শিশুরা তো আর চিরকাল মাতৃক্রোড়ে থাকে না। কারণ বরাবর শিশুই থাকে না তারা। ক্রমে কৈশোরে পৌঁছয়, পড়াশোনা শিখতে আরম্ভ করে, স্কুলে যায়। মাসি-পিসি, চাঁদ-সূর্য, ল্যাজঝোলা পাখি, তাকে দুধ কলা খাওয়ানো অতিক্রম করে বাড়তে থাকে তার ভাবনার পরিসর। বিশ্ব সম্পর্কে তখন তার অদম্য কৌতূহল। কতকটা সেই কৌতূহল নিরসন করতে আর তার মানসিক বৃদ্ধি গঠনমূলক করার উদ্দেশ্য নিয়ে এবার প্রয়োজন হয় লুলাবাইয়ের বদলে ‘বেডটাইম স্টোরিজ’-এর। তাকে তখন গল্প শোনাতে হয়।
প্রচ্ছদের শিল্পী: চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য
বিস্তর ডাক্তার-বদ্যি দেখানোর পর কাজ না হওয়ায় শেষে অনিদ্রা রোগ সারাতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফাস্ট বোলার বব উইলিসকে। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক সবদিক বিচার করে একটা অডিও ক্যাসেট দিয়েছিলেন তাঁর রোগীকে। সেখানে রেকর্ড করা গানটি চালিয়ে বিছানায় শুয়ে রাত্রে ঘুমের চেষ্টা করতে বলার নিদান দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু।
ঘুম ব্যাপারটা অনেকের কাছে খুব সহজ, কারও পক্ষে কঠিন। কারও কম হয় নানা কারণে, কিছু লোকের বেশি। ঘুমের মাত্রা কমলেও বিপদ, বাড়লেও তাই। সেই জন্যই বোধহয় মানুষের একেবারে ছেলেবেলা, বলতে গেলে জন্মের পর থেকেই শিশুর বাবা-মা চেষ্টা করে সন্তানের ঘুমের ব্যাপারটা যথাসম্ভব নিশ্চিত করার। ঘুমপাড়ানি গান, গল্প, যাকে বলে ‘বেডটাইম স্টোরি’ প্রভৃতির উদ্ভব এই কারণেই এবং এটা কোনও বিশেষ এলাকা বা সমাজে আবদ্ধ নেই। সারা পৃথিবীর, সম্ভবত পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতায় শিশুকে ঘুম পাড়ানোর প্রচেষ্টার প্রচলন দেখা গিয়েছে বহু প্রাচীন যুগ থেকে।
বহুল ব্যবহৃত একটা শব্দবন্ধ আছে– ‘রাতের ঘুম চলে যাওয়া’। বিশেষ দুশ্চিন্তা, কোনও কারণে টেনশন প্রভৃতির মাত্রা বোঝাতে ব্যবহৃত এই শব্দবন্ধ বা বাগধারা প্রমাণ করে, দুশ্চিন্তা থাকলে ঘুম আসতে চায় না। তাই ঘুমানোর জন্য মাথায় থাকা ভাবনাগুলি দূর করে একরকম শান্ত, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সুদিং’, প্রশান্তির ভাব নিয়ে আসা প্রয়োজন। ঘুমপাড়ানি গান হিসেবে যে ছড়াগুলি বহুকাল যাবৎ সমাজে প্রচলিত, সেগুলিতে দেখা যায় শিশু তার বোধে যে জিনিসগুলি অনুভব করে, চিনতে পারে, সেই বস্তুগুলিকেই প্রিয়ভাবে সাজিয়ে শিশুর মনকে ঠান্ডা করে তাকে ঘুম পাড়ানোর প্রচেষ্টা।
ল্যাজঝোলা পাখিকে ডেকে তাকে দুধ-কলা খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে সেই পাখিকে দিয়ে খোকাকে ঘুম পাড়িয়ে নেওয়ার গানে যেমন পাখি, তার ঝোলা ল্যাজ, তাকে খেতে দেওয়া দুধ আর কলা, এই সবই খোকার জীবনের অনুষঙ্গে পাওয়া যাবে। হাটে-ঘাটে লভ্য ঘুমের ছড়াটির ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, রাত্রে মণির ঘুমানোর সময়ে যখন হাট-ঘাট জনহীন হয়ে গিয়েছে আর ঘুম ফিরছে পথে পথে, তখন চার কড়া নগদ দিয়ে ঘুম কেনা হয়েছে মণির চোখের জন্য। একটি ছড়ায় বলা হয়েছে, ‘তোর মতো চাঁদ কোথায় পাবো?/ তুই চাঁদের শিরোমণি/ ঘুমো রে আমার খোকামণি’। এখানে চাঁদ, যা শিশুর কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বস্তু, তার সঙ্গে শিশুর তুলনা করে, তার মনকে প্রশান্তি দিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
অবশ্য খোকাকে যে শুধু আনন্দ দিয়ে শান্ত করে ঘুমোতে পাঠানোর চেষ্টা বাংলা ঘুমপাড়ানি গানে দেখা গিয়েছে, তা নয়। যে ছড়ায় বলা হল, ‘খোকা ঘুমো ঘুমো/ তালতলাতে বাঘ ডাকছে দারুণ হুমো’– সেখানে নিশ্চয়ই একটা ভয় দেখানোর ব্যাপার আছে। বাঘ তো তালতলা পর্যন্ত চলেই এসেছে, খোকা না ঘুমালে এখানেও চলে আসতে পারে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেভুলানো ছড়া: ২’ নিবন্ধে একটি প্রচলিত ছড়ার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে দেখা যাবে, যেহেতু খোকার অনুষঙ্গের যত পরিচিত বস্তু, জড় পদার্থ, প্রাণী, এমনকী দেবতাও এই সময়ে ঘুমাচ্ছে, সেই কথা গান গেয়ে শুনিয়ে খোকাকেও ঘুমাতে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপার–
‘ঘুমতা ঘুমায় ঘুমতা ঘুমায় গাছের বাকলা।
ষষ্ঠীতলায় ঘুম যায় মস্ত হাতি ঘোড়া।
ছাই গাদায় ঘুম যায় খেঁকি কুকুর।
খাট পালঙ্কে ঘুম যায় ষষ্ঠী ঠাকুর।
আমার কোলে ঘুম যায় খোকামণি।’
শিশুকে ঘুমপাড়ানোর ক্ষেত্রে ঘুমকে অনেক সময় মানুষী বা দৈব চেহারায় কল্পনা করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন এলাকার লোকবিশ্বাসে। বাংলায় কখনও ঘুম আসে ঘুম যায়, কখনও আবার ঘুমের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায় কোনও মাসি আর পিসি। ঘুম বা তার প্রতিনিধি কোনও লৌকিক বিশ্বাসে মাসি বা পিসির মতো অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ নিকটজন, কোথাও আবার কোনও উপকথার নায়ক দায়িত্ব নেয় ছোটদের সময়মতো ঘুমপাড়ানোর– জার্মান এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উপকথার স্যান্ডম্যান-এর মতো– আবার স্কটিশ লোককাহিনিতে শোনা যায়, ‘উই উইলি উইঙ্কি’-র কথা। সে নিজে রাতপোশাক পরে দৌড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয় বাচ্চারা সব রাত ১০টার মধ্যে শুয়ে পড়েছে কি না। ‘উই উইলি উইঙ্কি’ চার লাইনের নার্সারি ছড়া। তার একটা সম্ভাব্য বঙ্গানুবাদ করে দেওয়া গেল–
‘খুদে উইলি উইঙ্কি পাজামা ফতুয়া গায়ে
গলিঘুঁজি রাজপথে দৌড়ে বেড়ায়।
দরজায় সে পাতে আড়ি, জানলায় দেয় উঁকি,
রাত দশটা ঘড়ির কাঁটায়, জেগে নেই তো খোকাখুকি!’
মূল ছড়ার সঙ্গে আরও চারটি স্তবক যোগ করে প্রচলিত ছড়াটিকে পদ্যে পরিণত করেছিলেন স্কটিশ কবি উইলিয়ম মিলার। ১৮৪১-এ রচিত সেই স্তবকগুলিতে কবি ‘উই’ (Wee) মানে ‘খুদে’ উইলি উইঙ্কি-র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য। তাতে হয়তো কিছু আবেগ সংযুক্ত হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষামূলক এবং নিরীহ ‘রাইম’টিতে। কিন্তু পদ্যের ছন্দে ঘুমপাড়ানি সুর থেকে গিয়েছে একইরকম।
বাঙালির গানে ঘুম আসে ঘুম যায় কখনও দত্তপাড়া, কোনও গানে বাগদিপাড়া দিয়ে। দত্তপাড়ার দত্তদের কোনও চেনা বা অচেনা বউ হয়তো অন্যদের ঘুমের সুযোগ নিয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়। বাগদিপাড়া দিয়ে ঘুমের যাতায়াতের ফলে বাগদিদের বেচারা ছেলেটা জাল গায়ে দিয়ে শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ে যেমন-তেমনভাবে।
কোনও গানে স্নেহপ্রবণ মাসি-পিসি আসে খোকাকে ঘুম পাড়াতে। খোকার বাড়ির বড়রা সেই মাসি আর পিসিকে আপ্যায়ন করে ‘বাটা ভরা পান’, ঘুমানোর জন্য ‘শীতলপাটি’, পায়ে তেল দেওয়ার জন্য ‘দুই দুই বাঁদি’, গাছপাকা কলা, দইয়ের হাঁড়ি, খই-মুড়কি ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়ে। তাদের শুধু একটাই আবদার– মাসি আর পিসি যেন ঘুম হয়ে তাদের বাড়ির খোকা, মণি বা পুটুর চোখে বসে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
হান্স অ্যান্ডারসনের সংগ্রহ করা ডেনমার্কের উপকথার একজন নায়ক ওলে লোকয়ে শুধু ছোটদের ঘুমই পাড়ায় না, তাদের ভালো-মন্দ আন্দাজ করে সেই মোতাবেক সুখ বা দুঃখের স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্বও নেয় নিজের ওপর। নেদারল্যান্ডসের উপকথার ক্লাস ভাক্ বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায় তাদের চোখে বালি ছিটিয়ে। সেই বিচারে জার্মান-স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্যান্ডম্যান-এর সঙ্গেও তুলনীয় ক্লাস ভাক্।
প্রাচীন হিব্রু বাইবেলে ‘লিলিথ’ নামক সুন্দরী এবং ভয়ংকর নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যে নাকি প্রথম মানব আদমের প্রথম পত্নী। ইহুদি উপকথায় মনে করা হয়, দানবী লিলিথ রাত্রে শিশুদের আত্মা চুরি করে। তাকে দূরে রাখতে শিশুদের ঘরের চার দেওয়ালে নির্দিষ্ট তাবিজ, কবচ বা মাদুলি জাতীয় জিনিস ঝোলানোর প্রচলন দেখা যায় এখনও। মনে করা হয়, লিলিথকে দূর করো, অর্থাৎ ‘লিলিথ ভাগো’– হিব্রু ভাষায় ‘লিলিথ অ্যাবাই’ বাগধারা থেকেই নাকি উদ্ভব ‘লুলাবাই’ শব্দটির, যার অর্থ ‘ঘুমপাড়ানি গান’। ইংরেজরা কিন্তু একথা মানতে চায় না। তারা বলে, খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে প্রচলিত ‘মিডল ইংরেজি’ ভাষায় লোভ দেখানোর প্রতিশব্দ ‘লুলেন’-এর সঙ্গে ‘বাই’ জুড়ে, অর্থাৎ লোভ দেখিয়ে ঘুমকে আহ্বান করার প্রসঙ্গ থেকে উদ্ভব ঘটেছে ‘লুলাবাই’ শব্দটির। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যায়, ওয়েলস-এ বহু প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত লুলাবাই বা ঘুমপাড়ানি গান ‘সুয়ো গান’-এর কথা। গানের নামটির মধ্যে মনে হয় যেন বেশ একটা বাঙালিয়ানার ছোঁয়া আছে– ঠিক যেন ‘শুয়ে পড়ার গান’– তাই না?
……………………………….
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে ছোটদের গল্প শোনানোর প্রথাটির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের গবেষকরা দেখেছেন উনিশ শতকের শেষার্ধে আরম্ভ হয়ে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে এভাবে গল্প শোনানোর ব্যাপারটি প্রচলিত হয়েছিল বিশ শতকের গোড়ায়। তখন থেকেই ছবির বইয়ের প্রকাশ বাড়তে শুরু করে। গবেষকরা আরও বলেন, ১৮৭৩-এ প্রকাশিত ‘বেডটাইম স্টোরি’ বইটিতে আমেরিকান লেখিকা লোয়ি শ্যান্ডলার ‘মোল্টন’ এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং তখন থেকেই সেটি জনপ্রিয় হয়ে ব্যবহৃত হতে থাকে।
……………………………….
অনামী প্রতিভাধরদের সৃষ্টি করার ‘সুয়ো গান’, ছেলেভুলানো ছড়া শুধু নয়, পরবর্তী এবং প্রায় আধুনিক যুগে শিশুদের কথা ভেবে ঘুমপাড়ানি গান কিছু কম রচিত হয়নি। এগুলির মধ্যে বিখ্যাত একটি হল, জার্মান সুরস্রষ্টা যোহন্স ব্রাহ্ম্স-এর ‘ভিগ্ন্লিট’, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্রেডল সং’। আনন্দ বক্সির লেখা শচীনদেব বর্মন সুরারোপিত ‘আরাধনা’ ছবির ‘চান্দা হ্যায় তু, মেরা সুরজ হ্যায় তু’ গানটিও কম জনপ্রিয় হয়নি দেশজুড়ে। এই গানেও চাঁদ, সূর্য, তারা ইত্যাদির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো।
কিন্তু শিশুরা তো আর চিরকাল মাতৃক্রোড়ে থাকে না। কারণ বরাবর শিশুই থাকে না তারা। ক্রমে কৈশোরে পৌঁছয়, পড়াশোনা শিখতে আরম্ভ করে, স্কুলে যায়। মাসি-পিসি, চাঁদ-সূর্য, ল্যাজঝোলা পাখি, তাকে দুধ কলা খাওয়ানো অতিক্রম করে বাড়তে থাকে তার ভাবনার পরিসর। বিশ্ব সম্পর্কে তখন তার অদম্য কৌতূহল। কতকটা সেই কৌতূহল নিরসন করতে আর তার মানসিক বৃদ্ধি গঠনমূলক করার উদ্দেশ্য নিয়ে এবার প্রয়োজন হয় লুলাবাইয়ের বদলে ‘বেডটাইম স্টোরিজ’-এর। তাকে তখন গল্প শোনাতে হয়।
বাবা-মা দাদু-দিদা কিংবা কাকা-পিসিরা দিনের কাজকর্ম সেরে রাতে শুতে গিয়ে বাড়ির বড় হতে থাকা শিশুটিকে স্মৃতি থেকে বা বই পড়ে গল্প শুনিয়ে শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। এইরকম নিকট আত্মীয় হয়তো পরিবার ছোট হতে থাকার কারণে দূরে সরে গিয়েছে বা কমতে কমতে একেবারে হারিয়ে গিয়েছে অনেক পরিবার থেকে। ফলে আজকাল বাবা-মাকেই নিতে হয় এমন কাজের ভার।
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে ছোটদের গল্প শোনানোর প্রথাটির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের গবেষকরা দেখেছেন উনিশ শতকের শেষার্ধে আরম্ভ হয়ে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে এভাবে গল্প শোনানোর ব্যাপারটি প্রচলিত হয়েছিল বিশ শতকের গোড়ায়। তখন থেকেই ছবির বইয়ের প্রকাশ বাড়তে শুরু করে। গবেষকরা আরও বলেন, ১৮৭৩-এ প্রকাশিত ‘বেডটাইম স্টোরি’ বইটিতে আমেরিকান লেখিকা লোয়ি শ্যান্ডলার মোল্টন এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং তখন থেকেই সেটি জনপ্রিয় হয়ে ব্যবহৃত হতে থাকে।
কৈশোর পার হয়ে মানুষ যৌবনে পৌঁছনোর পথে গল্প শোনানোর প্রয়োজন ক্রমে কমে আসতে থাকে। স্বাভাবিক স্বনির্ভরতা সেই বয়সে রাত্রে শুতে যাওয়া যুবককে প্ররোচিত করে তার পছন্দমতো বই নিজেই পড়ে নিতে। ব্যক্তিবিশেষের নিজ নিজ পছন্দে তখন সবরকম বই-ই ‘বেডসাইড’ বইতে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। হয়তো বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে কাজ, পারিবারিক দায়িত্ব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা নিছক অভ্যাসের বা অনভ্যাসের কারণে বই পড়ার নেশা চলেও যায় কখনও। কিন্তু থেকেও যায় অনেকের ক্ষেত্রে। সত্যজিৎ রায়ের গল্পের বিপিন চৌধুরীর যেমন রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে খাওয়া সেরে আধঘণ্টা বিশ্রামের পর হাতে গল্পের বই নিয়ে সোজা বিছানায় চলে যাওয়া ছিল প্রাত্যহিক নিয়ম। তিনি পড়তেন ডিটেকটিভ, রহস্য আর ভূতের গল্প। সপ্তাহে পাঁচখানা বই লাগত তাঁর। ‘হত্যাপুরী’ কাহিনিতে বলা হয়েছিল, রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঘণ্টাখানেক বই না পড়লে নাকি ফেলুদার ঘুম আসে না।
বাস্তবেও বহু মানুষের এই অভ্যাসের সুযোগ নিয়ে বড় প্রকাশন সংস্থা নামী লেখকদের লেখা গল্প-উপন্যাস বাছাই করে তার সংকলন প্রকাশ করতে শুরু করে ‘বেডসাইড সিরিজ’ নাম দিয়ে।
‘বেডটাইম’ কথাটিতে সাধারণভাবে ঘুমানোর সময় বোঝালেও বাঁকা বা গভীরতর অর্থে অন্য কিছুও ভাবা যায়। ঠিক যেমন ‘বেডসাইড’-এ রেখে দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় বস্তু বই ছাড়া আরও অনেক কিছুই হওয়া সম্ভব। সেগুলির সঙ্গে অবশ্য বিছানায় শুয়ে গল্প শোনা বা বই পড়ার সম্পর্ক নেই। সেক্ষেত্রে বরং সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে নতুন গল্প সৃষ্টির। এই প্রসঙ্গে অবশ্য মনে পড়তে পারে বিভিন্ন নামী এবং অনামী প্রকাশন সংস্থার প্রকাশ করা ‘কামসূত্র’ বইটির সচিত্র ‘বেডসাইড’ সংস্করণের কথা। এমন বই অবশ্য দু’টি দিকই রক্ষা করে।
ঘুমপাড়ানি গান বা লুলাবাই থেকে শুরু হয়ে বেডটাইম স্টোরি, ছবির বই হয়ে বেডসাইডে রাখার মতো বই বা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসে মানুষকে উপনীত হতে হয় জীবনের গতির সঙ্গে। এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই মানুষের জীবনে এসেছে ইয়ারপ্লাগ, ব্লুটুথ হেডফোনে আটকে থাকা এমপিথ্রি, অডিও বুক প্রভৃতির মতো ডিজিটাল উপকরণ। কিন্তু মা-ঠাকুমার ঘুমপাড়ানি গান, সুরে বা বেসুরে গুনগুনিয়ে ওঠা লুলাবাই কিংবা বাবার কোল ঘেঁষে শুয়ে গল্প শোনার আরাম অগ্রাহ্য করা যায় না এখনও। এখনও রসিক কল্পবিজ্ঞান রচয়িতার কল্পনায় সৃষ্ট শ-দেড়শো বছর কাউকে ঘুমপাড়িয়ে রাখার যন্ত্র থেকে ধীরতম গতিতে নির্গত হয় ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির গান। এখনও রাতে বিছানায় শুয়ে বই পড়তে না পারলে ঘুম আসে না অনেক মানুষের। এখনও!
………………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………..
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে সুপার হিরোদের ‘realistic action figure’ বা বাস্তবধর্মী ছোট সংস্করণ সংগ্রহের ঐতিহ্য রয়েছে। এমনকী, চিনে হলিউড সুপার হিরোদের ব্যাটারিচালিত খেলনা তৈরির একটা বিশাল শিল্প রয়েছে। এত প্রতিকূলতার মাঝেও সমানে লড়ে গিয়েছে বাংলার মৃৎশিল্পীদের তৈরি শক্তিমান পুতুল।