন। উলস্টোনক্রাফট ছিলেন অন্য ধারায়, টমাস পাইনের সঙ্গে, আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদী গোষ্ঠীতে। 

কবি ও লেখক অ্যানা লেটিশিয়া বারবোল্ড, স্কলার ও লেখক এলিজাবেথ কার্টার ও এলিজাবেথ গ্রিফিথ, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক অ্যাঞ্জেলিকা কফমান, পেইন্টার শারলট লেনক্স, ঐতিহাসিক ও রাজনিতিবিদ ক্যাথ্রিন মেকলে ও এলিজাবেথ মন্টেগু, হানা মোর

এতদূর এসে আমরা যদি ভেবে থাকি যে স্টিফ আপার লিপ লন্ডন তাহলে প্যারির মতো প্রগল্‌ভ নয়, খুব একটা ভুল ঠাউরাইনি। তবে ঘোড়দৌড় বা ফেন্সিংয়ে উত্তেজনা কম ছিল না। আর যেখানে মেয়েদের ভোট দেওয়ার বা লেখাপড়ার অধিকার নেই, সেখানে ফেন্সিংয়ের অডিয়েন্সে লেডিদের বসে থাকতে দেখে, সত্যি বলছি, হাঁ হয়ে গেলুম। চার্লস জীন রোবিনিউ-র যে পেইন্টিংটি দেখে লেডিদের উপস্থিতির কথা বললাম সেই ফেন্সিং প্রদর্শনটি হয়েছিল জোসেফ শেভালিয়ার স্যঁত এরজের সংগে মাদমোয়াজেল দ্য’এওন-এর। সেখানে প্রিন্স অফ ওয়েলস জর্জও উপস্থিত, কারণ ফেন্সিং হচ্ছে কার্লটন হাউসে, তাঁরই বাড়িতে। ফেন্সিং কলা দেখানোয় অন্যপক্ষ শার্লোতে দ্যু’এওন বা শার্ল দ্যু’এওন ইংল্যান্ড ও রাশিয়ায় ফরাসি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। নারী পুরুষ দুই রকম (সাজে) ভাবেই সমাজে স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করতেন। নারী হিসেবে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের দরবারে থেকে অনেক কূটনৈতিক গুপ্ত কথা জেনে নিয়েছিলেন মাদমোয়াজেল দ্য’এওনে। শেষে ১৭৭৭ থেকে পুরোদস্তুর মহিলা হিসেবেই তিনি থাকতে শুরু করলে ষোড়শ ল্যুই তাঁকে মহিলা স্বীকৃতি দেন। জোসেফের সংগে তাঁর ফেন্সিং হয়েছিল ১৭৮৭-তে।

ডুয়েল লড়ছেন জোসেফ শেভালিয়ার। শিল্পী: আলেক্সান্দ্রে অগাস্তে রোবিনিউ

প্রথমে মনে হয়, এ কেমন গুলিয়ে দেওয়া ব্যাপার! লেখাপড়া, রাজনীতি, ভোট দেওয়ায় বা রাষ্ট্রের কোনও বিষয়ে যোগ দেওয়ার অধিকার নেই। কিন্তু ইতালির লেজেন্ডারি মাস্টার দোমেনিকো অ্যাঞ্জেলো ১৭৬৩-তে সোহো স্কোয়ারে যে ফেন্সিং অ্যাকাডেমি খুলেছিলেন, সেখানে মেয়েদের ট্রেনিং-এর চল ছিল। যদিও মেয়েরা ফেন্সিং করছেন সেরকম কোনও ছবিই আর্কাইভে মেলেনি। আর জেমস গ্যয়িন চিত্রিত দোমেনিকোর যে সচিত্র ফেন্সিং শিক্ষার বই, তার সব ক’টা ছবি বারবার দেখেও পোশাক হেলমেট পরা কোনও খেলোয়াড়কেই ঠিক মহিলা চরিত্র বলে চিনতে পারলাম না। শেষে অনেক খুঁজে জুলিয়া গ্লোবিন নামে এক দাপুটে অভিনেত্রীর কথা জানতে পারলাম, যিনি দোমেনিকোর অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং নিতেন। জুলিয়া স্টেজে ফেন্সিংও দেখাতেন। দোমেনিকোর ছেলে হেনরি অ্যাঞ্জেলোর হাতে অ্যাকাডেমির দায়িত্ব গেলে এই ধারা চলতে থাকেই। লন্ডনের স্টেজ অভিনেত্রীরাই মূলত অ্যাকাডেমিতে আসতেন। মানে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত বাড়ির মেয়েরা দর্শকাসনে। মানে আসলে ব্যাপারটা তত গুলিয়ে দেওয়া নয়।

তবে আঠেরো শতকের ইউরোপের সদর-অন্দরের যাবতীয় দেওয়াল ভেঙে একজন লেডির ফেন্সিংরত ছবি আমরা দেখতে পাই। লন্ডনে তাঁরও ছিল সালোঁ। তিনি ক্যাথেরিন হাইড, দ্য ডাচেস অফ ক্যুইন্সবেরি। যার সৌন্দর্য, উইট আর ফ্যাশানে মুগ্ধ ছিলেন জোনাথন স্যুইফট, জন গে (যার লেখা স্যাটায়ার ‘দ্য বেগার’স অপেরা’ থেকেই ব্রেখশট লেখেন ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’), অ্যালেক্সান্ডার পোপ থেকে সেই সময়ের তাবড় লেখকরা। ক্যাথেরিনকে সালোঁ সার্কিটে ‘কিটি ডগলাস’ নামে ডাকা হত। 

ক্যাথেরিন হাইড, দ্য ডাচেস অফ ক্যুইন্সবেরি

হোরেস ওয়ালপোল, যিনি ওই সময়ের মেধাবি মহিলাদের খুঁজে বের করে তাঁদের সঙ্গে মেধা চর্চা করছিলেন, তিনি বলেন, ‘ভাগ্যিস আমার আর কিটির মাঝখানে টেমস বয়ে যাচ্ছে, নাহলে কী যে করে বসতাম জানি না’। ১৭২২-য়ে কিশোরী ক্যাথেরিনের সমাজে আত্মপ্রকাশ করা মাত্র যে উল্লাস ও দীর্ঘশ্বাস, তা অনেক ছড়ায় ধরা আছে। সেগুলো আবার লিফলেটে ছাপাও হত। 

Thus Kitty, beautiful and young,
And wild as colt untam’d,
Bespoke the fair from whence she sprung,
With little rage inflam’d:

Inflam’d with rage at sad restraint,
Which wise mamma ordain’d;
And sorely vext to play the saint,
Whilst wit and beauty reign’d. …

Fondness prevail’d, mamma gave way;
Kitty, at heart’s desire,
Obtain’d the chariot for a day,
And set the world on fire.

[‘The Female Phaeton’, Matthew Prior]

এবং শুধু পুরুষরাই নন। ব্লু স্টকিং-য়ের অন্যতম সদস্য এলিজাবেথ রবিনসন মন্টেগু অবধি বলেন, এই অতুলনীয় সৌন্দর্য ধ্রুপদী ছবির। স্তুতি ও প্রশস্তির এহেন লেডি ক্যাথেরিনকে আমরা উইলিয়াম অস্টিনের ১৭৭৩-এর ব্যঙ্গচিত্রে প্রবল উদ্যমে জুলিয়াস সউবিসের সঙ্গে ফেন্সিংরত দেখি। ক্যাথেরিনের মুখ ফেন্সিং মাস্কে ঢাকা। কেতার পোশাকে জুলিয়াস। তলোয়ার ঠিক ক্যাথেরিনের বুকের মধ্যিখানে ঠেকিয়ে জুলিয়াসের সংলাপ, “Mungo here Mungo dere, Mungo Ev’ry where, above, & below Hah! Vat your Gracy tink of me Now”। লন্ডনে সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ চাকরদের হীন ভাবে ‘মুনগো’ বলে ডাকা হত। ছবির নাম ‘The Duchess of Queensberry Playing at Foils with her Favorite Lap Dog Mungo’। কুৎসিত আক্রমণ কোথাও অপ্রত্যক্ষ বা অপ্রকাশ্য নেই। জুলিয়াস সউবিসের পাশে ফ্লোরে খোলা রয়েছে সেই বছরই ছাপা হওয়া দোমেনিকোর ফেন্সিং শিক্ষার বই। হেনরি ‘দ্য রেমিনিসেন্স অফ হেনরি অ্যাঞ্জেলো’-এ লেখেন যে লেডি ক্যাথেরিনকে ফেন্সিং ও হর্স রাইডিং শেখাতেন জুলিয়াস।

উইলিয়াম অস্টিনের ১৭৭৩-এর ব্যঙ্গচিত্রে জুলিয়াস সউবিসের সঙ্গে ফেন্সিং লড়ছেন ক্যাথরিন

জুলিয়াস সউবিস ১৭৫৪-য় ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ জামাইকার এক স্লেভহাউসে জন্মান । তাঁর মা ছিলেন জামাইকার মানুষ। ক্যাথেরিনের তুতো ভাই রয়াল নেভি-র ক্যাপ্টেন সেখান থেকে ১০ বছরের জুলিয়াসকে এনে ক্যাথেরিনকে উপহার দেন। জামাইকার পোর্ট রয়াল এই ব্রিটিশ বন্দর থেকে লন্ডনে আসার নথিতে জুলিয়াসের নাম ‘ওথেলো’ হিসেবে এনট্রি করা হয়েছিল। সেই সময়ের অভিজাত বাড়ির রীতি অনুযায়ী জুলিয়াস লেডি ক্যাথেরিনের একেবারে ব্যক্তিগত পুষ্যিই শুধু হয়ে ওঠেননি। জুলিয়াস যে অত্যন্ত প্রতিভাধর, এতাবৎকাল গুণীজনের সঙ্গে কাল কাটিয়ে ক্যাথেরিনের সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। তাঁকে দাস থেকে মুক্ত করে পঞ্চদশ ল্যুইয়ের সভার শার্ল দ্য রোহাঁ, প্রিন্স দ্য সউবিসের নামে নাম দিয়ে সোহোয় দোমেনিকোর অ্যাকাডেমিতে ফেন্সিং, ডেভিড গ্যারিকের থিয়েটারে অভিনয় শেখা থেকে হর্স রাইডিং, ভায়োলিনবাদন সবেতে ভরতি করে দেন। আর জুলিয়াস সব কিছুতেই সাঙ্ঘাতিক পারঙ্গমতা দেখিয়ে সব ক’টা আর্টেই একেবারে তুখোড় হয়ে ওঠেন।এই অভিজাত আর্ট ও আদবকায়দায় সেরা হয়ে উঠে একেবারে চরম এক ড্যান্ডি রূপে তিনি লন্ডনের অভিজাত মহলকে দিশেহারা করে দেন। 

নানা সূত্র থেকে জানা যায় বৃদ্ধ বয়সে ক্যাথেরিন জুলিয়াসকে পেয়ে তাঁকে লাই দিয়ে সম্পূর্ণ স্পয়েল করে ফেলেছিলেন। চূড়ান্ত ব্যাদড়া, ডোন্ট কেয়ার, অপরিমিতভাবে শৌখিন, দুই হাতে পাউন্ড ওড়াচ্ছেন, দামি দামি ঘোড়া, পারফ্যুম, লাগামছাড়া চলন, অহংকার মটমটে বলন, নিয়মকানুন আইনকে কলা দেখিয়ে চার ইয়ার নিয়ে লন্ডন মহলকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন জুলিয়াস। হেনরি লিখেছেন, অ্যাকাডেমিতে কী রকম প্রিন্সের চালে থাকতেন জুলিয়াস। মহার্ঘ ফুল দিয়ে ওঁর ঘর সুগন্ধ করে রাখা হত। প্রতিদিন বদলান হত সেই ফুল।

জুলিয়াস সউবিস, ব্যঙ্গচিত্রে

শ্বেতাঙ্গ অভিজাতদের রেস-এর হুড়কোয় বন্ধ মঞ্জিল মহলে জুলিয়াসের এই সব হানো আঘাতে আদতে দ্য এম্পায়ার ষ্ট্রাইক ব্যাক করছিল কি না সে নিয়ে আমাদের আধখানা মনে সন্দেহ হলেও, ক্রীতদাস হিসেবে আঠেরো শতকে জন্মানো একজন কালো মানুষ লন্ডন লেডির আদরে ব্যাদড়া হয়ে সব ক’টা অভিজাত আর্টে দারুন মুনশিয়ানা দেখিয়ে অভিজাত পাড়ায় হল্লা মাচিয়ে কী পরিমাণ অস্বস্তি তৈরি করেছিল– তা সেই সময়ের কার্টুন ক্যারিকেচার ইত্যাদি খেয়াল করলেই জানা যায়। যে কালো মানুষের চরিত্র সাধারণ বিনোদনে নিচু দরের খোরাক, তার শারীরিক নিগ্রহ ব্যথা বেদনা সবই হাসির হররা ছোটায়, তখন লন্ডনের বাড়ির মধ্যে কাউচ আর রাস্তায় রাস্তায় হ্যাকনি ক্যারেজ সব এক ধারসে উল্টে দেন নিশ্চয়ই জুলিয়াস। 

সেই সময় ৭২ বছর বয়েসি ক্যাথেরিন ও তাঁর ১৯ বছরের প্রটিজির মধ্যে নিষিদ্ধ কিছু আবেগ বিনিময় হচ্ছে– এই গসিপে, মুনগো ম্যাকারোনি মানে ‘নিগার চাকর ড্যান্ডি’ হিসেবে জুলিয়াসের কার্টুন– তাঁকে অভিজাত সমাজে জায়গা না দিতে চাওয়ারই চিহ্ন। জুলিয়াসকে লেডি ক্যাথেরিনের ‘ল্যাপ ডগ’ ডাকার মধ্যে রেস, ক্লাস, জেন্ডার সব বিদ্বেষই মিলে জুলে আছে। কিন্তু জুলিয়াস সউবিসকে আমরা ঠিক জোসেফ শেভালিয়ার বোলোনিয়ার মতো একটা প্রতি-আখ্যান বলে পেশ করে উঠতেই পারছি না। জুয়া খেলে টাকাপয়সা উড়িয়ে ধারদেনা নেশাভাং উচ্ছৃঙ্খলতার সব নমুনা নিয়ে লেডি ক্যাথেরিনকে একে বারে নাজেহাল করে ছেড়েছিলেন জুলিয়াস। শেষে যখন লেডির বাড়ির মধ্যে ১৭৭৭-এ তাঁর এক পরিচারিকাকে জুলিয়াস ধর্ষণ করেন, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁকে বিষম শাস্তি পাওয়া থেকে ক্যাথেরিন বাঁচান বটে, কিন্তু শোধরানো অসম্ভব বুঝে তাঁকে তুলে দেন কলকাতাগামি জাহাজে। ক্যাথেরিন অবিলম্বে অসুস্থ হয়ে পড়ে দু’ দিনের মধ্যে মারা যান। কলকাতায় সে এক ভীষণ রোমহর্ষক গল্প। 

জুলিয়াস সউবিস, প্রতিকৃতি

কিন্তু আমরা আমাদের পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসছি। এই যে ফরাসি বিপ্লবের কালে জোসেফ শেভালিয়ার প্রদর্শনী ফেন্সিং ম্যাচ খেলে বেড়াচ্ছেন, বিপ্লবে তিনি ষোড়শ ল্যুইয়ের হয়েই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়বেন। এতে কি সত্যিই সাবঅলটার্নের কথা কওয়া হয়? এই আলোচনার, বলাই বাহুল্য, সহজ হ্যাঁ বা না-তে হয় না। স্লেভারি বিলোপের আগে জোসেফ শেভালিয়ার একদা দাস হয়েও অভিজাত সমাজে যে নিজের ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠা নিয়েছেন, যেখানে রাষ্ট্রের পলিসি অনুযায়ী ক্রীতদাস বা একদা ক্রীতদাসদের রেজিমেন্টে তাঁকে থাকতেই হবে। সেইখানে জোসেফ বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়াতে পারতেন কি? এই সময় এই সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছাড়া নিজে ক্রীতদাস হলে জোসেফ কি দাসপ্রথা বিলুপ্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন? বিপ্লবের পক্ষে না লড়লেও, অবশ্যই ফ্রান্সে ১৭৯৪-এ দাসপ্রথা সাময়িকভাবে বিলুপ্ত করায় জোসেফ শেভালিয়ারের অবদান ছিল। প্রসঙ্গত নেপোলিয়ন ১৮০২-য়ে আবার দাসপ্রথা চালু করে দেন। 

কিন্তু এখানে জোসেফ শেভালিয়ারের কথা বলতে বলতে আমাদের হঠাৎ জোরা নেইল হার্সটনের কথা মনে পড়ে গেল। জোরা (১৮৯১-১৯৬০) ব্ল্যাক-আমেরিকান গদ্যলেখক, অ্যানথ্রোপলজিস্ট, লোককথা সংগ্রাহক। ডকুমেন্টারি ছবিও বানিয়েছেন তিনি। সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত আমেরিকী শ্বেতাঙ্গরা মানব-হিতৈষণা অনুযায়ী ব্ল্যাক-আমেরিকান ছাত্র-লেখক শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জোরা সেই সাহায্যেই কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটে আফ্রিকার গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঘুরে ফোকলোর সংগ্রহ গবেষণা করেন। সেটা হারলেম রেনেসাঁসের সময়। কিন্তু হারলেমের মুখ্য দুই আইকন– উইলিয়াম এডওয়ার্ড বি দ্যু বোয়া ও ল্যাংস্টন হিউজেস দু’জনেই জোরার লিখন ভঙ্গিমা পছন্দ করেননি। এবং সরাসরি বলেছেন যে হারলেম আন্দোলনে মূল যৌথ প্রতিবাদী সুরের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে জোরা শ্বেতাঙ্গ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লিখেছেন। 

জোরা নেইল হার্সটন

এর ঠিক আগের এপিসোডেই প্যারির সালোঁ-র ভাবসাব থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম এখন অতলান্তিক পেরিয়ে নিউ ইয়র্কে গিয়ে না পৌঁছলে ইতিহাস গড়িয়ে কোনদিকে চলেছে, আমরা সেটার একেবারেই খেই ধরতে পারব না। তাই আমাদের যাত্রা এইবার ম্যানহাটনের উত্তর দিক, হারলেম সালোঁয়। 

… পড়ুন চিন্তামহল-এর অন্যান্য লেখা …

পর্ব ১: চলতি পরিবার ধারণার বাইরের মেয়েদের বেঁচে থাকার জমকালো মঞ্চ প্যারির সালোঁ

পর্ব ২: এনসাইক্লোপিডিয়ার বিপুল কাজ জিন জুলির সালোঁতেই রমরম করে চলতে শুরু করেছিল

পর্ব ৩: মাদাম জারমেইনের বই-ই ইতিহাসে প্রথম, যার পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল শাসক

পর্ব ৪: মাতিস আর পিকাসোর ইগোর লড়াই

পর্ব ৫: মহিলা-চালিত স্ট্রিট বুকশপ থেকে পাবলিক লাইব্রেরি