প্রদর্শনী করার উদ্দেশ্য আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কি স্রেফ সেই সময়কার নিষিদ্ধর প্রেক্ষাপটটা বুঝতে চাওয়া? নাকি, এর মধ্যে লুকিয়ে আরও কোনও জরুরি আভাস? বই বা সিনেমার প্রেক্ষাপট থেকে বেরিয়ে আমজীবনে কি উঁকি মারে এই নিষেধের আঙুল? সামাজিকভাবে তো বটেই, এমনকী, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাতেও? সে নিষেধাজ্ঞাগুলোর কথাও ঘুরতে শুরু করে মাথার ভেতর। প্রদর্শনী শেষ হলেও, সেই নিষেধ প্রদর্শন বোধহয় চিরকালের।
মিলন কুন্দেরার ‘লাফেবল লাভস’।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’।
হার্পার লি’র ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’।
মায়া অ্যাঞ্জেলোর ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিঙ্গস’।
এই চারটি বইয়ের মধ্যে মিল কোথায়?
কুইজে এরকম প্রশ্ন সচরাচর করবে না বটে, তবে এ খানিক ‘গুগলি’ গোছের প্রশ্ন। না, উত্তরের জন্য পরের পর্ব পড়ুন, এরকম কথা বলছি না। উত্তর হল এই চারটি পৃথিবীজোড়া পাঠকসমাদৃত বই-ই নিষিদ্ধ হয়েছিল একসময়। প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণেই তারা নিষিদ্ধ। তবে এই নিষিদ্ধ যাত্রায় শুধু বড়দের বই-ই নেই। তালিকায় রয়েছে, ‘হ্যারি পটার’ কিংবা ‘‘এ্যালিস’স এ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড’’-এর মতো বইও।
ভাববেন না, এত কিছু মগজে গুঁজে হাঁটাচলা করি রোজ। জানার সঙ্গে না-জানা মিশিয়ে ভাল করে ঝাঁকিয়ে দিব্যি জীবন কাটছে। এই ‘নিষিদ্ধ’ ব্যাপারটায় আগ্রহ বাড়াল সংস্কৃত কলেজে আয়োজিত এক প্রদর্শনী। অক্টোবরের ১৬ ও ১৭ তারিখ সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আয়োজন করেছিল ‘ব্যান্ডওয়াগন’। দুনিয়ার যত নিষিদ্ধ বই– সেইসব কিছুর খতিয়ান জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন তাঁরা। শুধু বই নয়, প্রদর্শিত হয়েছে নিষিদ্ধ সিনেমার পোস্টারও। তার মধ্যে কিছু সিনেমা এমন রয়েছে, যা প্রথমে বই হিসেবে নিষিদ্ধ হয়েছে, পরে আবার সিনেমা হিসেবেও! তালিকার প্রথমেই চার্লি চ্যাপলিনের লেখা এবং পরিচালনায় ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০)। হিটলারকে নিয়ে তৈরি সেই সিনেমায় দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল চার্লি চ্যাপলিনের বক্তৃতা। দ্রুতই ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হয় ইউরোপ আমেরিকা-সহ বেশ কিছু দেশে। দীর্ঘদিন সিনেমাটি প্রদর্শনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল। ১৯৫৮ সালে উঠে যায় এই নিষেধাজ্ঞা। হিটলারকে নিয়ে তৈরি সিনেমা বা বই নিষিদ্ধ হবে, তাও মানা যায়। কিন্তু হ্যারি পটারও!
আসলে পছন্দ বা অপছন্দের থাকে নানা মাত্রা। সে মাত্রায় এসে পড়ে নানা রাজনৈতিক আঙুলছাপ। বিশেষত কিছু বইয়ে রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের দেশ সম্পর্কে কিছু বিরূপ মন্তব্য খুঁজে পেতেই পারেন। কিংবা কোনও নেতার মনে হতে পারে, সেই বই তাঁদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তাছাড়া, ধর্মের ধ্বজাধারীদেরই বা অস্বীকার করি কীভাবে! তাঁরা যদি বই পড়ে মনে করেন– ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগছে, তাহলে বইটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ঈশ্বর সম্পর্কে অবজ্ঞার গুঁড়ো লেখায় মিশে আছে কি না, খুঁজে দেখবেন তাঁরাই। এবং দাবি করবেন, সমাজ উচ্ছন্নে যাওয়ার অন্যতম কারণই এই বই পড়া। ক্রমে সেই বই নিষিদ্ধতার দিকে এগোবে। যদিও নিষিদ্ধতার আয়ু চিরকালই বইয়ের আয়ু বেশ বাড়িয়েই দিয়েছে।
সাদাত হোসেন মান্টো-র নির্বাচিত গল্প সংকলনই ধরুন। ‘খোল দো’, ‘ঠান্ডা গোস্ত’-এর মতো বই এককালে নিষিদ্ধ হয়। অ্যালিস ওয়াকারের ‘দ্য কালার পারপেল’কে মাত্র দু’-বছরের মধ্যেই বইটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বইটি ‘যৌনগন্ধী’, ‘অশালীন’– এই কারণ দেখিয়ে। অবশ্যই বলতে হয়, সলমন রুশদি-র কথা। তাঁর ‘স্যাটনিক ভারসেস’ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।
স্পষ্ট রাজনৈতিক কারণেও ব্যান হয়েছে একাধিক বই। এ প্রসঙ্গেই উঠে আসে, ভারত বা বাংলাদেশের কথা। এখানেও মূলত রাজনীতি আর ধর্মের অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হয় বই। এদেশে এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। সেই কাজী নজরুলের সময় থেকেই চলে আসছে কণ্ঠরোধের প্রক্রিয়া। একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘অগ্নিবীণা’। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভোর বৃষ্টি’। তবে বেশিদিনের জন্য নিষিদ্ধ থাকেনি কোনও বই-ই। রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু বইয়ের সত্যি কালো অক্ষরের কাছে দেদার হেরেছে।
হে পাঠক, আপনাদের মনে হতেই পারে, যেসব বইয়ের কথা বলছি, সেগুলো বেশ পুরনো। বিগত দশকে পৃথিবী যেভাবে বদলেছে, তাতে এসব বই ব্যানের মতো ঘটনা আর ঘটে কই! কিংবা বলতেই পারেন, ইন্টারনেটের সৌজন্য পৃথিবীতে এখন মুক্তচিন্তার যুগ। কিন্তু কোথায় কী! স্রেফ ২০১২ সালেই ব্যান হয়েছে ৪০০-রও বেশি বই। এই নিষিদ্ধর তালিকায় হ্যারি পটারের মতো বইও রয়েছে। মূলত সেন্সরশিপের কারণ দেখিয়ে বইটির একটি খণ্ড নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকী, জনসমক্ষে বই পুড়িয়ে দেওয়া মতো ঘটনাও ঘটেছিল। সংস্কৃত কলেজের প্রদর্শনীতে তাই বিশেষভাবে রাখা হয়েছিল এই বইগুলো। কয়েকটার ছিল ব্রাউন পেপারে মোড়া। ঘরের দেওয়াল জুড়ে লাগানো ছিল বিভিন্ন ধরনের পোস্টার। সবেতেই ফুটে উঠেছে কটাক্ষের বুলি। আয়োজকদের গলাতেও স্পষ্ট শোনা গেল সেই সুর। তাঁরাও জানালেন, বই নিষিদ্ধ করে কোনও কিছুই বদলানো যায় না। তবে স্রেফ নিষিদ্ধ বই নিয়েই আটকে থাকেনি প্রদর্শনীটি। একই পরিসরে ছিল নিষিদ্ধ সিনেমার পোস্টারও। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ থেকে সাম্প্রতিক সময়ের ‘মোদি’ তথ্যচিত্রটিও রয়েছে সেই তালিকায়। বেশ কিছু নিষিদ্ধ সিনেমার বিশেষ অংশ দিয়ে তৈরি এক মন্তাজও চলছিল সমানে।
সবথেকে মজার বিষয়, যেসব বই কোনও না কোনও সময় নিষিদ্ধ– তার বেশিরভাগই এখন কলেজ বা স্কুলের পাঠ্যক্রমে বহাল। তাহলে প্রদর্শনী করার উদ্দেশ্য আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কি স্রেফ সেই সময়কার নিষিদ্ধর প্রেক্ষাপটটা বুঝতে চাওয়া? নাকি, এর মধ্যে লুকিয়ে আরও কোনও জরুরি আভাস? বই বা সিনেমার প্রেক্ষাপট থেকে বেরিয়ে আমজীবনে কি উঁকি মারে এই নিষেধের আঙুল? সামাজিকভাবে তো বটেই, এমনকী, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাতেও? সে নিষেধাজ্ঞাগুলোর কথাও ঘুরতে শুরু করে মাথার ভেতর। প্রদর্শনী শেষ হলেও, সেই নিষেধ প্রদর্শন বোধহয় চিরকালের। কিন্তু এ গল্পের শেষটুকু আমরা জানি। নিষেধাজ্ঞা টিকবে না, সময়ের কাছে তা নিতান্তই ভঙ্গুর।
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?