Robbar

পথনির্দেশিকা ছাড়াই পরিযায়ী পাখিরা কীভাবে চিনে ফেলে দেশ-মহাদেশ?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 16, 2025 7:45 pm
  • Updated:December 16, 2025 8:27 pm  

পরিযায়ী পাখিদের উড়ানপথ ৫০০ থেকে ৩৭,০০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা দিয়ে হয়। আপনার আমার মনে হতে পারে, ৩৭,০০০ ফুট! এত উঁচুতে ওড়ার দরকারটা কী বাপু! দরকার আছে। কষ্ট করে একবার উঁচুতে পৌঁছে গেলে ওদের উড়তে অনেক সুবিধে হয়। যত উঁচুতে ওঠা যায়, বাতাসের গতিবেগ বা প্রতিরোধ কমে যায়। তাই সহজেই পাখিরা ভেসে থাকতে পারে। পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়া খেয়াল করে দেখবেন, ওরা আকাশে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের আদলে নিজেদের অবস্থান সাজিয়ে নেয়। তার পিছনে কাজ করে অ্যারোডায়নামিক্স-এর নীতি।

মৌসুমী ভট্টাচার্য্য

শীত পড়লেই গুটিগুটি পায়ে নেমে আসে কুয়াশা। আসে খেজুড়-গুড়, জয়নগরের মোয়া, বাজার-ভরা রঙবেরঙের সবজি, আরও কত কী! আর আসে শীতের অতিথি, পরিযায়ী পাখির দল। খুঁজে নেয় চেনা বিল, জমিয়ে কাটায় শীতের ক’-মাস। শীত ফুরলেই ঘরে ফেরে আকাশের অদৃশ্য পথ চিনে চিনে। নেই কোনও বাঁধানো পথ, নেই পথনির্দেশিকা, নেই কোনও গুগল ম্যাপ। তাও নির্ভুল ভাবেই পৌঁছে যায় ওরা এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে। এক গোলার্ধ থেকে আর এক গোলার্ধে। বিস্ময় জাগে, তাই না!

‘লিমোসা ল্যাপোনিকা’ বা ডাকনামে ‘বার-টেইলড্‌ গডউইট’ নামের ছোট্ট পাখিটির কথাই একবার ভাবুন।

শীত পড়লেই আলাস্কা থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া। ২০২২-এর ১৩ অক্টোবর উড়তে শুরু করে একটানা ১১ দিন ১ ঘণ্টা আকাশে উড়ে দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন উড়ানের জন্য ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নাম তুলেছে এই একরত্তি পাখি। পথের দৈর্ঘ্য ১৩,৫৬০ কিলোমিটার! পৃথিবীর পরিধির তিনভাগের একভাগ। না, জল বা খাবার খেতে একটি বারও থামেনি। উড়ান শুরুর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ওরা নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকে। প্রচুর খাবার খেয়ে ফ্যাট সঞ্চয় করে নেয় নিজেদের শরীরে। ওদের শরীরের ওজনের ৫০ শতাংশই তখন ফ্যাট, যা দিয়ে খাবারের চাহিদা মিটিয়ে নেয় দীর্ঘ যাত্রাপথে। উড়তে উড়তেই কয়েক সেকেন্ড করে ঘুমিয়ে নেয়। তাদের ক্লান্ত ডানা বিশ্রাম পায় গন্তব্যে পৌঁছে।

বার-টেইলড্‌ গডউইট: ছোট ডানায় বড় স্বপ্ন

শুধু গডউইট কেন, পৃথিবীর প্রায় ২,০০০ প্রজাতির পাখি শীত-গ্রীষ্মে ঠিকানা বদল করে। শীতে যখন তাদের বসতভূমি বরফের নিচে চলে যায়, খাবারদাবারও অমিল, তখন উত্তরের শীতপাখিরা উড়ান দেয় দক্ষিণের দিকে, একটু উষ্ণতার জন্য। দক্ষিণে তখন অঢেল খাবার, আবহাওয়াও আরামদায়ক। আবার শীত গড়িয়ে গরম এলে উল্টোরথ। তারা ফিরে যায় নিজের দেশে। সেখানে তখন বসন্ত এসে গিয়েছে। সময় হয়েছে প্রজননেরও। হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে ওরা পৌঁছে যায় নির্ভুল গন্তব্যে। হামিংবার্ডদের কথা অবশ্য আলাদা, ওরা শীতে মোটেই কাবু হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত খাবার পাওয়া যায়, ওরা নিজের দেশেই থাকে। খাবারে টান পড়লে তবেই দেশ ছাড়ে। তবে কারা, কোন দেশে উড়ে যাবে– সেটা শুধু দূরত্ব না, নির্ভর করে পথ কতটা সুগম, তার ওপরও। যেমন, ইউরোপের খুব কম পাখি-ই ভারতে আসে। কারণ এই উড়ানপথে পড়ে আধ ডজন পর্বতশ্রেণি। তুলনায় অনেক সহজ জিব্রাল্টার পেরিয়ে আফ্রিকার দিকে যাওয়া। ভারতে আসা পরিযায়ী পাখিরা মূলত আসে রাশিয়া, চিন, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, সাইবেরিয়া এবং সংলগ্ন দেশ থেকে।

হামিংবার্ড: শীত যার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে

কেমন করে ওই ছোট্ট পাখিগুলো নিজেদের গন্তব্য চিনে পৌঁছয়, এ এক আজব ব্যাপার! পরিযায়ী পাখিরা শুধু দিনে না, রাতেও উড়ান জারি রাখে। বরং রাতে ওড়াতেই ওরা বেশি স্বচ্ছন্দ। কারণ, রাতের তাপমাত্রা কম থাকায় ওদের শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। ক্লান্তি কম হয়। আর রাতের অন্ধকারে শিকারিদের হাত থেকেও অনেকটা রেহাই পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিরা দিক নির্ণয়ের জন্য ভরসা করে রাতের তারা আর দিনের রবির ওপর। আকাশে সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারাদের অবস্থান থেকে ওরা চিনে নেয় নিজেদের পথ। কিন্তু মেঘ করলে! তারও উপায় আছে। পাখিদের পথ চেনার ক্ষেত্রে নাকি তাদের গন্ধের অনুভূতি কাজ করে।

নতুন প্রজন্মের কোনও পাখি যখন প্রথমবার একা উড়ান দেয়, তাকে পথ চিনিয়ে দিতে হয় না। রাশিয়ায় একদল গবেষক পরিযায়ী পাখির ডিমে কৃত্রিমভাবে তা দিয়ে কয়েকটি ছানাটিকে তাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে বড় করেন। বাবা-মা’র সঙ্গ-বঞ্চিত সেই ছানাগুলো শীত এলে একা একাই দিব্যি কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এক জলাভূমিতে চলে আসে, যেখানে তার আপনজনেরা সাধারণত আসে। শীত ফুরলে তারা আবার ফিরে যায় রাশিয়ায়। জন্মসূত্রেই জিনগতভাবে ওরা নাকি উড়ান পথের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে যায়!

…………………………..

আপনার গ্রাম-শহরের পাখিদের নির্ভয় আনাগোনায় আপনি নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক বানিয়ে ফেলতেই পারেন। লাগান না, কয়েকটা ফলের গাছ আপনার বাড়ির পিছনের পড়ে থাকা জমিটায়। আপনার সঙ্গে ওরাও ভাগ বসাক গাছের ফলমূলে। বারান্দার কোণে বা চিলেকোঠার কার্নিশের ধারে ঝুলিয়ে রাখতেই পারেন কয়েকটা মাটির হাঁড়ি। ওরা আসুক, ভরসা করে আপনার অতিথি হয়ে।

…………………………..

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিরা পৃথিবীর গভীরে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড বুঝতে পারে। ওদের ঠোঁটে থাকা ম্যাগনেটাইট নাকি ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রতি ওদের সংবেদনশীলতার কারিগর। জার্মান পদার্থবিদ ক্লস শেল্টেন ১৯৭৮ সালে প্রথম বলেন, পরিযায়ী পাখিদের নিখুঁতভাবে দিক চিনে শীতভ্রমণের নেপথ্যে আছে কোয়ান্টাম ফিজিক্স-এর ‘র‍্যাডিকাল পেয়ার মেকানিজম’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক পিটার জে হোর সম্প্রতি তাঁর গবেষণায় বলেছেন, রবিন্স-এর মতো গায়ক-পাখিদের চোখে ক্রিপ্টোক্রোম-৪ প্রোটিনের উপস্থিতি পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড খুঁজে পেতে তাদের কাছে কম্পাসের কাজ করে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, অঙ্ক, ইঞ্জিনিয়ারিং– সব মিশিয়ে গবেষকদের বেশ জটিল ধাঁধায় ফেলে দিব্যি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে আশ্চর্য এই পরম্পরা।

রবিন্স: যে গায়ক-পাখি ভূ-পর্যটকও

তবে পরিযায়ীদের এই দুস্তর পথ বড় বিপদসংকুল। বেশিরভাগ পাখিই মাঝপথে থামে খিদে-তেষ্টা মেটাতে। সেই মধ্যপথের সরাইখানায় লুকিয়ে থাকে বিপদ। কীটনাশক-যুক্ত শস্য, পাখি-শিকারিদের পাতা ফাঁদ, ইলেকট্রিকের তারে বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়া– এমন আরও কত কী! কাচের দেওয়াল বা জানলায় ধাক্কা খেয়েই যে কত পাখি প্রতি বছর মারা যায়!

সারা পৃথিবী এখন অকারণ আলোয় রাতকে দিন করে ফেলতে চায়। রাতভর জোরালো আলোর বন্যায় দিক্ভ্রান্ত হয় ছোট্ট পাখিরা। গন্তব্যে পৌঁছেও ওরা নিরাপদ নয়। শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই বছরে ২৫ মিলিয়ন পরিযায়ী পাখি মারা যায়। পরিবেশের অসুখ তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয় চোরাশিকারিদের লোভ, শখের শিকারবিলাস! কখনও আবার ভোজনরসিকদের রসনার তৃপ্তি করতেও প্রাণ যায় পরিযায়ী পাখিদের।

রাষ্ট্রপুঞ্জের বন কনভেনশন বা ‘দ্য কনভেনশন অন মাইগ্রেটরি স্পিসিস’ পরিযায়ীদের নিরাপত্তার জন্যে একগুচ্ছ নিয়মবিধি তৈরি করেছে। কনভেনশনের সেক্রেটারি এমি ফ্রেঙ্কেল বলেন, ‘পরিযায়ী পাখিরা জীববৈচিত্রের সূচক। নানা জায়গায় ওদের সাময়িক অবস্থানের ধরন সেই জায়গার সামগ্রিক জৈব পরিস্থিতির একটা ইঙ্গিত দেয়।’ ওরা এক বৃহৎ বাস্তুতন্ত্রের অংশ। নানা ভূমিকায় দেখা যায় ওদের। ওরা যেমন ফুলের পরাগ সংযোগে সাহায্য করে, তেমনই বীজের ছড়িয়ে পড়াতেও সাহায্য করে। অনেক শস্যনাশক পোকামাকড়কে খেয়ে ফেলে কীটপতঙ্গ দমনের কাজও করে দেয়।

কিন্তু বিশ্বজোড়া দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিযায়ী পাখিরা বিপন্ন হতে বসেছে। তরতর করে কমছে ওদের সংখ্যা। আগ্রাসী নগরায়নের ফলে কমছে জলাভূমি। এতটা পথ পেরিয়ে এসে যদি শীতের অতিথিটি তার চেনা জলাভূমিকে খুঁজে না পায়, তবে তার বিপন্নতার সীমা থাকে না। থিতু-পাখিদের তুলনায় পরিযায়ীদের সংকট অনেক বেশি কারণ, তাদের নানা দেশের ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। আর তাদের জীবনচক্রও তো সময়ের ছন্দে বাঁধা। মা পাখিরা তাদের ছানাদের জন্ম দেয় যখন খাবারের জোগান পর্যাপ্ত; পরাগ মিলনকারীদের তখনই হাজির হতে হয়, যখন ফুল ফোটে। প্রকৃতির সব কর্মকাণ্ড তো সময়ের হাতঘড়ি মেনেই হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আজ কোনও কাজই যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। শুধুমাত্র শীত দেরিতে এলেই বাকি বছরের সব কাজে দেরি হয়ে যায়। সেই দেরির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না জীবকুল। এলোমেলো হয়ে যায় ছন্দ।

পরিযায়ী পাখিদের উড়ানপথ ৫০০ থেকে ৩৭,০০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা দিয়ে হয়। আপনার আমার মনে হতে পারে, ৩৭,০০০ ফুট! এত উঁচুতে ওড়ার দরকারটা কী বাপু! দরকার আছে। কষ্ট করে একবার উঁচুতে পৌঁছে গেলে ওদের উড়তে অনেক সুবিধে হয়। যত উঁচুতে ওঠা যায়, বাতাসের গতিবেগ বা প্রতিরোধ কমে যায়। তাই সহজেই পাখিরা ভেসে থাকতে পারে। পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়া খেয়াল করে দেখবেন, ওরা আকাশে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের আদলে নিজেদের অবস্থান সাজিয়ে নেয়। তার নেপথ্যে
কাজ করে অ্যারোডায়নামিক্সের নীতি। সবার আগে যে পাখিটি থাকে, তার পরিশ্রম সবচেয়ে বেশি। বাতাসের প্রতিরোধ সে একাই কাটিয়ে এগয়; এবং পিছনের দিকে থাকা পাখিদের জন্য সে বাতাসের প্রবাহ তৈরি করে, যাতে তাদের উড়ান সহজ হয়। দীর্ঘপথের উড়ানে পাখিরা পালা করে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। আকাশের গায়ে আমরা দেখি উড়ন্ত পাখিদের আলপনা। পাখিদের রাজ্যে তার নাম বোঝাপড়া।

এবার শীতে যদি বেরিয়ে পড়েন রসিক বিল, কুলিক, গড় জঙ্গল, চুপির চর কিংবা মংলাজরির পথে, তবে একবার ভাববেন, কী কঠিন পথের যাত্রী ওরা। কত বিস্ময় ওদের জীবনের পরতে পরতে! আপনার পরের প্রজন্মের চোখেও সেই বিস্ময়ের ঘোরটা বাঁচিয়ে রাখতে হলে নিজের ছোট কিছু অভ্যাস বদলে পরিবেশকে আরোগ্যের পথে একটু এগিয়ে দিন।

কিছু না পারেন, অন্তত ছাদের বা বারান্দার আলোটা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মনে করে নিভিয়ে দিন। গলির মুখের ল্যাম্প পোস্টের আলোর ওপর একটা ছোট ঢাকনা লাগিয়ে দিতে অনুরোধ করুন, যাতে আলো শুধু নিচের দিকেই ছড়ায়, আকাশে নয়। ভিনদেশিদের কথা না-ই বা ধরলেন। আপনার গ্রাম-শহরের পাখিদের নির্ভয় আনাগোনায় আপনি নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক বানিয়ে ফেলতেই পারেন। লাগান না, কয়েকটা ফলের গাছ আপনার বাড়ির পিছনের পড়ে থাকা জমিটায়। আপনার সঙ্গে ওরাও ভাগ বসাক গাছের ফলমূলে। বারান্দার কোণে বা চিলেকোঠার কার্নিশের ধারে ঝুলিয়ে রাখতেই পারেন কয়েকটা মাটির হাঁড়ি। ওরা আসুক, ভরসা করে আপনার অতিথি হয়ে। আর নতুন করে কোনও জলাভূমির নিধন শুরু হলে ছোঁয়াচে করে তুলুন আপনার প্রতিবাদকে।

শীত আর শীতপাখিদের যুগলবন্দি আনন্দময় হোক। হোক অন্তহীন।

……………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন মৌসুমী ভট্টাচার্য্য-র অন্যান্য লেখা

……………………….