
হামবড়াইয়ের দিন গেছে। বাঙালির এখন হুমবড়াই। উত্তরে-প্রত্যুত্তরে হুম-এর হুমকি। এ এক হুমন্তকাল। যখন তখন যেখানে সেখানে বহু দরকারি এই শালগ্রাম শিলা। হুম প্রায় বিজ্ঞানের মতো। এখনও অভিশাপ, না আশীর্বাদ, ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। অতএব হুমসাগরে ডুব দিন।
অনেক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে, ‘হুমমম’ শব্দটি সেই সমস্ত মানুষের যাপন অংশ হয়ে ওঠে, যারা সাধারণ একটা বাক্যগঠনের সময় ‘যাপন’ শব্দটি গোঁজে। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে যারা অকারণ নিজেদের সিরিয়াসলি নেয়।
ভাবই আলাদা! বিরাট উনি! বিরাট! কোনও তর্কে হেরে গেলে বা পেরে না উঠলে এমন ভাবে হাসে যেন– ‘বলতাম, কিন্তু তোকে অযথা বলে আর কী লাভ’। সঙ্গে বক্তব্য! বাব্বা! স্পিলবার্গকে বুঝিয়ে দেবে, কেন স্পিলবার্গ বুঝতে পারছেন না যে, উনি কত বড় মাপের পরিচালক!

না, একটু ভুল বললাম। এঁরা সাধারণত এই ধরনের ‘চটুল’ ছবি দেখে না। বেলার পর টারের জায়গায় বোস শুনে ফেললে ধনেশ পাখি ধরে এনে কান ঠোকরাতে বলে। কাউকে ভালো বলার চেয়ে দৌড়ে গিয়ে ছাগলের শিং ধরে চারবার নেচে আসবে, তাও আচ্ছা। সবাই মিডিওকার। সবাই খারাপ। সবাই ল্যাবা। ও খুদাগাওয়ার নাগার্জুন। অমিভাত তো মেনস্ট্রিম। একটা নাটক লিখেছিল, বা সিনেমা বানিয়েছিল, বা আন্দোলন শুরু করেছিল, যেটা অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে ‘ফান্ড’ নেই বলে। না হলে আজ জাপানে থাকত। শিমুল-পারুল সিনেমায় মনোজ মিত্রর অভিনয় বাঞ্ছারামের বাগানের চেয়ে কেন ভালো, জিজ্ঞাসা করুন বুঝিয়ে দেবে। আপনি কিছু বলে ফেললে এমন ভাবে আপনার দিকে তাকাবে না, আপনার অন্তরাত্মার জয়বাংলা হয়ে যাবে। কাউকে কোনও কিছু পড়া, দেখা বা শোনার জন্য অনুরোধ পর্যন্ত করে না। ডিরেক্ট স্টেটমেন্ট– দেখুন। শুনুন। জানুন। ও তো বিধাতা! এদিকে হয় গোটা জীবনে হাততালি দিয়ে একটা পায়রা পর্যন্ত ওড়ায়নি আর না-হলে পায়রা উড়িয়ে নাম দিয়েছে ‘দ্রোগন’। এদের কখনও জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, ‘ভালো আছেন?’ উত্তরে বলবে, ‘হুমম’!

পাঠক হয়তো এদ্দুর পড়ে ভাবছেন এসবই এযাবৎকাল ধরে নিজের ভেতর পুষে রাখা সমস্ত রাগের এক অনাবশ্যক প্রকাশ। পাঠক, আপনি ঠিক ভাবছেন।
না, মানে, একটা গোটা প্রশ্ন করেছি, তুই ব্যাটা একটা গোটা উত্তর দে, ‘হুমমম’ কেন বলবি! কেউ-ই বা কখনও কেন ‘হুমমম’ বলবে! আর প্রথম কথা হচ্ছে আগের কথাটাই ভুল। ‘হুমমম’ বলা যায় না। কারণ ‘হুমমম’ কোনও শব্দ না, এটা একটা হুমমম। দেখেছেন! গোটা ব্যাপারটাই কী কনফিউজিং দেখেছেন?
যাগকে, তো মোদ্দা কথাটা হল, ‘হুমমম’ একটা শব্দ– যেটা করতে হয়। ঠিকঠাক ভাবেই শব্দটা প্র্যাকটিস করতে পারলে, শব্দটাকে বশীভূত করতে পারলে, প্রক্ষেপণের সঠিক সময় জানলে, এই শব্দটি করে আপনি প্রতিপক্ষের গা-পিত্তি দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করবেন। নিজে একবার ভেবে দেখুন না।
ধরুন, কাউকে বেশ অনেক কিছু লিখে একটা বড় মেসেজ করেছেন আর ওদিক থেকে উত্তরে এসেছে, ‘hmmm…’ সত্যি করে বলুন তো, মোবাইলের ভেতরে ঢুকে গিয়ে উত্তরদাতাকে চাঁটি মেরে আসতে ইচ্ছা করেনি আপনার?

লেখার শুরুতে যে ‘স্বঘোষিত আমরা বেটার’ শ্রেণিটির কথা বললাম, তাদের ওপর এত আক্রোশের উৎপত্তিস্থলই বোধহয় এই ‘হুমমম’। সঠিক সময়ে এই শব্দটি করতে পারলে আমি বাকিদের চাইতে দড় হিসেবে উত্তীর্ণ হব, এই অনাবশ্যক জীবনবোধ যে কী করে অন্তরে সেঁধিয়ে গেল, সে এক দারুণ আশ্চর্য এবং ভেবে দেখার মতো ব্যাপার।
একটা কথা আমরা প্রত্যেকেই জানি যে, সামনের মানুষটাকে ছোট করার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। অডিয়েন্স থাকলে তো কথাই নেই। একেবারে উলালা ইয়ে হ্যায় মেরি ফ্যান্টাসি। ‘হুমমম’ নামক শব্দটি তাতে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
–দাদা আমার কাজটা দেখেছ?
–হুমমম।
ব্যস, তারপর চুপ। নে, এবার তুই জিজ্ঞেস করগে যা। পারবি না তো, উপায় নেই তো, জিজ্ঞাসার মুখে তো সবার আগে ‘হুমমম’ করে দরজা তুলে দিয়েছে। লজ্জায় মরমে মরে যাবি, তাও জিজ্ঞাসা করতে পারবি না কিছু!

এদিকে নিজেরা আজেবাজে জোক লিখে বলবে ‘সার্কাজম’! কেউ কোনও বিষয়ে না জানলে তো উরিব্বা! নিজেই দেওয়ালে মাথা ঠুকবে। প্রত্যেকটা উৎসবে, যেদিন সাধারণ মানুষ একটু খুশি হয়, বেছে বেছে ঠিক সেই দিনগুলোয় বেডকভারের ছবি দিয়ে ক্যাপশনে লিখবে– ‘আজ আর এর দরকার পড়বে না শেষ হয়ে যাওয়া এক শহরে’!
আপনি প্রতিবাদ করতে যান, চারটে বড় কথা লিখুন, লজিকাল কিছু বলুন, তার উত্তরেও লিখবে, ‘হুমমম, বুঝলাম’। শেষ! কী বুঝল, কেন বুঝল– সে এক রহস্য! আসলে আপনি তো নরওয়ের কোনও এক অখ্যাত লেখকের অপ্রকাশিত গোয়েন্দা উপন্যাস পড়েননি, পাতি ফেলু-ব্যোমকেশ-শার্লক পড়ে বড় হয়েছেন, তাই আপনি সেটা অবশ্য ভেদও করতে পারবেন না।
অথচ এই শব্দটির পারপাস কিন্তু ছিল একদম আলাদা। কোনও এক মিষ্টি দুপুরে, ফাঁকা বাড়িতে প্রেমিককে/প্রেমিকাকে যদি আদরের সম্মতি ছাড়া হয়, এবং তার উত্তরে সলজ্জ ‘হুমম’ ভেসে আসে, তার চেয়ে মধুর শব্দ পৃথিবীতে আর আছে কী! থাকলেও আমার জানা নেই। কারণ, আমিও নরওয়ের সেই অখ্যাত লেখকের অপ্রকাশিত গোয়েন্দা উপন্যাসটি পড়িনি!

পরিশেষে বলা যায়, ‘হুমমম’ হল বিজ্ঞানের মতো, আশীর্বাদ না অভিশাপ, তাই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথা ওই এক। ভালো হাতে পড়লে ভালো, খারাপ হাতে পড়লে গেল। আমার ধারণা, এই শব্দটি নিজের দায়িত্ব খুব ভেবেচিন্তে ব্যবহার করা উচিত, কারণ ছোটবেলা থেকেই বাসে-ট্রামে পড়েছি সামনের মানুষটার কমফোর্টের দায়িত্ব কিন্তু আপনার। এই তো সেদিন বাবা ফোনে বলল,
–বাবু, তুই যেদিন আসবি, খাবি, একটু বলে দিস, আমি সেই মতো বাজার করে রাখব। সব কিছু তো খাস না, তোর পছন্দের রান্নাগুলো করব।
–হুমম।
অতএব হামবড়াইয়ের দিন গিয়েছে। এখন হুমবড়াই। হুমকার। একপ্রকার হুমকিও। কী করে যেন হুমড়ি খেয়ে আমরা হুমন্তকালে প্রবেশ করেছি, কে জানে! এখানে কি সভ্যতা আটকা পড়েছে? পাঠক, উত্তর দিয়ে যান। সে উত্তর যদি ‘হুম’ হয়, তাও।
…………………….
রোববার.ইন-এ পড়ুন সৌমিত দেব-এর অন্যান্য লেখা
…………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved