খাটের তলায় বিছানো আম আর প্রতি রাতে জলে ভেজানো আম চলত বৈশাখের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের শেষ অবধি। সকালে টিউশন পড়তে যাওয়ার আগে চারপিস আম দিয়ে মুড়ি। পড়ে এসে পুকুরে চান করতে গিয়ে দু’পিস। গায়ে আমের রস পরলে স্যাটাস্যাট ধুয়ে ফেল। একে বলে একশোভাগ চ্যাটচ্যাট-মুক্ত আম খাওয়া। স্কুল ফেরত বাড়ি এসে চারপিস আম-দুধভাত। ওমা, স্কুলে কত কষ্ট হয়েছে বলুন তো সামান্য পড়তে আর অসামান্য বাঁদরামো করতে! রাতে খাওয়ার সময় আরও গোটা তিন-চার বরাদ্দ ছিল। এরই মাঝে ইতিউতি গোটা দু’তিন হয়েও যেত। পরে, যখন আমের আঠা আর আমের শাঁসে থাকা টক-মিষ্টি অ্যাসিড গায়ে ঘা শুরু করে দিত তখন বাবা-মা’র মন বলত– তথাস্তু।
প্রচ্ছদের ছবি: ব্রতীন কুণ্ডু
বাঙালি ইংরেজি ক্যালেন্ডার হাতে পাওয়ার পরে, সবার আগে দুর্গাপুজোর দিন-তারিখ এবং তার মাঝে ছুটির দিন পড়ল কি না, সন্ধান করে। ঠিক তেমনই, গ্রামেগঞ্জের পথচলতি মানুষ ফাগুন চৈত্র মাসে সব গাছ ছেড়ে আম গাছের পানে নজর দেয়। আম এবার আমজনতার হাতে থাকবে না কি বাবু সম্প্রদায়ের হাতে থাকবে– সেই প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় আম-দরবারে। ফাগুন-চৈত্র মাসে কিছু জ্যোতিষীর সন্ধান পাওয়া যায়। আমের মুকুল বা বোল (গ্রামের চলতি নাম) কিংবা মঞ্জরী– আমের মঞ্জরী দেখে বলে দিতে পারেন তাঁরা, কী পরিমাণ আম হবে। আবার কালবৈশাখী বা শিলাবৃষ্টি আমের চাওয়া-পাওয়ার ওপরে বাদ সাধবে কি না! আম গণৎকারদের এদিক-ওদিক ডেকে নিয়ে যায় অনেকে, নিজের আম গাছের ভবিষ্যৎ বুঝতে। মানে শেষ অবধি আম রেখে আমসত্ত্ব খাবে নাকি তার আগেই টক ডাল খেয়ে বছর শেষ করতে হবে! আসলে আম ব্যবসায়ীদের বাড়ির টালি থেকে পাকা ঘর হবে, নাকি বর্ষায় বালতি পাতা চলবে, মেয়ের বিয়ের নাকের-কানের-হাতের স্বপ্ন সফল হবে নাকি আসছে বছর ভাবা যাবে। সাইকেল স্ট্যান্ডে বাইক কিংবা পাড়াতুতো ট্যুর বাসে জগন্নাথ দর্শন– সবই নির্ভর করবে আমের পরিমাণ দর্শনের ওপর।
আমার জীবনে আমি যতবার চমকে উঠেছি, সে প্রথম সাগর দেখে হোক বা আশ্চর্য শিশুর চার হাত-পা চাক্ষুষ করে হোক নতুবা ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল দাশুমতির সুন্দরী বউ দেখে, এসবের চেয়েও অবাক হয়েছিলাম আজ থেকে বছর ৩০ আগে বাড়িতে আসা অতিথিকে আম দিতে গিয়ে। তাঁরা আমের ঝুড়িখানা দেখে যেভাবে চমকে উঠেছিল, তা কচিবয়সি কন্যার স্বপ্নের নায়ক দর্শন করার মতো। আমি আজ সেই চমকে ওঠার মানে করতে পারি। আজ শহরের জীবনের ঘেরাটোপে বাজারের ঝুড়ি ছাড়া আমের দেখা পাওয়া দুষ্কর। যদিও গ্রামের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে তবে সেই বছর জুড়ে কালবৈশাখীর ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন আমবাগানগুলো আজ নেমপ্লেট লাগানো বাড়িতে ছেয়ে গিয়েছে।
সাল ১৯৯৬, আমি সদ্য স্কটিশ চার্চের একমাসের ছাত্র, বাংলায় অনার্স। ক্লাসে ২৬ জন ছাত্রী আর মাত্র চারজন ছেলে। সারাজীবন ছেলেদের সঙ্গে পড়ে এসেছি, মানে মেয়েদের নিয়ে প্রশ্ন আছে, উত্তরের জন্য হাপিত্যেশ অবস্থা! গ্রামে থাকাকালীন কোনও মেয়ের সঙ্গে পথেঘাটে গল্প কিংবা কোথাও যাওয়া– ‘দূর গগন কে ছাঁও মে’-র ন্যায়। সেই আমি বান্ধবী কুলের দৌলতে কফি হাউস কলেজ স্ট্রিট; এমনকী ‘মিত্রা’ সিনেমাতে বসে সিনেমা পর্যন্ত দেখেছি। তখন আমার নারী সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা যে কোনও আড়বালিয়া গ্রামের ছেলেকে ছ’গোল দিয়ে রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। সেসব হিমসাগরময় অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলাম দেশের বাড়ি আর সুযোগের অপেক্ষায় উজাড় করে বর্ণনা দেওয়ার আর অন্যের চোখে উচ্চাসন পাওয়া।
সন্ধ্যা হতেই সুযোগ করে দিল বিশু, ওর নামও বিশ্বনাথ, তবে মণ্ডল। সে কলেজ জীবনকথা জানতে চাইতেই গলগল করে বেরিয়ে এল একে একে আমার নতুন প্রাণেশ্বরীদের নাম ধাম আর সখ্য হওয়ার গল্প (আজকের হিসাবে নয়)। আমি বলে চলেছি আর ওদিকে বিশুর কল্পনা জগৎ ছুটে বেড়াচ্ছে। বিশু আর আমি সেই সন্ধ্যায় যেন কৃষ্ণ আর সুধামা আর গোপিনীগণ আমাদের চর্তুপাশে ম ম করছে। শুধু এমনই বৃন্দাবন সন্ধ্যায় রসভঙ্গ করে দিচ্ছে রসরাজ– মানে আম। এ গাছের কাশিভুতো, সে গাছের আলফানসো, ও গাছের কাঁচামিঠে পড়ার আওয়াজ বিশুকে বেশি উত্তেজিত করছে– আমার বান্ধবীদের বর্ণনার থেকেও ঢের বেশি। চতুর্থবার যখন কাশিভুতো গাছের আম মাটিতে আছড়ে পড়ল, তখন আমাকে দক্ষ ট্রাফিক পুলিশের মতো পাঁচ আঙুল দেখিয়ে আমার ভিতরের ১০০ লরি থামিয়ে বিশু যুদ্ধের ডাক পাওয়া সৈনিকের মতো ছুট দিল! যে আলোচনা ‘শ্রেষ্ঠ আলোচনা’ ছিল, তা কাশিভুতো আম আঁটির ভেপু বানিয়ে দিল!
জৈষ্ঠ্যমাস, আমের উপস্থিতি প্রতি গাছে টপক্লাস আর আমার তখন এইট ক্লাস। মাথার মধ্যে মিঠুন চক্কোতি আর কুমার শানু ঘুষঘুষে জ্বর হয়ে ঢুকে পড়েছে। গেল শতাব্দীর শেষ দশকের শুরুতে গ্রাম জীবনে বাস হলেও আজকালকার তুলনায় যেন মানুষের আদানপ্রদান একটু বেশিই ছিল। বাড়িতে আমরা চারজন (বাবা, মা, ভাই, আমি), অবিবাহিত ন’জ্যাঠা আর সেজদিদা। সেজঠাকুমা সাত্ত্বিক বিধবা– সাদা ধবধবে থান আর গায়ের রং মিলেমিশে একাকার। চোখে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। চশমাখানা পরলেই শিক্ষার ছাপ জুড়ে যেত। সারা বছর সেলাইয়ের কাজ করতেন আসনে, আর তা রামধনুর আকার ধারণ করত আমাদের চোখের সামনে। আজ সেজদিদার হাতের আসন দেখলে মনে হয় ভাগ্যিস মোবাইল ছিল না, তাহলে ওরকম আসন পাওয়া হত না। আচার তৈরি কিংবা রান্নাতেও তেমনটি ছিলেন। আর হবেন নাই বা কেন? দু’হাতের দশটা আঙুল অভিজ্ঞ কুমোরের তৈরি সরস্বতীর আঙুলের মতো। আমাদের পুরনো বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা কাটিয়ে, শ্বশুরের ভিটেতে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আসতেন। শান্ত সৃষ্টিশীল সেজঠাকুমার শান্ত অবস্থা কিঞ্চিৎ নড়ে উঠত আমের গাছে দোলা লাগলে, মানে, ঝড় উঠলে। বাঁ-হাতে ব্যাগ আর ছোট টর্চখানা নিয়ে বাড়ির সামনের বাগানের আম যাতে বেহাত না হয়ে যায় তাই তাঁর সূক্ষ্ম সেলাইয়ের আঙুল দিয়ে চিরুনি তল্লাশি চালাতেন বাগানময়। তাঁর ঝড়ের রাতে আম খোঁজার সাহস আমাদের অবাক করত, উল্টোদিকে রোদে শুকাতে দেওয়া আচারময় আমতেলময় কাচের বয়াম এলোমেলো শুকনো জিভকে লালায়িত করে তুলতেও সময় নিত না।
আমাদের স্কুল, আড়বালিয়া জ্ঞান বিকাশনী উচ্চ বিদ্যালয় তার কৃতি ছাত্রদের জন্য দেশবিদেশে পরিচিত। আমাদের কাছে স্কুল কানাইদাদুর দোকানের সামনে– এটাও একটা পরিচয়। কারণ, ঘুঘনি-পাউরুটি, ঝাল লজেন্স, কচু ভাজার মতো জিভ লকলক করার কারণ সব মজুত কানাইদাদুর দোকানে। শ্রাবণের মধ্যেকালে দোকানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। নিজের পকেটের পয়সা শেষ। এবার বন্ধুদের কেনা জিনিসে হাত দেব। ভাবছেন শ্রাবণের শুরুতে আম আসছে কোথা থেকে? শহর কলকাতা হলেও পাওয়ার সুযোগ আছে সে হিমঘর ফেরত হোক কিংবা বাইরের রাজ্যে থেকে আসা। আজ্ঞে না, গ্রামের সব রসরাজ রাজ্যপাট গুটিয়ে যখন বাৎসরিক ছুটিতে চলে গেছে। তখন একমাত্র ‘মধুগুলগুলি’ ক্লাসে পড়া না-পারা ছাত্রদের মাঝে একা হাততোলা ফার্স্টবয়ের মতো গাছে ঝুলে থাকে।
আমাদের গ্রাম জীবনের এটাই চেনা ছবি ছিল, হ্যাঁ, ‘ছিল’। মধুগুলগুলি আম নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন থাকলে তা গুগল গুলিয়ে দেখে নিতে পারেন। আকারে ছোট পাকলে হালকা লাল ছিটে পাতার রঙের সঙ্গে মিশে লুকোচুরি খেলত। আমাদের স্কুলের সামনের বাগানে শেষ পাড়ানির কড়ি হয়ে থাকত। সেই আমের দায়িত্ব কানাইদাদুর হাতে তুলে দিতেন গাছের মালিক সন্তোষ ঘোষ। একে স্কুলের সামনে, তার ওপর অসময়ের উপস্থিতি সুতরাং জাঁদরেল পাহারাদার না রাখলে ‘হোকাস-ফোকাস গিলিগিলি গে’ হতে সময় লাগবে না। জানতেন বহু সম্পত্তি ও মধুগুলগুলির মূল মালিক সন্তোষ ঘোষ মশাই। কানাইদাদু দোকানের পাশে মিউনিসিপালিটির কলে স্নান করছিল, পরনে সামান্য গামছাখানি। পরনের গামছা ফিনফিনে হয়ে গেলেও মধুগুলগুলি আর তার ভক্তদের প্রতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি যে কোনও সিসিটিভিকে পাঁচ গোল দিয়ে দেবে। তবে হাজার সিসিটিভিতেও তো কত মণিমুক্ত হাপিস হয়ে যায়! আর এ তো আম!
সেদিন মধুগুলগুলি লোভীর দল দক্ষ ব্ল্যাক কমান্ডোর মতো গাছের ওপরে। পাতা নড়তে দিচ্ছে না পর্যন্ত, ঠিক তখনই কারও একচুল ভুলে ডালখানা নড়ে উঠল। আপনি-আমি হলে ও হাওয়ায় দুলে উঠেছে বলে ভেবে নিতাম বা মনে করতাম হনুমানের কাজ– কিন্তু ৩০ বছর সার্কাসে চাকরি করা কানাইদাদু তা ভাববে না। কারণ, ঘরের প্রাণী আর জঙ্গলের প্রাণীদের চলন-বলন-উপস্থিতির পার্থক্য নখের ডগায়। যারাই গাছে ছিল, তারা সবার কাছে ‘মানুষের বাচ্চা’ হলেও কানাইদাদুর কাছে বিষ্ণুর তৃতীয় অবতারের সন্তান। আরও বিশেষ বিশেষ বিশেষণ ছেটাতে ছেটাতে দৌড় দিল। পরনের গামছা দৌড়ানোর গতির সঙ্গে সঙ্গে কোমরের নিচে থেকে আরও নিচে চলে গেল। কানাইদাদু সভ্যতার আদিমকালে মানুষ কেমন ছিল, তা চাক্ষুষ করিয়েছিল সেদিন।
আমার সারাদিনে গোটা ১৬ আম খাওয়ার কথা আমার চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই জানেন। এ বিষয়ের প্রচার সচিব হলেন অভিনেতা ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়। আমার সাদা মনে কাদা নেই, কবে বলে ফেলেছি আমার আম ভাবের কথা! খাটের তলায় বিছানো আম আর প্রতি রাতে জলে ভেজানো আম চলত বৈশাখের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের শেষ অবধি। সকালে টিউশন পড়তে যাওয়ার আগে চারপিস আম দিয়ে মুড়ি। পড়ে এসে পুকুরে চান করতে গিয়ে দু’পিস। গায়ে আমের রস পরলে স্যাটাস্যাট ধুয়ে ফেল। একে বলে একশোভাগ চ্যাটচ্যাট-মুক্ত আম খাওয়া। স্কুল ফেরত বাড়ি এসে চারপিস আম-দুধভাত। ওমা, স্কুলে কত কষ্ট হয়েছে বলুন তো সামান্য পড়তে আর অসামান্য বাঁদরামো করতে! রাতে খাওয়ার সময় আরও গোটা তিন-চার বরাদ্দ ছিল। এরই মাঝে ইতিউতি গোটা দু’তিন হয়েও যেত। পরে, যখন আমের আঠা আর আমের শাঁসে থাকা টক-মিষ্টি অ্যাসিড গায়ে ঘা শুরু করে দিত তখন বাবা-মা’র মন বলত– তথাস্তু।
বাড়ির সামনে ঘামাচি আমগাছ ছিল। গরমের তাপে মানুষের ঘামাচি হয় যেরকম, আমের গায়েও ঠিক সেরকম ঘামাচি থাকত। আজ আম নিয়ে অনেক কথা শুধু স্মৃতিকথা হয়ে গিয়েছে। আমার নিজের ঠাকুরমার আম খাওয়া দেখলে বোঝা যেত ৩০ বছরে বিধবা, ১১ সন্তানের মায়ের রসনার একমাত্র সুলুক হল রসরাজ আম। তাই ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর ফুলজ্যাঠা আম খাওয়া ত্যাগ করেছিল। আজ বুঝি সেই ত্যাগ খুব একটা আমকথা নয়।
শেষে বলি, বাঙালি জীবনে হাজার সমস্যা অ-এ অজগরের ন্যায় যতই তেড়ে আসুক। আ-এ আমটি যেন পেড়ে খেতে পারে বাঙালি।
…………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………….