Robbar

আমাদের চৈতন্য হবে কবে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 14, 2025 1:08 pm
  • Updated:December 14, 2025 2:22 pm  

ভাঙা বাড়ি, কিন্তু তার ভেতরেই এক রত্নশালা। খসে পড়া দরজার ফাঁকে উঁকি দিলেই ধুলোয় ঢাকা কত যুগ আগেকার মণিমাণিক্য সব দেখতে পাচ্ছি! একের ওপর আরেক, তারও ওপর আরও অনেক, স্তূপীকৃত! নড়বড়ে দোতলায় হাঁটতে ভয় হয়, অন্ধকার সিঁড়ি কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! এই নাকি সেই জ্ঞানভাণ্ডার, যা উন্মোচিত হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হাতে! সঙ্গে ছিলেন স্যর আশুতোষ চৌধুরী, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আচার্য রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। মিনার্ভা থিয়েটারের পাশে প্রায় দেড়শো বছর বয়স ছুঁতে চলা চৈতন্য লাইব্রেরির কথা বলছি, এক দুষ্প্রাপ্য বিরল বইয়ের খোঁজে যেখানে হঠাৎই হানা দিয়েছিলাম আমি।

প্রতিভা সরকার

আমাদের চৈতন্য হবে কবে? আমাদের স্বনামধন্য পূর্বজরা চৈতন্যলাভের যে ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, তাকে কি আমরা এইভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি! বিডন স্ট্রিটের প্রাচীন তিনতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এইরকম আক্ষেপে নুয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক।

চৈতন্য লাইব্রেরি। বিডন স্ট্রিট

ভাঙা বাড়ি, কিন্তু তার ভেতরেই এক রত্নশালা। খসে পড়া দরজার ফাঁকে উঁকি দিলেই ধুলোয় ঢাকা কত যুগ আগেকার মণিমাণিক্য সব দেখতে পাচ্ছি! একের ওপর আরেক, তারও ওপর আরও অনেক, স্তূপীকৃত! নড়বড়ে দোতলায় হাঁটতে ভয় হয়, অন্ধকার সিঁড়ি কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! এই নাকি সেই জ্ঞানভাণ্ডার, যা উন্মোচিত হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হাতে! সঙ্গে ছিলেন স্যর আশুতোষ চৌধুরী, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আচার্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। মিনার্ভা থিয়েটারের পাশে প্রায় দেড়শো বছর বয়স ছুঁতে চলা চৈতন্য লাইব্রেরির কথা বলছি, এক দুষ্প্রাপ্য বিরল বইয়ের খোঁজে যেখানে হঠাৎই হানা দিয়েছিলাম আমি।

স্যর আশুতোষ চৌধুরী, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

একদিন উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ সাধারণ পাঠাগারের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক স্বাগতা দাস মুখোপাধ্যায় এক অচেনা কণ্ঠের ফোন পান, ‘দিদি, কিছু করুন। অমূল্য ধন সব মাটিতে মাটি হয়ে যেতে বসেছে!’ পুরনো গ্রন্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাগতা দাস মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহ এবং ভালোবাসা গ্রন্থাগার মহলে সর্বজনবিদিত। তাই হয়তো তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন সেই অচেনা গ্রন্থ-প্রেমিকটি, পরে দেখা যায়, তিনি চৈতন্য লাইব্রেরি ট্রাস্ট এবং ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য। ঠিক জায়গায় পৌঁছেছিল তাঁর ডাক, কারণ তারপর থেকেই চলছে এক অসম যুদ্ধ। সর্বশক্তিমান মহাকালের রথচক্রের পেষণ আর মানবীয় অবহেলার বিরুদ্ধে গুটিকয় মরণশীল মানুষের প্রাণপণ লড়াই। দেড় লক্ষ বই এবং পত্রিকার মধ্যে নষ্ট হয়েছে অনেকটাই। তবু যা আছে তার মধ্য থেকে ইতোমধ্যেই উদ্ধার করা গিয়েছে দু’হাজারের বেশি বই এবং প্রায় বারো’শো পত্রিকা। অবাক হয়ে শুনি, এর সবটাই স্বেচ্ছাশ্রমের ফল। না কোনও পৃষ্ঠপোষকতা, না অনুদান, অথবা তহবিল গড়ে পাশে দাঁড়ানো। মাত্র চারজন মানুষের এই অমানুষিক পরিশ্রম চলে সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিনে। সীমিত ক্ষমতা নিয়েও তাদের সঙ্গে সর্বতোভাবে আছেন গ্রন্থাগারের বর্তমান ট্রাস্ট ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা।

অযত্নের ছাপ

শোনা যায়, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় এমন কোনও পত্রিকা নেই, যার কপি চৈতন্য লাইব্রেরিতে এসে পৌঁছত না। তাদের যেসব নিদর্শন এখনও টিকে আছে তার মধ্যে নামকরা সব প্রাচীন সাময়িক পত্রিকা তো রয়েইছে, আরও আছে কত বিচিত্র বিষয়ের ওপর অদ্ভুত নামের পত্রিকা! শুনলে অবাক হতে হয়, পাওয়া গিয়েছে ‘ওরিয়েন্টাল ইন্সিওরেন্স’, ‘কাজের লোক’, ‘বালক’, ‘জীবনবীমা’, ‘পাঠশালা’, ‘স্বর্ণকার বন্ধু’, ‘হুতুম হিন্দু দর্শন’ নামের নানা সাময়িক পত্রিকা। অপ্রচলিত বিষয়ের ওপর সংকলিত সাময়িক পত্রিকার গবেষকের কাছে বিরাট সোনার খনি।

চৈতন্য লাইব্রেরির অন্দরমহল

৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯ সালে এই গ্রন্থাগারের দারোদ্ঘাটন হয়, এটি ছিল অবিভক্ত বাংলায় এই ধরনের প্রথম রেজিস্টার্ড সোসাইটি। স্বাধীনতা লাভের পরও এটিই প্রথম রেজিস্টার্ড গ্রন্থাগার হিসেবে স্বীকৃতি পায়, এমনকী, ন্যাশনাল লাইব্রেরিও এই সম্মানে ভাগ বসাতে পারেনি! শুধু তো বই দেওয়া নেওয়া নয়, আরও কত কী-ই না হত চৈতন্য লাইব্রেরিকে ঘিরে! সেমিনার, সাহিত্য সভাগুলোতে এত স্বনামধন্যদের আগমন হত যে, স্থান সঙ্কুলানের জন্য মিনার্ভা থিয়েটার হল ভাড়া করতে হত। আর যাঁরা বক্তৃতা দিতে বা শুনতে আসতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যর গুরুদাস ব্যানার্জি, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্যর রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, সিস্টার নিবেদিতা প্রমুখ। একবার নোবেল লরিয়েট সি ভি রমন গ্রন্থাগারের ডাকে সাড়া দিয়ে বক্তব্য রাখতে এসেছিলেন।

ভঙ্গুর চৈতন্য লাইব্রেরি

আজ সেখানেই কাজ করতে করতে হালকা আওয়াজে মাথা ঘুরিয়ে স্বাগতাদি দেখতে পান এক কুলোপানা চক্করকে। তার বহুকালের আস্তানায় এত দিন পর আবার মানুষের আনাগোনা কী কারণে দেখতে এসেছিল বোধহয়। তবে তাতে না-দমে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বহু অবাঞ্ছিত আনাগোনা কমেছে, বঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু ক্লাসের বন্দোবস্ত হয়েছে। বই ঝাড়াই-বাছাই তো চলছেই। তবে সেই প্রাচীন গৌরবগাথার কিছুমাত্র অংশ ফিরিয়ে আনতে হলেও দরকার এই শহরের নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা, বহু বহু স্বেচ্ছাশ্রমিক এবং অবশ্যই সরকারি সদিচ্ছা।

আচার্য নন্দলাল বসুর স্বহস্তে অলংকৃত প্রথম এডিশনের ভারতীয় সংবিধানের রিপ্রিন্ট

সেদিনের বাড়তি পাওনা বলতে, আচার্য নন্দলাল বসুর স্বহস্তে অলংকৃত প্রথম এডিশনের ভারতীয় সংবিধানের রিপ্রিন্ট দেখতে পারা। গণপরিষদের সদস্যদের স্বাক্ষর দেখে আপ্লুত হই! এই অলংকৃত সংবিধানের মূল কপিটি সংরক্ষিত আছে খোদ সংসদ ভবনের গ্রন্থাগারে। ওটি মূলত হাতে লেখা এবং হাতে আঁকা মূল পাণ্ডুলিপি, যেখানে গণ-পরিষদের সদস্যদের স্বাক্ষর ও ক্যালিগ্রাফি করা আছে।

দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো মহাগ্রন্থের কপিটিকে ছুঁয়ে থাকি কিছুক্ষণ। এই আমার দেশ, পতন অভ্যুদয় বন্ধুর যাত্রায় তার সারথি তো জনগণ। তাদের সক্রিয়তায় চৈতন্য লাইব্রেরি আবার চৈতন্যের ফিরিওয়ালা হয়ে উঠুক !

………………..
ছবি: লেখক সূত্রে প্রাপ্ত