১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। জন্ম নিল ‘ফ্যানট্যাস্টিক’। নামকরণ করলেন সত্যজিৎই। আসলে এ নিছকই কোনও পত্রিকার জন্ম নয়। এক অকালমৃত স্বপ্নকে ফের জাগিয়ে তোলা। সেখানে অদ্রীশের সঙ্গে শামিল ছিলেন আরও অনেকে। সহ সম্পাদক হলেন রণেন ঘোষ। তবে এবার স্রেফ কল্পবিজ্ঞান নয়, ফ্যান্টাসি, হররের মতো ধারাও এসে মিশে গেল। লেখক তালিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই যুক্ত হলেন। সঙ্গে অনীশ-রণেন কিংবা সিদ্ধার্থ ঘোষের মতো তরুণরা। আর অদ্রীশ তো ছিলেনই। ১৯৮২ সালে শুরু হয়ে গেল প্রকাশনাও।
‘আশ্চর্য’র জাতিস্মর ‘ফ্যানট্যাস্টিক’। যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে মানুষের পুনর্জন্ম শেষ পর্যন্ত রোম্যান্টিক এক চিন্তা হয়েই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক পত্রিকার অপমৃত্যুর পর ফের অন্য নাম শরীরে ধারণ করে তার জন্মগ্রহণ– এ যে নিখাদ বাস্তব! বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অমোঘ অধ্যায়। আর এই দুই নামের মাঝখানে হাইফেনের মতো রয়ে গিয়েছেন তিনি– অদ্রীশ বর্ধন। বাংলা স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এক অগ্নিপুরুষ। তাঁরই এক জীবনের দুই অধ্যায়ে দুই পত্রিকাকে ঘিরে এ এক রিলে রেস। এ সত্যিই ‘আশ্চর্য’। ‘ফ্যানট্যাস্টিক’ও! দ্বিতীয়টির কথা বলতে বসলে প্রথমটির কথা আগে বলতে হবে। বলতেই হবে।
‘কল্পবিজ্ঞান’। এই শব্দবন্ধটি অদ্রীশ বর্ধনেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে ১৯৬৩ সালে যখন তিনি ‘আশ্চর্য’ নামের সত্যিই আশ্চর্য এক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলেন তখনও বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনিগুলির কোনও নামকরণই করে ওঠা যায়নি। অথচ জগদানন্দ রায়, জগদীশ বসু, বেগম রোকেয়া, প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতো লেখকের কলমে বাংলা সাহিত্যেও সায়েন্স ফিকশনের ধারাটি ক্রমেই পুষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ১৯৬১ সালে ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ লিখে ফেলে প্রফেসর শঙ্কুরও আবির্ভাব ঘটিয়ে ফেলেছেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু তবুও বাংলা কল্পবিজ্ঞান যেন অপেক্ষায় ছিল ‘আশ্চর্য’র মতো এক পত্রিকারই। কেননা তা কেবল পত্রিকা নয়, এক আন্দোলন হয়ে উঠে সেই ধারাকে নতুন পথ দেখাতে শুরু করল। প্রেমেন্দ্র-ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ-সত্যজিৎরা উৎসাহী হয়ে উঠলেন পত্রিকা দেখে। কেবল কি পত্রিকা? শুরু হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সাই ফাই সিনে ক্লাবও। এই কলকাতা শহরেই! প্রেসিডেন্ট সত্যজিৎ। ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রেমেন্দ্র। সেক্রেটারি তরুণ ছটফটে অদ্রীশ। সাহিত্যজগতে আলাদা করে নিজের জায়গা করে নিতে শুরু করল ‘আশ্চর্য’। কিন্তু কয়েক বছর বিরাট সাফল্যের সঙ্গে পথ চলার পর আচমকাই সব থমকে গেল। এ যেন ইন্টারভ্যালের আগেই পর্দা নেমে আসা! দর্শকের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি- যাহ! শেষ হয়ে গেল?
আসলে ১৯৭০ সালে বিয়ে করেন অদ্রীশ বর্ধন। মাত্র দু’বছরের মধ্যে পত্নীবিয়োগ হয় তাঁর। ততদিনে জন্ম হয়েছে পুত্র অম্বর বর্ধনের। গোটা জীবনটাই যেন শুষে নিল কোনও অব্যাখ্যাত কৃষ্ণগহ্বর। ছোট্ট ছেলেটিকে বড় করবেন নাকি পত্রিকা করবেন? খোদ সত্যজিৎ রায়ও পরামর্শ দিলেন অনুজপ্রতিমকে, ‘তোমার জীবনের প্যাটার্ন পালটে গিয়েছে অদ্রীশ! তুমি এসব বন্ধ করে দাও।’ দাদা অসীম বর্ধন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও হাল ছেড়ে দিলেন অচিরেই। বন্ধই হয়ে গেল ‘আশ্চর্য’। অনীশ দেব, রণেন ঘোষের মতো যোগ্য শিষ্যরা বের করেছিলেন ‘বিস্ময়’ (নামের মিলটা লক্ষ করুন, অবশ্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে একটা লিগ্যাসিকে ধরতে চাওয়াই এর কারণ)। কিন্তু সেই পত্রিকাও চলল না।
এর মধ্যে কেটে গিয়েছে প্রায় তিন বছর। যে সত্যজিৎ থামতে বলেছিলেন, তিনিই এবার বললেন, ‘এভাবে চলতে পারে না। তুমি আবার শুরু করো অদ্রীশ।’ একই ইচ্ছে প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও। ততদিনে শোকের ধাক্কাকে সইয়ে কলম হাতে তুলে নিয়েছেন অদ্রীশ। লিখেছেন জীবনের একমাত্র সামাজিক উপন্যাস ‘তখন নিশীথ রাত্রি’। অকালপ্রয়াত স্ত্রীকে নিয়েই সেই লেখা। এদিকে রাত আড়াইটেয় রোজ ঘুম ভেঙে গেলে লেখার টেবিলে এসে বসতেন। অনুবাদ করতেন জুল ভের্ন। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখতেন বিছানায় ঘুমন্ত শিশুপুত্রের মুখ।
১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। জন্ম নিল ‘ফ্যানট্যাস্টিক’। নামকরণ করলেন সত্যজিৎই। আসলে এ নিছকই কোনও পত্রিকার জন্ম নয়, এক অকালমৃত স্বপ্নকে ফের জাগিয়ে তোলা। সেখানে অদ্রীশের সঙ্গে শামিল ছিলেন আরও অনেকে। সহ সম্পাদক হলেন রণেন ঘোষ। তবে এবার স্রেফ কল্পবিজ্ঞান নয়, ফ্যান্টাসি, হররের মতো ধারাও এসে মিশে গেল। লেখক তালিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই যুক্ত হলেন। সঙ্গে অনীশ-রণেন কিংবা সিদ্ধার্থ ঘোষের মতো তরুণরা। আর অদ্রীশ তো ছিলেনই। ১৯৮২ সালে শুরু হয়ে গেল প্রকাশনাও।
কিন্তু… ‘ফ্যানট্যাস্টিক’ মোটেই ‘আশ্চর্য’ হতে পারেনি। কেউ কি কারও মতো হয়? জাতিস্মর হলেও বদলে বদলে যায় অস্তিত্বের সীমারেখা। সময়টাও যে আলাদা। ছয়ের দশকের উত্তাল সময় পেরিয়ে সত্তরের মাঝামাঝি সময় থেকে ধীরে ধীরে চারপাশ স্তিমিত হয়ে এল যেন। সেই পালটানো সময়ে এক নতুন পত্রিকা নিজের মতো করে পথ চলছিল। বইমেলায় স্টলে দেখা যেত অদ্রীশকে। বাংলার কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীরা অপেক্ষা থাকতেন তাঁর নতুন বইয়ের। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রথম পত্রিকার মতো প্রভাব ফেলতে পারেনি ‘ফ্যানট্যাস্টিক’। অনিয়মিত হয়ে পড়ল প্রকাশ। তবে খাতায়-কলমে তা নতুন সহস্রাব্দেও কিছুটা সময় টিকে ছিল বটে। কিন্তু তার আসল মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল বোধহয় নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েই।
তবু… ‘ফ্যানট্যাস্টিক’ও বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসের এক অধ্যায়। এবং জরুরি অধ্যায়ই। এ যেন এক ফিনিক্সের ফিরে আসা। কী আশ্চর্য! দু’টি শব্দই যে শুরু হচ্ছে ‘ফ’ দিয়ে। আবার ‘ফ’ দিয়েই তো ‘ফিরে আসা’। হ্যাঁ, এভাবেও ফিরে আসা যায়। শোকের কালো সমুদ্র ঠেলে তীরে ফিরে আসে মানুষ। কী ‘আশ্চর্য’! কী ‘ফ্যানট্যাস্টিক’! জোড়া বিশেষণ ছাড়া একে বোঝানো যায় না বোধহয়।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।
চিরকাল নগ্নপদ ছিলেন। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনওদিন জুতো পরেননি। কারণ তিনি ‘জুতোস্থ’ না হয়ে ‘পদস্থ’ থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। মজা করে বলতেন– বাগদাদের রাজারা খালিফা আর তিনি হলেন ‘খালি পা’। ‘দাদাঠাকুর’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জন্ম ও মৃত্যুদিন আজ। সেই উপলক্ষে রোববার.ইন-এর বিশেষ প্রতিবেদন।