পৌষমাসে মন্দির প্রাঙ্গণে যে বিরাট মেলা হয়, সেই মাইকে বহুদূর থেকে শোনা যায় একসঙ্গে সৌমিত্র দাস আর আমিরুল ইসলামের নাম। প্রতি মে মাসের আট তারিখ বহরমপুর থেকে ওয়াজেদ হোসেন নামের একটা লোক মন্দিরে এসে পদ্ম ফুল দিয়ে যান মায়ের পুজোতে। পৌষের প্রথম মঙ্গলবার মায়ের গলায় যে রজনীগন্ধার মালা পড়ানো হয়, সেটিও দেন সেই ওয়াজেদ সাহেব। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নিয়মিত পুজো দেন, মানত করেন। পাত পেড়ে খান। মন্দির প্রাঙ্গণে জ্বলজ্বল করে জমিদাতার নাম লুৎফুল হক, রাফিয়া বিবি, সাদেক আলি মণ্ডল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হিন্দু-মুসলমান বলে ওঠে, গর্ব করে বলতে পারি এই গ্রামে, এই মন্দিরে হিন্দু, মুসলমান কেউ আলাদা নয়। সেই সাংবাদিকের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘কীসের কুসুম’-এর উত্তর পেয়ে যাই আমি এখানে এসে।
নদী পেরলেই সুবে বাংলার রাজধানী। বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ নবাবের রেখে যাওয়া কিছু স্মৃতির মন্তাজ। ১৭৫৭ পরবর্তী ভারতের ভবিতব্য এ-পথেই লেখা হয়েছিল। অদূরে সিরাজের সমাধি খোশবাগ। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে আজান থেকে ভেসে আসা সুর আর দিলীপ ভটচাজের সন্ধ্যা-আরতিতে মিশে যাচ্ছে নজরুলের কলম। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল ‘কীসের কুসুম?’ তাদের সপাটে চড় কষিয়ে মন্দিরের সেবায়েত দিলীপবাবু জানিয়ে দিচ্ছেন, ৫১টি সতীপিঠের একটি এই কিরীটেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা নাটোরের রানি ভবানী। পাশেই যে দিঘিটা দেখা যায়, সেটা খনন করে দিয়েছিলেন বাংলার বাদশা মিরজাফর, সে যুগে পানীয় জলের সমস্যার জন্য। আবার মায়ের মন্দিরের ঠিক পাশেই যে মহাদেবের মন্দির রয়েছে, তার জমিদাতার নাম সাদেক আলি মণ্ডল। কথিত আছে, এই মন্দিরের চরণামৃত খেয়েই নাকি মিরজাফরের কুষ্ঠ রোগ সেরেছিল। আর সেই চরণামৃত নবাবের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার।
আমরা সেই কবে ক্লাস ফোরের সাদা-কালো বইতে পড়েছিলাম নজরুলের হিন্দু মুসলমান কবিতা। সুদীপ্ত, সাইফুদ্দিন, সুচেতনারা তখন একই স্কুল বেঞ্চে চেঁচিয়ে পড়েছিল, ‘মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ সেদিন ইদের সিমাইয়ের রথের পাঁপড় যারা একসঙ্গে খেত, আজ তারা হঠাৎই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণার ‘বোনাফায়েড সাপ্লায়ার’। টেলিভিশন সাংবাদিক এমনভাবে ‘কীসের কুসুম’ বলে প্রশ্ন করছেন, নজরুলের উত্তরাধিকারী বলতে গিয়ে অপরাধবোধে ভুগছে আজকের বাঙালি। কাশ্মীর-মুর্শিদাবাদ-বাংলাদেশ– একটার পর একটা ঘটনা, ধর্মের জিগির তুলে যে ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে টিভি ক্যামেরা, সোশ্যাল মিডিয়া– তাতে বাদ যাচ্ছেন না দিন আনা দিন খাওয়া মানুষও। তাই গত বিশ বছর ধরে পাড়ার চা-দোকান চালানো বান্টি ইয়াসমিন, যাকে ছেলেবেলা থেকে বান্টিদি নামেই চিনি, সে আমায় হঠাৎ এক সকালে জিজ্ঞাসা করে, ‘সেক্যুলার মনে কী রে?’, ‘আচ্ছা একটা কথা বল, মুসলমান মানেই টেররিস্ট?’
স্মার্টফোন ঘাঁটার অভ্যাসের বশেই আজকাল হাত চলে যায় ফেসবুকের নীল দেওয়ালে। যাদের কাছে দেওয়াল মানে একদিন ছিল ‘বাঁচতে গেলে লড়া, আর লড়াই করে বাঁচা’, তাদের কাছে এই নতুন দেওয়াল উপহার দেয়, সাম্প্রদায়িকতার পৃথিবী। তারা জানিয়ে দেয় মুর্শিদাবাদে ৬৭% মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, তাই সেখানে সকলে উগ্রপন্থী। প্রাইম টাইমে টিভি সাংবাদিক যেহেতু ধর্ম নিয়ে বিভেদ তৈরি করছে, তাই তার কথাকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে পাড়ার সেই ছেলেটাও ফেসবুকে জানিয়ে যায় মুসলমান মানেই জঙ্গি, যে একদিন আমার, ফারুক আলির সঙ্গেই ভাগাভাগি করে খেয়েছিল শবেবরাতের রাতে ছোলার ডালের হালুয়া। একদিন যে সমাজে খবর হত বাসের ভাড়া বাড়লে, গ্যাসের দাম বাড়লে, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করলে, সে সমাজের আলোচনায় উঠে আসে দোলের দিন নিরামিষ হবে নাকি আমিষ? ‘ওপাড়ার মুসলিমরা ইচ্ছে করে ফজরের নামাজের সময় মাইকের আওয়াজটা জোর করে বাড়িয়ে দেয় জানিস’ ইত্যাদি। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিশ্চুপ থাকে ধর্মে মুসলমান বন্ধু, পাছে ‘বাংলাদেশি’ তকমা জোটে। ওদিকে বাসের ভাড়া বেড়ে চলে। কৃষক দু’-টাকা কেজি বেগুন বেচে, চার টাকা প্রতি পিস লাউ বিক্রি করে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। মাছওয়ালা রবিকাকা অনেক বেলায় একটাও আমুদি মাছ না বেচতে পেরে রবীন্দ্রনাথের স্বরণাপন্ন হয়– ‘ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে…’
ছবিতে দেখা যাচ্ছে যাদের। বাঁদিক থেকে সৌমিত্র দাস, আমিরুল ইসলাম, এবং দিলীপ ভট্টাচার্য। প্রথমজন হলেন মুর্শিদাবাদের কিরীটেশ্বরী মন্দিরের সম্পাদক। দ্বিতীয়জন মন্দির এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। তৃতীয়জন হলেন মন্দিরের সেবায়েত-প্রধান পুরোহিত দিলীপ ভট্টাচার্য। দুর্গা অষ্টমীর মহাপুজোর দিন এই মন্দিরে শোল মাছ আসে আমিরুল বাবুর মাথায় চেপে। মা পূজিতা হন মাছ, মাংসে। পৌষমাসে মন্দির প্রাঙ্গণে যে বিরাট মেলা হয়, সেই মাইকে বহুদূর থেকে শোনা যায় একসঙ্গে সৌমিত্র দাস আর আমিরুল ইসলামের নাম। প্রতি মে মাসের আট তারিখ বহরমপুর থেকে ওয়াজেদ হোসেন নামের একটা লোক মন্দিরে এসে পদ্ম ফুল দিয়ে যান মায়ের পুজোতে। পৌষের প্রথম মঙ্গলবার মায়ের গলায় যে রজনীগন্ধার মালা পড়ানো হয়, সেটিও দেন সেই ওয়াজেদ সাহেব। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নিয়মিত পুজো দেন, মানত করেন। পাত পেড়ে খান। মন্দির প্রাঙ্গণে জ্বলজ্বল করে জমিদাতার নাম লুৎফুল হক, রাফিয়া বিবি, সাদেক আলি মণ্ডল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হিন্দু-মুসলমান বলে ওঠে, গর্ব করে বলতে পারি এই গ্রামে, এই মন্দিরে হিন্দু, মুসলমান কেউ আলাদা নয়। সেই সাংবাদিকের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘কীসের কুসুম’-এর উত্তর পেয়ে যাই আমি এখানে এসে।
শুধুই কি নজরুল! পুরোহিত দিলীপবাবু কথা বলতে গিয়ে জানান, আগামী হপ্তাহে আমিরুল বাবুর ভাইপোর ‘সুন্নত’ উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া। প্রায় সাতশো মানুষ আসবেন হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের। কিন্তু এই অনুষ্ঠান কোথায় হবে? হবে মন্দির প্রাঙ্গণে। বিকেলের নরম আলোয় লালন ফেরেন নিজের নিয়মে। গুনগুন করে গাইতে থাকি, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কী হয় প্রমাণ…’
বান্টিদির সেদিনের সেই প্রশ্নটা, ‘সেক্যুলারিজম কাকে বলে’-র উত্তরও পেয়ে যাই।
আরও অবাক হই মা কিরীটেশ্বরীর অবয়ব মূর্তিটি দেখে। অদ্ভুতভাবে প্রতিমার মুখের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় গৌতম বুদ্ধের। সেবায়েত দিলীপ ভট্টাচার্য নিজেই একজন ইতিহাস বই। দেখাচ্ছিলেন চালচিত্রটিতেও কীভাবে বৌদ্ধ ধর্মের নকশা ফুটে উঠেছে। সঙ্গে মিশেছে ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের স্থাপত্য। বাঁকুড়ার টেরাকোটা দিয়ে সাজানো মন্দিরের আঁচলটিও স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে প্রমাণ দেয় সর্বধর্ম সমন্বয়ের।
অবাক লাগছে ভেবে দুশো বছরের বেশি সময় আগে তৈরি একটা মন্দির একদিকে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন সমন্বয়ের বার্তা দিচ্ছে। আর ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভূতের গল্প শুনে আমরা বিভেদের, ঘৃণার চাষ করছি। সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে মানুষের মগজ।
মাছ-বিক্রেতা রবিদা ইদানীং আর আসে না পাড়ায়। বয়স বেড়েছে। তবু রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি নিশীথের ঘন অন্ধকারে তুলে নেন ছড়। ভাগীরথীর পশ্চিম পার থেকে ঝিলামের পশ্চিমে ধ্বনিত হয়, সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে, পাছে পাছে, তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ…
প্রেম তো ফুরনোর নয়, এদিকে প্রেমিকাকে দেওয়ার মতো কোটেশন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কেলেঙ্কারি ব্যাপারস্যাপার! তা ছাড়া ‘চন্দ্রবিন্দু’র নতুন গানে রাত গভীর হচ্ছে, তা যে কীরকম দেখতে, নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়ার এই সুযোগ, আমার অজান্তে কেউ আমার মোজার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল বোধহয়।