Robbar

দুর্গাপুজোর শিল্প-সমারোহ আদৌ কি ‘পাবলিক আর্ট’?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 5, 2025 4:57 pm
  • Updated:October 6, 2025 10:57 am  

দুর্গোৎসব যেদিন থেকে বারোয়ারি হয়ে উঠে, বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে গণপরিসরে এসে দাঁড়াল, সেদিন থেকেই সে আর প্রাইভেট থাকেনি। আর ধর্মকে কেন্দ্র করে শিল্পের গড়ে ওঠার ইতিহাসও যথেষ্ট পুরাতন: অজন্তা, খাজুরাহো, সাঁচী, ইউরোপিয়ান চার্চ– এই তালিকা সুদীর্ঘ। তাছাড়া, সিরাজকে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়ের উদ্‌যাপনে যখন থেকে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপুজোকে বেছে নিলেন– দুর্গামূর্তির চালির ওপরে ইউনিকর্ন, ইউনিয়ন জ্যাক আর অসুরের পেশীবহুল ইউরোপিয়ান অ্যানাটমিও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেই এসেছিল, লোকে দেখবে বলে। সুতরাং, এই দশকের গোড়া থেকে নতুন করে দুর্গোৎসবকে ‘পাবলিক আর্ট’ বলার ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার বোধকরি সঙ্গত কারণ আছে।

প্রচ্ছদের ছবি: অমিত মৌলিক

ঐন্দ্রিলা মাইতি সুরাই

গত প্রায় দু’-দশক জুড়ে পুজো প্যান্ডেল, প্রতিমার আকার আর অভিনবত্বের কারণে মুগ্ধনেত্রে এই শৈলীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। সেই মুগ্ধতার রেশ বেড়েই চলেছে পুজো-শৈলীর বিন্যাসে, আলো এবং আবহের নাটকীয় সমন্বয়ে। দেখামাত্র ঠোঁট ছাপিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে পড়ে একটাই শব্দ: অপূর্ব!

‘অপূর্ব’, ‘সুন্দর’, ‘দারুণ’, ‘সাংঘাতিক’– এগুলো ইতিবাচক শব্দ। এই শব্দরা বাদ পড়লে দুর্গাঠাকুর আর প্যান্ডেল সুবিচার পায় না। খারাপ লাগলে বড়জোর ‘খারাপ’, ‘ফালতু’, ‘জঘন্য’। সহজ সরল প্রতিক্রিয়া। হয় সাদা, নয় কালো। অর্থাৎ, কড়া, জটিল সমালোচনার ধাতটা এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। কারণ, দুর্গাপুজো ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এলিটদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্র নয়। তার কলা সমালোচনা খবরের কাগজে বেরয় না। মূলত সাধারণ মানুষের বিনোদনের জায়গা; চোখের খোরাক। মাথা ঘামানোর জায়গা নয়। দিনের শেষে প্রতিমা সুন্দর হল কি না, প্যান্ডেল দুর্দান্ত হল কি না– এইটা হল মোদ্দা কথা। আদতে ধর্ম-আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যায়ন পবিত্রতার নামান্তর মাত্র। সেখানে সব কিছু্র মধ্যেই জড়িয়ে থাকে পারিপাট্য, পরিচ্ছন্নতা, একটা শৃঙ্খলা এবং একটা প্রচলিত আখ্যান, যার একটা নির্দিষ্ট শুরু-মাঝখান-শেষ আছে (তা সেন্টিমেন্টাল-ও)। আকস্মিকতা, ছন্দপতন, অনিশ্চয়তা, অসম্পূর্ণতা এই আখ্যান এবং আচারের অঙ্গ নয়। সুতরাং, এই চর্চার মধ্যে পাশ্চাত্য শিল্পের minimalism, rhetoric, conceptual art, chaos, disruption-এর মতো উল্টো তত্ত্ব খাটবে না। অথবা, এই উপাদানগুলোর সংযোজন হলে তা নিতান্ত ওপর থেকে চাপানো হবে। ইতিহাসের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গ হিসেবে সেসব আসবে না। 

ঠাকুর দেখার ভিড়

সমস্যাটা শুরু হল যখন উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার সঙ্গে ইন্টারনেটও এল। অগাধ তথ্য এবং ছবি হাতের মুঠোয় চলে আসার ফলস্বরূপ দুর্গাপুজোর পরিসরে যুক্ত শিল্পীদের একাংশ ডেকরেটরদের তৈরি করা প্যান্ডেলের একঘেয়ে ছক ভেঙে থিম-কেন্দ্রিক হলেন এবং দেড় দশকের মধ্যেই আন্তর্জাতিক, সমসাময়িক মূলধারার শিল্পচর্চা থেকে নির্বাচিত কিছু নাটকীয় উপাদানের আশ্রয় নিলেন। পুজোর আঙিনায় সেসব উপাদান ঢুকল বটে, তবে তাদের স্বাভাবিক উত্থান-পতনের ইতিহাসের ধারার মধ্যে দিয়ে নয়। সরল মানুষের বিনোদনের এই ক্ষেত্রটায় যাচাই করার মতো কেউ ছিল না বলে, প্রশ্নের মুখোমুখি তাদের হতে হল না। তিলেতিলে গড়ে ওঠার নিজস্ব যে ইতিহাস, তা এড়িয়ে বিনা বাধায় ঢুকে পড়ল সেসব, অনুপ্রবেশকারীর মতো। ফল– ছত্রভঙ্গ। 

পুজো শপিংয়ের ভিড়

 

আচমকাই শিল্পী-দর্শক-সাংবাদিক-ভ্লগারদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল শব্দগুলো– পাবলিক-আর্ট, সাইট-স্পেসিফিক আর্ট, ইন্সটলেশন (-আর্ট)। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল সুন্দর করে সাজানোর মধ্যে এইসব শব্দদের প্রথম কে দেখতে পেয়েছিলেন বলা মুস্কিল, তবে ২০২০-’২১ সাল নাগাদ আর্ট কলেজের ক্লাসরুম আর ওয়ার্কশপ-গুলো থেকেই তর্ক বাধতে শুরু করল শিক্ষক আর ছাত্রদের মধ্যে; মডারেটর আর বক্তাদের মধ্যে। এই ডামাডোলের মধ্যেই এক শ্রেণির দুর্গাপুজো-শিল্পী মশগুল হয়ে রইলেন তাঁদের অনড় দাবিতে– তাঁরা যে ধরনের প্যান্ডেল নির্মাণ করে থাকেন– সেগুলি ইন্সটলেশন আর্ট; নিছক প্যান্ডেল নয়। কেন এই দাবি তা বোঝা দুষ্কর। তবে প্যান্ডেল নির্মাণে যে একটা অভিনবত্ব এসেছে, ২০১৫ সাল থেকেই তার একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। এর পাশাপাশি পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যে শিল্পীদের স্বাধীনতা দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ল। উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি পেল পুজোর বিন্যাসে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণেই হয়তো আমরা ভুলে গেলাম– বিশালাকারের প্যান্ডেল নির্মাণের অভিনবত্ব, নাটকীয় উপাদানের প্রয়োগ মানেই কিন্তু ইন্সটলেশন আর্ট নয়। প্যান্ডেল ভরাট করে, সুন্দর করে সাজিয়ে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে একাধিক উপাদানের ব্যবহার। ফর্ম বা আকারের নিরিখে এগুলি স্কাল্পচার (যা স্বয়ংসম্পূর্ণ), শিল্পবস্তু বা মোটিফ। এদের মধ্যে কথোপকথনের সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ, একটি বস্তুর অনুপস্থিতিতে এই কথোপকথনে যে ছেদ পড়বে, এমনটা নয়। ইন্সটলেশন আর্ট-এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন এবং বিভিন্ন (disparate, disjunctive) শিল্পবস্তুর মধ্যে এই কথোপকথনটাই কেন্দ্রবিন্দু। একটা অর্কেস্ট্রেশন যেন। যদিও এই বিচ্ছিন্ন বস্তুর পাশাপাশি থাকাটাই শেষ কথা নয়। ইন্সটলেশন আর্টে দর্শকের সঙ্গে শিল্পী এই বস্তুদের একটা সম্পর্ক তৈরি করেন; বস্তু এবং স্থান প্রত্যক্ষ করার মধ্যে দিয়ে দর্শককে নতুন প্রতীকী অর্থ সৃষ্টি করতে বাধ্য করেন শিল্পী। উপরন্তু, হয়তো বিন্যাসের অভিনবত্ব আর সেসব দেখার সুবাদে দর্শকের সংখ্যা নাগাড়ে বাড়তে থাকায় অনেকের মনে হয়েছিল এটাকে পাবলিক আর্ট বললে আরও ভালো হয়। এখানেও আমরা ভুলে গেলাম যে দুর্গোৎসব যেদিন থেকে বারোয়ারি হয়ে উঠে, বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে গণপরিসরে এসে দাঁড়াল, সেদিন থেকেই সে আর প্রাইভেট থাকেনি। আর ধর্মকে কেন্দ্র করে শিল্পের গড়ে ওঠার ইতিহাসও যথেষ্ট পুরাতন: অজন্তা, খাজুরাহো, সাঁচী, ইউরোপিয়ান চার্চ– এই তালিকা সুদীর্ঘ। তাছাড়া, সিরাজকে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়ের উদ্‌যাপনে যখন থেকে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপুজোকে বেছে নিলেন– দুর্গামূর্তির চালির ওপরে ইউনিকর্ন, ইউনিয়ন জ্যাক আর অসুরের পেশীবহুল ইউরোপিয়ান অ্যানাটমিও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেই এসেছিল, লোকে দেখবে বলে। সুতরাং, এই দশকের গোড়া থেকে নতুন করে দুর্গোৎসবকে ‘পাবলিক আর্ট’ বলার ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার বোধকরি সংগত কারণ আছে। 

কুমোরটুলিতে পুজোর আগেই লেগে থাকে একবগ্গা ভিড়

 

মিউজিয়াম বা আর্ট গ্যালারির (যাকে তির্যকভাবে ‘হোয়াইট কিউব’ বলা হয়– রুদ্ধদ্বার, এক ঝলক আলোরও প্রবেশাধিকার না থাকার কারণে) কাজই হল শিল্প-সামগ্রী বা সংগ্রহকে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায়, নিয়ন্ত্রিত আলোর মোড়কে সময়-ঝড়-জল-হাতের ছোঁয়া থেকে রক্ষা করা। অর্থাৎ, জনসাধারণের নাগালের বাইরে তাদের কৃত্রিমভাবে রক্ষা করা। সংগ্রহশালায় খোলা আকাশের নীচ থেকে সংগৃহীত বস্তুকে এভাবে বোতলবন্দী করে রক্ষা করা গেল ঠিকই, কিন্তু নিজের উৎস থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে সংগৃহীত বস্তুবিশেষ তার মূল কাজ এবং আদি ইতিহাস থেকেও সম্পূর্ণ বিচ্যুত হল। পরিপ্রেক্ষিত গেল বদলে। পরিচয়হীন হয়ে পড়ল সে। ইউরোপের সাহেবরা যদ্দিনে নিজেদের দেশের বাইরে থেকে এক্সোটিক বস্তুদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের সংগ্রহশালা ভরিয়ে তুলেছে, তদ্দিনে শিবলিঙ্গ বা আফ্রিকান মাস্ক তার ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতটা একেবারেই হারিয়ে শুকনো ডালের মতো অকেজো হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এই তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে সামাজিক-ধর্মীয়-জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য বস্তুরটির মধ্যে থেকে তার নিজস্ব সময়সীমা এবং সামাজিক উদ্দেশ্যটাই মুছে গেল। গণপরিসর থেকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সেটা হলে গেল আর্কাইভ্‌ড; ব্যক্তিগত মালিকানার বস্তুও। বাজারমূল্য, বিক্রিযোগ্যতার কারণে হোয়াইট কিউবে থাকা শিল্পবস্তুও বিক্রি হওয়া অবধি নিয়ন্ত্রিত বাতাবরণেই থাকে, যাতে সর্বসাধারণের দৃষ্টি-স্পর্শ-ঝড়ঝাপ্টা থেকে তাকে সুরক্ষিত রাখা যায়। অর্থাৎ, গণপরিসরে যে অবাধ আনাগোনা, এখানে তা নিষিদ্ধ। আজকের থিম-কেন্দ্রিক পুজোর ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণই চোখে পড়ে। প্যান্ডেলের ভেতর সর্বসাধারণের প্রবেশ অবাধ নয়। সিসিটিভি ক্যামেরা-সিকিউরিটি গার্ড-পুলিশ-স্পর্শ না করার চেতাবনি-কৃত্রিম আলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সেন্সরড দর্শকের মূল উদ্দেশ্য যায় হারিয়ে। সমসাময়িক পাবলিক আর্ট নিজেকে দুর্যোগ, স্পর্শ থেকে আগলে রাখে না। পুজোর নির্মাতারা যদি ‘পাবলিক আর্ট’ সততই চাইতেন, তাহলে বৃষ্টিতে কী হবে, তা নিয়ে তাঁদের নিশ্চয়ই মাথাব্যথা থাকত না। আসলে ‘আর্ট ইন দ্য পাবলিক স্পেস’ আর ‘পাবলিক আর্ট’-এর ধারণার মধ্যে বোধহয় কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে। প্রথমটির ক্ষেত্রে স্থাপত্য বা শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য শৈল্পিক হস্তক্ষেপ– এই হল গতানুগতিক ধারণা। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের ভাবনা অনুযায়ী– ‘জনগণের স্বার্থে শিল্প’ ( সোশ্যাল ইন্টারভেনশানিজম, কমিউনিটি আর্ট ইত্যাদি)– এই পথেই চলেছে পাবলিক আর্ট।

থিম নেই, মানে ভিড় নেই? উঠছে প্রশ্ন

 

আমাদের আলোচনা দ্বিতীয়টির চরিত্র নিয়ে। কারণ, দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে এটিরই খোলনলচে বদলে সুবিধেমতো গড়ে নেওয়া হচ্ছে। সচেতনভাবে এই দ্বিতীয়টির ইতিহাস কলকাতায় শুরু ২০০৫ সাল নাগাদ, খোঁজ কলকাতার বারুইপুরের প্রকল্পটি দিয়ে। মনে রাখা প্রয়োজন, ‘পাবলিক আর্ট’-এর দর্শক নিষ্ক্রিয় নন, মূক নন। অর্থাৎ, একটা ভিস্যুয়াল স্পেকট্যাকল শুধু দেখে চলে যাওয়া তাঁদের কাজ নয়। ‘পাবলিক আর্ট’-এর দর্শক সক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট শিল্পকর্মটির অঙ্গ হয়ে ওঠেন। অংশগ্রহণ করেন তার সঙ্গে। প্রতীকী ও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে শিল্পকর্মের স্থানটি। 

হরিদেবপুর বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো প্রতিমা। ছবি সৌজন্য: দীপাঞ্জন দে

 

সাইট-স্পেসিফিক আর্টের জন্ম শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিরোধে। শিল্পকে নিছক পণ্যবস্তুতে পরিণত না-হতে দেওয়ার প্রতিবাদে। শিল্পসামগ্রী বিক্রিযোগ্য তখনই হয় যখন তা হাত বদল হওয়ার জায়গায় থাকে। যেমন পেইন্টিং বা স্কাল্পচার। কারণ এগুলো মূলত ঘর সাজানোর উদ্দেশ্যে কেনা হয়। ফলে এদের আকৃতিও ঘরের মাপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নির্মিত। বস্তু বিক্রিযোগ্য হলে হাত বদলায়, মালিকানা বদলানোর সঙ্গে– গ্যালারি থেকে ব্যক্তিবিশেষের হাতে; তারপর নিলামে, ইত্যাদি। সুতরাং, এই মালিকানা সহজে বদলানো শিল্পবস্তুদের ‘যাযাবর শিল্প’ (nomadic art) বলেও অভিহিত করা হয়। সাইট-স্পেসিফিক আর্ট আকারে সুবিশাল। যাতে তাকে স্থানচ্যুত না করা যায়, বা গ্যালারির গণ্ডিতে আবদ্ধ করা না যায়। তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্থায়ী বস্তু দিয়ে নির্মিত। এইখানেই তার প্রতিরোধ। দুর্গাপুজো বাণিজ্যকে অস্বীকার করে নির্মিত হবে কীভাবে? দুর্গাপুজোর বিন্যাসের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা সাইট-স্পেসিফিসিটির দর্শনের বৈরিতা এইখানে। দুর্গাপুজোকে ‘আর্ট’ হিসেবে ভাবতে চাইলে তার একটা দীর্ঘস্থায়ী, যুক্তিযুক্ত, অবিচলিত দর্শন প্রয়োজন। কেবল আকারে বড়, অনেকটা ছড়িয়ে তৈরি হয় বলেই দুর্গাপুজো সাইট-স্পেসিফিক কি?– ভেবে দেখা দরকার।

হরিদেবপুর বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। ছবি সৌজন্য: দীপাঞ্জন দে

 

এছাড়া, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে সাইট-স্পেসিফিক শিল্পকর্মের। তাকে তার প্রাথমিক স্থান থেকে বিচ্যুত করা যায় না সাধারণত: যে ভূগোলের মধ্যে স্থাপিত সে, সেই মানচিত্রের ইতিহাসেও সে নিহিত। আঞ্চলিক ইতিহাস, তার ক্ষত, তার স্মৃতির উদযাপনই এমন নির্মাণের ভিত্তি। অঞ্চলপ্রতি, গড়ে আধ ডজন প্যান্ডেলের মধ্যে কোনটা সে অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাস-ক্ষত-স্মৃতি তুলে ধরে, খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য যা নির্মিত, তাকে গালভরা নাম দেওয়া বড় বালাই। বিশেষত যখন কলকাতা শহরের প্যান্ডেলে বুর্জ খলিফা, মধুবনী শিল্প বা ডিজনিল্যান্ডও অভিনবত্বের নিরিখে ‘দারুণ’ হয়ে ওঠে। পুজোর ক্ষেত্রে আমরা ‘ওখানের জিনিসটা এখানে’ বানাই। রেপ্লিকেট করার এই অভ্যাস থেকে না বেরতে পারলে পাবলিক আর্ট, সাইট-স্পেসিফিক শিল্প ইত্যাদি নামকরণের লোভ সংবরণ একান্ত জরুরি।