বসন্তপঞ্চমীর প্রথম পর্ব ছিল বসন্ত চৌধুরীর পোশাকআশাক নিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে, তাঁর বাড়ির পোষ্য জীবজন্তু। কখনও পপি নামের আহ্লাদী কুকুর, কখনও-বা রোজি নামের কচ্ছপ। দুম করে অন্দরমহলে ঢুকে পড়া প্রায় বিদেশি একটি বিড়াল, অথচ ততটা বিড়ালপ্রেম নেই– এহেন বসন্ত চৌধুরীরও একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ভোরবেলার ময়দানে, সকলের চোখ বাঁচিয়ে ঘোড়সওয়ার। বসন্ত চৌধুরীর আরেকটি দিক, যা এতদিন ছিল এক্কেবারে অজানা। এই পর্বে প্রথমবারের জন্য তা জনসমক্ষে এল।
২.
আমি জন্মানোর আগেই, আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। এনেছিলেন বাবা-ই। সে– কালো কুচকুচে, বেঁটেখাটো অ্যালসিশিয়ানের মতো। মিক্সড ব্রিড, কোঁকড়ানো চুল, গায়ে লোম আছে। নাম পপি।
কলকাতার উডল্যান্ড হাসপাতালে জন্মেছিলাম। গল্প শুনেছি, যখন বাড়ি ফিরি, বাড়িতে উপস্থিত তখন বাবা-মা, আমার দাদা সৃঞ্জয় এবং পপি। দাদার সঙ্গে বন্ধুত্বর জন্যই সেই কুকুর আনা হয়েছিল বাড়িতে। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব মোটেও হয়নি। বাবাও তা নিয়ে বিশেষ পরোয়া করেননি। কারণ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বাবার সঙ্গে তো বটেই। পপিকে আমি অবশ্য ‘পপি’ বলতাম না, বয়সে বড় বলেই ডাকতাম ‘পপিদাদা’ বলে। বুঝতেই পারছেন, পপিদাদার অধিকাংশ গল্পই আমার বাবা-মা-দাদার কাছ থেকে শোনা।
বাবা যখন গাড়ি নিয়ে ঢুকতেন বা বেরতেন, হর্ন দিতেন, পপিদাদা যেখানেই থাকত, দৌড়ে যেত। বাবা একঘণ্টার জন্য বেরলেও তাই, চারদিনের পরে ফিরলেও তাই। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা খুবই আদর-আহ্লাদের। কখনওসখনও বকাঝকারও। সাফ বাংলায় বাবা বকা দিলে, পপিদাদা তা স্পষ্ট বুঝতে পারত। সেই মুহূর্তে খানিক অপরাধ-অভিমান নিয়ে তাকিয়েও থাকত।
শুনেছি, ছোটবেলায় পাড়ায় যখন ট্রলি করে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত, তখন পপিদাদা বডিগার্ডের মতো ডগ-গার্ড হয়ে থাকত। বাচ্চা বলে কেউ গায়ে হাত দিয়ে খামোকা আদর করতে গেলেই পপিদাদা রেগে কাঁই! কামড়ে হয়তো দেয়নি, কিন্তু নিজের মতো করে দাঁত দেখিয়েছে। রাগে গরগর করেছে। ওর চেনা লোক হলে অবশ্য এমনটা করত না।
যখন হামাগুড়ি দিতে শুরু করলাম, পপিদাদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। বড় হওয়ার পাশাপাশি বাঁদরামোও শুরু হয়, সেসময় প্রতিটি শিশুই অল্পবিস্তর বকা খায়– কিন্তু আমাকে বকলে দেখা যেত, সে খুবই অসন্তুষ্ট। যে বকছে, তাকে কাউন্টার করারও চেষ্টা করত। স্বাভাবিকভাবেই ওর সঙ্গে আমার ইয়ারদোস্তি হয়ে গিয়েছিল খুব। দুপুরবেলা আমার সঙ্গে একই বিছানায় শুত। কিন্তু রাতে আমাদের সঙ্গে থাকত না। ওর আলাদা একটা জায়গা ছিল, ঘুমত সেখানেই। সকালবেলা বাচ্চাদের ঘরের দরজাটা খুললেই ঢুকে পড়ত আহ্লাদী পপিদাদা।
এখন মনে হয়, ওই বাল্যবয়সে পপিদাদাই আমার প্রিয়তম বন্ধু। ক্রমে আমিও বড় হলাম, নানা কাণ্ডকারখানায়, খেলাধুলোয় জড়িয়ে পড়লাম। বাড়ির বাইরেও বেরতে শিখলাম একা একা। কিন্তু তাকে যেহেতু বাড়ি থেকে তেমন বেরতে দেওয়া হত না, ওর সঙ্গে একটু দূরত্ব তৈরি হল। আমার যখন ৬-৭ বছর বয়স, পপিদাদার হঠাৎ শরীর খারাপ হল। ডাক্তার এসে বলেছিলেন, পপিদাদা খুব বেশিদিন নেই। বাচ্চারা চিরকালই স্বার্থপর, এখন বুঝি, ওর গুরুত্ব আমার কাছে কমে গিয়েছিল সেসময়। আমি তখন ইশকুলে যাচ্ছি, দৌড়দৌড়ি করছি, এটা-সেটা নিয়ে খেলছি। পপিদাদা, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমার বাল্যবন্ধু, ছায়ার মতো থাকত– তবুও তাকে আমি ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলেছিলাম এক শিশুর স্বার্থপরতায়।
আমি পড়তাম নর্মদা স্কুলে। স্কুল চালাতেন শান্তা মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী অশোক মুখোপাধ্যায়। ওঁরা দু’জনেই জন্তুজানোয়ার-পশুপাখি খুবই ভালোবাসতেন। স্কুল লাগোয়া একটা বড় মাঠ ছিল। সে বাড়িতে অনেক কুকুর, বেশ কিছু বিড়াল ছাড়াও ছিল হরিণ! এমনকী, ময়ূর, সারসও। এই পরিবেশেই চলত স্কুল। স্কুলে দিব্যি আনন্দে কাটছিল, ওদিকে পপিদাদার শরীর ক্রমে খারাপ হতে থাকল।
একদিন বিকেলে খেলতে গিয়েছি। ফিরতে বেশ খানিক দেরিই হয়েছে। এক ঘণ্টা মতো। ভেবেছি, ভারী বকা খাব। কিন্তু খেলাম না বকা। কারণ পপিদাদা মারা গিয়েছে। সেদিন আমাকে কেউ বকেনি। আজ মনে হয়, জীবনের শেষদিনও পপিদাদা বকা খাওয়া থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বসন্তপঞ্চমী প্রথম পর্ব পড়ুন: নায়ক ছবিতে উত্তমকুমারের কস্টিউমের মাপ নিয়েছিলেন মনসুর, তাঁর থেকেই আজীবন পাঞ্জাবি বানাতেন বসন্ত চৌধুরী
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পপিদাদার খবর গেল শান্তা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল ওকে। সাদা কাপড়ে মুড়ে ফেলা হল। আমি, শান্তা আন্টি আর বাবা গিয়েছিলাম বড় গঙ্গায়। পপিদাদাকে ভাসিয়ে দেওয়া হল। এ ঘটনার পর বাড়িতে আর কোনও কুকুর থাকেনি কোনও দিন। কিন্তু যেহেতু বাড়ির উঠোনটা বড়, নানা সময় প্রচুর কুকুর আসত। দেড় জনের মতো বেশি রান্না করা হত রোজই, যাতে পাড়ার কুকুররাও খেতে পারে।
সব কুকুরই বুদ্ধিমান হয়– এরকমটাই ভাবতাম আমি। কিন্তু পাড়ার এক হদ্দবোকা কুকুর এসে জুটেছিল আমাদের কপালে। যে অনেক সময়ই দাদা এবং আমাকে গুলিয়ে ফেলত। এসব ঘটনার জন্যই আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম ‘বোকা’। দাদা কলেজ থেকে ফিরে অনেক দিনই অভিযোগের সুরে বলেছে, ‘আর বোলো না, বোকা আজ আমাকে ভেবেছে তুমি! তারপর দৌড়াদৌড়ি। শেষে বিস্কুট কিনে দিতে হল।’ দাদা আর আমাকে একসঙ্গে দেখতে পেলে আবার এই ব্যাপারটা হত না।
………………………………………….
বাবা নাকি ওকে প্রায় আধঘণ্টা ধরে দেখে, আদর-টাদর করে বুঝতে পেরেছে, ওর গলায় কিছু একটা আটকেছে। কিন্তু রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। এখন কী-ই বা করা যায়! কাজের লোক চেপে ধরল বোকাকে। আমি হাঁ-মুখখানা খুলে দু’হাত দিয়ে ধরলাম, আর বাবা চড় মারলেন বোকার মুখে। বোকার গলা থেকে বেরল মাটনের স্পাইনের পিস। তখন বোকার ভীষণ আহ্লাদ, খুবই লেজ-টেজ নাড়ল। বাবা, সেই মাটনের হাড়খানা ছুড়ে দিলেন ছাদে। কিন্তু বোকা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেন সেই হাড়খানা তাকে না দিয়ে ওভাবে ফেলে দেওয়া হল! বোকা– এহেন উচ্চতার বোকা!
………………………………………….
একবার এক নেমতন্ন বাড়ি থেকে রাত করে ফিরেছেন বাবা। প্রায় ১২টা নাগাদ। সাড়ে ১২টা নাগাদ আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। কী ব্যাপার? বাবা বললেন, বোকার নাকি কিছু একটা অসুবিধে হচ্ছে! আমি বিরক্তই হলাম। কী আবার হল ছাই! এ এত বোকা!
বাবা নাকি ওকে প্রায় আধঘণ্টা ধরে দেখে, আদর-টাদর করে বুঝতে পেরেছে, ওর গলায় কিছু একটা আটকেছে। কিন্তু রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। এখন কী-ই বা করা যায়! কাজের লোক চেপে ধরল বোকাকে। আমি হাঁ-মুখখানা খুলে দু’হাত দিয়ে ধরলাম, আর বাবা চড় মারলেন বোকার মুখে। বোকার গলা থেকে বেরল মাটনের স্পাইনের পিস। তখন বোকার ভীষণ আহ্লাদ, খুবই লেজ-টেজ নাড়ল। বাবা, সেই মাটনের হাড়খানা ছুড়ে দিলেন ছাদে। কিন্তু বোকা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেন সেই হাড়খানা তাকে না দিয়ে ওভাবে ফেলে দেওয়া হল! বোকা– এহেন উচ্চতার বোকা!
এক সাহেব-মেমসাহেব আমেরিকান কনস্যুলেটে কাজ করতেন। তাঁরা সাউথ ইস্ট এশিয়ায় যখন ছিলেন, ছোট্ট একটা কচ্ছপ ওঁরা পুষেছিলেন। সেই কচ্ছপ এই ভারতেও সঙ্গে এনেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সময় হয়েছে তাঁদের, আমেরিকায় ফেরত চলে যাওয়ার, আর নতুন নিয়ম অনুযায়ী কচ্ছপটিকে সেদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই সাহেব-মেম– দু’জনেই বাবা-মা’র পরিচিত। বাবা এসে আমাদের বললেন, ‘কচ্ছপটাকে আমাদের বাড়িতে আনলে কেমন হয়?’ দু’ভাইয়ের মুখ দেখে বাবা বুঝলেন কচ্ছপ আনার আনন্দে আমরা আহ্লাদে আটখানা!
ছোট্ট কচ্ছপ। হাতের তালুর মতো। নাম: রোজি। সারাদিন ঘুরে বেড়াত বাড়িতে। গাজরকুচি, শসা– মূলত এগুলোই খেত। দিনে হোক বা রাতে। একটা ছোট্ট উঁচুমতো বাঁধানো জায়গায় টিউবকল ছিল। নালা বন্ধ করে, জল অনেকটা থইথই করলে, সেখানে রোজিকে ছেড়ে দেওয়া হত। জলে খুবই আনন্দে থাকত সে। এমনিতে রোজি থাকত একটা বাতিল হুইস্কির কাঠের ক্রেটে। সেটাই ওর বেডরুম। বাইরের নানা আওয়াজে যখন ওর ঘুম ভেঙে যেত, তখন কাঠে নখ দিয়ে খড়খড় করে আওয়াজ করত। আমরা বুঝতাম, যে ও উঠে পড়েছে। এবার সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াবে।
আমাদের বড় বাড়ি ছিল বলে, মাঝেমধ্যেই রোজি চোখের আড়ালে চলে যেত। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, কচ্ছপরাও যে গলা চিনতে পারে, বুঝেছিলাম বাবার হাঁকে। বাবা বসার ঘর থেকে ‘রোজি রোজি’ বলে ডাক দিলে, সে ঠিক বাবার কাছে গিয়ে হাজির হত।
হঠাৎ হঠাৎই রোজিকে উদ্ধার করা হত বাগান থেকে। এমনিতে আমরা মাঝে মাঝে রোজিকে বাগানে নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমরা ছাড়া কী করে সে বাগানে গিয়ে পৌঁছল, তা বুঝতে পারতাম না! কারণ তিন-চারটে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে তবে বাগান। আর ওই ধাপ পেরিয়ে রোজির নামা অসম্ভব! বাবাই একদিন রহস্যভেদ করলেন। দেখলেন, রোজি সিঁড়ির ধাপের একেবারে গায়ে দাঁড়িয়ে মাথা আর পা খোলসের ভেতরে নিয়ে নিল। তারপর টুকটুক করে গড়িয়ে দিব্যি হাজির হল বাগানে!
রোজি স্পষ্টই জানত বাড়ির মূল ফটক কোনটা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যা জানার কথা না, রোজি বুঝতে পেরেছিল, তা হল আদিগঙ্গা আমাদের বাড়ির খুব কাছে। সত্যিই, গোটা ৪-৫টা বাড়ি পেরলেই সেই আদিগঙ্গা। রোজি গেটের তলা দিয়ে বেরিয়ে অনেকবারই গঙ্গার দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। মাঝে সিকি কিলোমিটারের রাস্তা। বেশ কয়েকবার রাস্তার লোকজন রোজিকে উদ্ধার করে ফিরত দিয়ে গিয়েছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, রোজির গঙ্গার প্রতি একটা আকর্ষণ রয়েছে।
বহু বছর রোজি আমাদের সঙ্গে ছিল। তারপর একদিন উধাও হয়ে গেল। চুরি হয়ে গেল, নাকি কেউ নিয়ে নিল? তার থেকেও বেশি মনে হয়, ওই সিকি কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সে গঙ্গায় চলে গিয়েছে।
বাবা যতটা কুকুর যতটা ভালোবাসতেন, বিড়াল ততটা নয়। তবে অপছন্দও করতেন না। এক বিড়াল, গায়ে লম্বা লোম, ফুলো শরীর, সিয়ামিজ ক্যাটের মতো দেখতে, হাজির হল বাড়িতে। দেখে মনেই হবে, সে বিদেশি বিড়াল। আশপাশে, পাড়ায় এরকম কোনও বিড়াল নেই। এবং সে যে এক্কেবারে ছোট, এমনও নয়। সেই বিড়াল বসার ঘরে একখোপ সোফায় শুয়ে থাকত। কারও কোনও ক্ষতি করত না। মাঝে মধ্যে পাড়া বেড়াতে যেত। তবে যখনই যাক, বাবা যখন খেতেন, সেসময় সে উপস্থিত থাকতই। বাবা খেলে, সে একটু ‘মিউ’ করে জানান দিত উপস্থিতি। এর অর্থ: মাছের কাঁটাটা যেন আমি পাই! বাবার সঙ্গে ক্রমে বিড়ালটার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। মা মজা করে ওর নাম দিয়েছিল ‘কাকা’। আমরাও ছোটবেলায় ওকে কাকা-ই বলতাম। কিন্তু এই অপূর্ব সুন্দর বিড়াল, কোথা থেকে এসেছিল, আমরা কোনও দিন টের পাইনি। যেমন টের পাইনি, হঠাৎ সে কোথায় হারিয়ে গেল একেবারে, আর এল না।
আমার সবথেকে বড় ভালোবাসা ভাল্লুক। বাবা-মাকে কোনও এক উপায়ে আমি বোধহয় বুঝিয়েছিলাম ভাল্লুক অত্যধিক ভালোবাসি। ওঁরাও এই ভালোবাসায় আপত্তি করেননি। বাবা আমার জন্য একটা টেডি বিয়ার নিয়ে এসেছিলেন। তাকে আমি প্রায় জ্যান্ত ভাল্লুকই ভাবতাম। লাল টেডি বিয়ার, আমারই সাইজের। নাম দিয়েছিলাম ‘হাল্লাভাল্লা’। ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর হাল্লারাজা থেকেই হাল্লা নামটা নিয়েছিলাম, আর ভাল্লুক থেকে ভাল্লা।
জন্তুজানোয়ারের প্রতি ছোট থেকেই এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল, সম্ভবত বাবার উত্তরাধিকার সূত্রেই। বাবা কিনে দিয়েছিলেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ অ্যানিমল অ্যান্ড বার্ডস’ ছাড়াও জীবজন্তু সম্পর্কিত বহু বই।
বাবা ঘোড়সওয়ারে যেতেন ময়দানে। খাস ভোরবেলায়। ময়দানে লোকও থাকত যে রাইডিং করাবে। অস্টিন গাড়ি চড়ে আমি আর বাবা পৌঁছতাম সদ্য সূর্যছোঁয়া মায়াবী ময়দানে। আমি বলা হয়েছিল, গাড়ি থেকে না নামতে, তাই বসেই থাকতাম। রাইডিং শেষ হলে বাবা গাড়ির দরজা খুলে দিতেন। আমি ময়দানের ঘাসে নেমে ঘোড়াকে একটু আদর করে দিতাম।
বাবার সঙ্গে আলিপুর চিড়িয়াখানার এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয় সেসময়ই। তিনি থাকতেন আলিপুর চিড়িয়াখানাতেই, সব সময়। ময়দানে বাবার ঘোড়া চড়া ও আমার ঘোড়া আদরের পর, আমাদের পরের গন্তব্য অনেকসময়ই হত চিড়িয়াখানা। ওই ভোরবেলা ছাড়া অন্য সময় বাবা চিড়িয়াখানায় যেতে পারতেন না স্বাভাবিকভাবেই। বাবা আর সেই ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন, আড্ডা মারতেন। একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতে সঁপে আমাকে পাঠানো হত চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে জীবজন্তু দেখানোর জন্য। তবে বাবা জানতেন আমি যাচ্ছি মূলত ভাল্লুক দেখতেই।
ভাল্লুক নিয়ে এই ভালোবাসাটা অনেক বছর পর্যন্ত অটুট ছিল। আটের দশকের শেষে, রিজেন্ট গ্রোভ থেকে যখন চলে এলাম রানীকুঠিতে, তখনও আমার সমস্ত টেডি বিয়ার ছিল সযত্নে রাখা। আমি কিন্তু তখন কলেজে পড়ি।
ভাল্লুক নিয়ে ভালোবাসার ব্যাপারটা আমি অনেক পরে জানতে পারলাম যে, এটা পূর্বজন্মের সঙ্গে জড়িয়ে। থাকতাম মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নে। চারজন ছেলে ছিল আমার। তা সত্ত্বেও আমার এক পোষ্য ঘরোয়া ভাল্লুক ছিল। যে আমার সঙ্গে ছিল শেষদিন পর্যন্ত। আমরা একসঙ্গে খেতাম, থাকতাম এবং সে ছিল আমার খুবই প্রিয়। বাবা একথা জানতে পারেননি। ফলে কোনও দিন বুঝতেও পারেননি ভাল্লুক নিয়ে আমার আদিখ্যেতা ঠিক কেন!
রানীকুঠিতে আমরা চলে এলাম। এখানে একটা বড় জমি ছিল আমাদের। গাছটাছও ছিল। বছরে দু’বার করে আসতাম এ পাড়ায় বরাবরের মতো আসার আগেও– গাছ থেকে ফল পাড়তে। বাবা এই জমিতে একটা বাড়ি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। যে-সে নয়, একেবারে বাংলো বাড়ি! তা তৈরি করতে যখন শুরু করা হল, দু’পাশে দু’খানা চারতলা বাড়ি উঠে গেল। বাবা বললেন, দু’দিকে দুটো চারতলা বাড়ির মাঝে বাংলো করা অর্থহীন। তাই প্রোমোটারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল জায়গাটা। বাংলোর বদলে আমরা উঠে এলাম তিনতলায়।
এই নতুন আস্তানায় সবই হল। নতুন ঝকঝকে জীবন। বেডরুম, অ্যাটাচ বাথরুম। শুধু দরজার বাইরে কুকুর, জানলায় দুটো বিড়াল– এই দৃশ্যটা নিয়ে আসতে পারলাম না আমাদের পুরনো বাড়ি থেকে।
………………………………………
লেখার সঙ্গে প্রতিটি স্কেচই দীপঙ্কর ভৌমিকের। অনুলিখন সম্বিত বসু
তুলনাহীন স্পিভাকের অনর্গল যুক্তিবাদী বাগ্মিতা। তাঁর সন্ধান ও প্রকাশের, তাঁর যুক্তির এবং ভাষার কত যে মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে কী বলব! তখন তিনি তাঁর বিতর্ক উজ্জ্বল, বোধ শাণিত, ভাষায় অব্যর্থ যৌবনে। গোল টেবিলের আর সবাই বিদেশি পুরুষ। একমাত্র নারী তিনি। এবং বাঙালি। হাতে জ্বলছে সিগারেট। সিগারেট মুখে তীব্র আগুনবিন্দু যেন তাঁরই দার্শনিক চেতনা, তাঁরই ধ্যানবিন্দু !
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এখন ৯০ বছরের। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, শতবর্ষ পালনটা ওঁর সঙ্গে আমরা একসঙ্গেই করব। এই যে নাটকের একটা আলাদা সংসার এবং সে সংসারে সদস্যদের সবার মন জুগিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজটা সুন্দর করে করলেন রুদ্রদা, সেটা ওঁর আজকালকার হাসি দেখেই বুঝতে পারি।