Robbar

ছাদ থাকুক না থাকুক, আমরা চন্দ্রাহত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 9, 2025 3:38 pm
  • Updated:September 9, 2025 6:51 pm  

৭ সেপ্টেম্বর , অনেক দিন পর আমরা ফের বুঝলাম, চাঁদ আছে আমাদের আকাশে। চাঁদ বদলেছিল তাঁর রং। লাল হয়েছিল। চাঁদের দিকে আমরা ফিরে তাকালাম আরেকবার। একসময় চাঁদের সঙ্গে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যোগাযোগ ছিল বইকি। চন্দ্রাহত সেই প্রজন্ম আজ দূরে, বহুদূরে। লাল চাঁদের সৌজন্যে, আবার একবার, মাথা তোলা– চাঁদের দিকে তাকানো। 

প্রচ্ছদের আলোকচিত্র: সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়

মনোজ দে

‘ছাদে উঠে এলে ছাদ
গৌণ হয়ে যায়
মুখ্য হয়ে ওঠে আকাশ, নক্ষত্র…’
এই উচ্চারণের প্রাথমিক শর্ত হল ছাদে ওঠা। তারপর আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে অনুভব। সেই ছুতোয় আসবে আকাশ, নক্ষত্র আর বিপরীতে ইহলোক। আর আপনি এই সব কিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেবেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল আপনাকে সীমিত করে। ধরুন, আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করি– ‘শেষ কবে ছাদে উঠেছেন?’ আপনি উত্তর দিতে পারবেন? পারলেও, দেখবেন পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনও অজুহাত অথবা অবাধ্য কারণ।
আমরা যারা জেন-জেড নই, সকলেরই ছাদ বললে বয়ঃসন্ধি মনে পড়ে। অথবা মনে পড়ে, দূরের ছাদে বইমুখে হাঁটতে থাকা কোনও অস্পষ্ট মেয়েকে। চোখ বন্ধ করলে সেই ছবি আরও সজীব হয়ে ওঠে। দেখি কোনও ধূসর মেয়ে ওড়না বুকে পায়চারি করছে। চারিদিকে দেখে নিই আমরা। কেউ তো দেখেনি আমায়। ওর পাশে কেউ তো নেই! দেখি সন্ধ্যার আগেই ছাদে ভিড় জমে যৌথপরিবারের গৃহবধূদের। সে এক অদ্ভুত কথপোকথন। যে কাকিমার সঙ্গে বনিবনা নেই, তার মেয়ে তো রোজ লুকিয়ে ছাদে উঠে। ফোনে কথা বলে। নিশ্চয়ই প্রেমিক তার! মায়েরা জানে। জানে ছেলেটি তার সহপাঠী। একসঙ্গে টিউশনি যায়। আড়চোখে মায়েদের দেখে পাশাপাশি সাইকেল এগিয়ে যায় কিছুটা। আর কৌতূহলে মায়েরাও ঝুঁকে দেখে, ছেলেটি পকেট থেকে কিছু একটা বের করে মেয়েটিকে দিল। চিঠি? নিশ্চয়ই! ছাদে তুমুল আলোচনা। ছেলেটির জাত কী? ওর বাবা তো লটারির টিকিট বিক্রেতা। মায়েরা জানে। আর জানে ছাদের পাঁচিল। নীচে পান-গুমটি পেরিয়ে কতজন হেঁটে যায়। তাদের নাম জানি না আমরা। মায়েরা জানে।
বছর পঞ্চাশের মহিলা। পরনে সালোয়ার কামিজ। লাটবাঁধ পাড়ে বাড়ি। রোজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে ফেরে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়নি। ছেলে-বউমার সঙ্গে রোজ অশান্তি হয়। গায়ে হাত তোলে। গতকাল অফিসে যায়নি। অসুস্থ কি তবে? মায়েরা জানে। ছাদ জেনে যায়। জানে, দূরের জানালায় রোজ ওদের কাজের মেয়ে সন্ধ্যা দেয়। ওর বউ মানসিক ভারসাম্যহীন। বর মাতাল। ছেলেরা জুয়া খেলে। এখনই বাড়ি ফিরবে ছাদের দিকে পুরুষালি তাকিয়ে। ওপর থেকে ধেয়ে যায় অবজ্ঞা, কিছুটা করুণা কি থাকে? মায়েরা জানে। আর আমরা যতটুকু জানি ছাদ সম্পর্কে, তা হল একটা ক্রিকেট মাঠ। পরের দিন রং বদলে হয়ে ওঠে ‘আয় রে আয় টিয়ে’। অথবা টিউশন থেকে ফিরে চা-মুড়ি খাওয়ায় অবসর।
ছাদ ছিল আমাদের বন্ধু। ঘুড়ি ওড়ানো, লুডো, লুকোচুরি, কখনও-বা মায়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যেখানে আমরা উঁকি দিয়ে দেখতাম রিকশায় কোন সিনেমার বিজ্ঞাপন? দেখতাম ঠাকুর বিসর্জন। কলতলায় কার বালতি নামানো আছে। আর টিউশনফেরত ধূসর রঙের মেয়েকে। মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখতাম ছাদ। প্লাস্টারবিহীন দেওয়ালের ভেতর রঙিন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। দেখতাম মায়েরা ছাদে উঠেছে কি না? ওই কাকিমার মেয়ের টিউশন ছুটি হবে। পাড়ার দাদাকে তাই খবর পৌঁছিয়ে দিই। দিদি এগিয়ে যায়। জানি, এই খবর ঠিক পৌঁছে যাবে ছাদে। আমি নারদ। আমি উধাও। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, মায়েদের পায়ের ব্যথাও। দিদির বিয়ে ঠিক হয়। আজ পাকা কথা। সামনের অঘ্রানে বিয়ে। এখন সাইকেল পাশাপাশি। স্পষ্ট চোখে দেখে নেয় পাঁচিলে কে কে দাঁড়িয়ে। মায়েরা তাকাতে পারে না। সন্ধ্যার অজুহাতে নীচে নেমে আসে। একা ছাদ আর চন্দ্রাহত প্রজন্ম আমাদের।
আমাদের প্রত্যেকের একজন বন্ধু থাকে। যাদের একতলা বাড়ি। সিঁড়ি নেই। বিকেলে সে আমাদের ছাদে এসে বসত। দুঃখ হয় ওর জন্য। চুনসুরকির এই ছাদকে রাজপ্রাসাদ ভেবে নেওয়া আমি মনে মনে খুব গর্ব করতাম। এমনকী, মামাবাড়ি গিয়ে অনেকবার গর্ব করেছি ছাদ নিয়ে। তারপর হু হু সময় বয়ে গেছে। আবাস যোজনার বদান্যতায় মামাবাড়ির ভরে গিয়েছে দালানে। তাই এখন আর ভাল্লাগে না। সম্ভবত, গর্ব করতে পারি না বলেই এই মনখারাপ। মনখারাপ হয় বন্ধুর জন্যও। যে একসময় রোজ ছাদে এসে বসত। সে এখন কর্পোরেট। চপ্পল, ঝোলা ব্যাগের বদলে সে তুলে নিয়েছে ল্যাপটপ। চাকরি পাওয়ার আগে বলেছিল বাবার কথা। কারখানা বন্ধ হলে তীব্র রাগে তাঁর ফেটে পড়া। ‘আমার বাপ কুনো পয়সা রেখে যায় নাই তো কী হয়ছে, মাথার উপর একটা গটা ছাদ রেখে গ্যাছে।’ এরপর বিশ্বায়ন আসে। আসে বিজ্ঞাপন লালিত জীবন। আসে ভোগবাদ, পুঁজির বাহুল্য। ভাষা বদলে যায়, বদলে যায় মেটাফর, প্রাসঙ্গিকতা। তাই অকারণে ছাদে ওঠা নয়। নীল শেডে ওটা রুফটপ। নতুন কেতাবি নামে বদলেছে ব্যবহার। লোকাচারের বদলে রেস্তরাঁ। বহুকালের জমানো গর্ব যেন দলা পাকিয়ে আসে। শুধুমাত্র ছাদে যাব বলে বহুকাল আমিও তো ছাদে উঠিনি। মেঘ দেখে বুঝিনি বাদল।
আজ এই দৈনতায় বন্ধুর সঙ্গেও অবশেষে দেখা হয়ে যায়। দেখা হয়, কারণ শোক ফুরিয়ে যায়। নস্টালজিয়া বালির মতোই সরে যেতে থাকে। পুরনো শহর, পাড়া– যাকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। তার থেকে শেষবারের মতো শুষে নিই স্মৃতি। কথায় কথায় উঠে আসে ইশকুলবেলা। ক্রিকেট, আড্ডা আর আমাদের ছাদ শেষবারের মতো অব্যর্থ হয়ে ওঠে। সে জানায় চাকরিসূত্রে বউ-বাচ্চা নিয়ে এখন কলকাতায়। ঠিক কলকাতা নয়, নিউটাউন, এক্সটেন্ডেড কলকাতা। যে রাস্তা থেকে টিউশন ফেরত দিদি কোনও অছিলায় মুখ তুলে দেখে নিত ছাদ, তার থেকে বহু, বহু উঁচু অফিস। তবু, সিঁড়ি বানানোর মতো সামর্থ হল না। বহুতল ফ্ল্যাট, লিফটে ওঠানামা তাই। ইটালিয়ান মার্বেল, ফলস্ সিলিংয়ে ভুলেছে পুরনো জীর্ণ বাড়ি। জানালায় এসে দাঁড়ালে আকাশ নয়, অর্ধেক শহর ধরা পড়ে। ধরা পড়ে অজস্র উড়ালপুল, বাস, মেট্রো আর নীচে হেঁটে যাওয়া দু’-একটা লোক। পুকুরপাড়ের ফ্যাকাসে বাড়ি, গ্রিলের ভেতর দিয়ে উঁকি দেওয়া রান্নাঘর, অফিসফেরত মহিলা, সাবেকি কলতলা এখানে নেই। এখানে নেই পায়ের ব্যথা, নেই বনিবনাহীন কাকিমার মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া। সম্পর্ক ধরা পড়ে না এখানে। ধ্বনি দিলে নিরাপত্তারক্ষী এসে যায়। সময়ে আসে ডেলিভারি বয়, ড্রাইভার। ব্যাগ তুলে গাড়ি অবধি এগিয়ে দেয়। জেঠু মারা গিয়েছে। তাই ছুটি নিয়ে চারফুটের কানা গলিতে ফিরে আসা। ছাদের পাঁচিলে সূর্য ডুবলে সে যায় দশেরবাঁধ। কুড়ি টাকা দিয়ে কিনে ঠান্ডা জলের বোতল। ওল্ড মঙ্ক। সিঁড়িকাঠ কিনে ছাদে ওঠে। তারা দেখে ফল খায়। অথচ একদিন, দু’মুঠো ভাতের পর বাঙালি তো এইটুকুই চেয়েছিল– পায়ের নীচে মাটি আর মাথার উপর ছাদের নিশ্চয়তা। আমরা পায়ের নীচে মাটি হারিয়েছি গত শতকে, আর এই শতকে এসে ছাদ হারালাম।