ক্যানসার ঠিক সময়ে ধরা পড়লে আর আগের মতো প্রাণনাশী না-ও হতে পারে। অসংখ্য রুগী প্রতিদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। নতুন করে জীবন শুরু করছেন। আয়ুক্ষয় আটকানো যাচ্ছে অনেকের। রিহ্যাবিলিটেশনের চেষ্টা করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। এরকম অবস্থায় বাড়ির লোকজন, আশপাশের মানুষজন এবং সমাজের একজন হিসেবে জানা প্রয়োজন রুগীকে মানসিক ভরসা কীভাবে দেওয়া সম্ভব। এবং কী কী আচরণ রুগীকে মানসিকভাবে দুর্বল এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে দিতে পারে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
সেপ্টেম্বর ওভারিয়ান ক্যানসার বা গর্ভাশয়ের ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতার মাস। বিভিন্ন মাধ্যমে এ-নিয়ে আলোচনা চলছে– কী কী উপসর্গ দেখে বোঝা যাবে, কী কী সতর্কতা নিতে হবে। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে বিষয়টি নিয়ে প্রায় কোথাও কোনও আলোচনাই হয় না, তা হল ‘ক্যানসারের রুগীর সঙ্গে কীরকম আচরণ করা উচিত’। শুধু ওভারিয়ান নয়, যে কোনও ধরনের ক্যানসারেই রুগীর যে মানসিক পরিস্থিতি থাকে, তাতে শরীরের যত্ন ও শুশ্রূষার পাশাপাশি মন ভালো রাখাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আপনাদের বনজ্যোৎস্নার কথা বলি। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বনজ্যোৎস্নার ওভারিয়ান ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথমে ভুল চিকিৎসা হয়। ভুল ডাক্তারির কবলে পড়ে প্রথম অপারেশন ব্যর্থ হয়। ৪৫ দিনের মাথায় যে সময় সুস্থ হয়ে ওঠার কথা, বনজ্যোৎস্না প্রাণপণে প্রার্থনা করতে থাকে, অপারেশনের ঘাগুলো দ্রুত শুকিয়ে যাক! তাহলে দ্বিতীয়বার পেট কাটা যাবে। বনজ্যোৎস্নার উপায় ছিল না। সে বাঁচতে চেয়েছিল। অন্য শহরে গিয়ে বড় হাসপাতালের বড় ডাক্তারের কাছ থেকে তাকে পরামর্শ নিয়ে আসতে হয়। দু’টি অপারেশন এবং ছ’টি কেমো নেওয়ার পর বনজ্যোৎস্না সুস্থ হয় এবং পাঁচ বছর নিয়মিত তত্ত্বাবধানে থাকার পর তাকে পুরোপুরি সুস্থ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই পাঁচ বছর বনজ্যোৎস্নার চারপাশের মানুষজনের থেকে কী কী শুনতে হয়েছে তার কয়েকটা নমুনা যদি আমরা দেখি:
‘ডাক্তার বলেছে সেরে যাবে।’ বনজ্যোৎস্নার মায়ের মুখে এই কথা শুনে এক নিকটাত্মীয়া সেই মাকে বলেন, ‘ডাক্তাররা ওরকম বলে।’ বনজ্যোৎস্নার স্কুলের কিছু বন্ধু তার অসুখ জেনে তাকে দেখতে আসার সময় পায় না, কিন্তু সোশাল মাধ্যমে তার ছোট চুলের ছবি দেখে লেখে ‘বাজে দেখাচ্ছে।’ কেমোথেরাপির পর অনেকেরই চুল কোঁকড়া হয়ে যায়, যেহেতু ডিএনএ-র পরিবর্তন হয়। এক বন্ধু বাড়ি এসে বলে, ‘চুলটা স্ট্রেট করিয়ে নিচ্ছ না কেন?’ তার পেটে অপারেশনের দাগ দেখে বলে, ‘ইশ! নাভিটা তো কেমন দেখাচ্ছে!’ কিছু মাস পর এই বন্ধুই নিজের মন খারাপের মধ্যে একদিন বনজ্যোৎস্নাকে বাড়িতে ডাকে এবং তার যে ইমিউনিটি কম– সে কথা তার মাথাতেই থাকে না। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে এবং প্রচণ্ড কাশির দমকে যখন তার কথা আটকে আসছে, বনজ্যোৎস্না আবিষ্কার করে বন্ধুটির ব্রংকাইটিস চলছে। বাড়ি ফেরার পর বলাই বাহুল্য, সে জ্বর এবং সংক্রমণে পড়ে। বনজ্যোৎস্নার পরিবারের ডাক্তার মানুষটির একটি দিনও সময় হয় না, কেমোথেরাপি চলার সময় একদিন তাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার। অথচ এই মানুষটির হাতের স্পর্শে ছোট থেকে সুস্থ হয়েছে বনজ্যোৎস্না। এই স্পর্শ তার কাছে কখনও কখনও মায়ের স্পর্শের চেয়েও বেশি শুশ্রূষার।
বনজ্যোৎস্না বুঝতে পারে, আশা করাটা ভুল হয়েছিল। কেমো শেষ হওয়ার দু’মাসের মধ্যে যখন সংক্রমণ নিয়ে সাতদিন সে বাড়ির কাছেই একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখনও সেই ডাক্তার-আত্মীয় তাকে একদিনও দেখতে আসে না। অথচ প্রতিদিন খুব কাছ দিয়েই তখন সে একটি সাংস্কৃতিক মেলায় নিয়মিত উপস্থিত ছিল। সকলের সঙ্গে তোলা সেই ছবিগুলো বনজ্যোৎস্নাও তো দেখেছে সোশাল মাধ্যমে। বনজ্যোৎস্না বুঝেছিল অভিমান করাটাও ‘ছেলেমানুষি’ হচ্ছে, পরে সকলে তাকেই অপরিণত বলে দুষবে। বনজ্যোৎস্না যখন অক্লান্ত চেষ্টায় নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছে, চেষ্টা করে চলেছে জীবনের মূল স্রোতে ফেরার… তখন এক ডাক্তার দম্পতি প্রায়শই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছে, ‘এবার ফ্যামিলি প্ল্যানিংটা কর! একটা ডিম্বাশয় আর জরায়ু তো তোর আছেই।’ যে একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে তার নিজের ডাক্তারবাবুও এমনকী, নাক গলাননি, তার সিদ্ধান্তকে বরাবর সম্মান করেছেন, ঠিক সেই নিয়েই। বনজ্যোৎস্না বাধ্য হয়েছে এই দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে।
বনজ্যোৎস্না দেখেছে খবরের কাগজে নারীবাদী কলাম লেখা মেয়েও ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে কীভাবে সকলের আড়ালে তাকে বলেছে, ‘সব তো খুইয়েছিস, একটা বাচ্চা তো পয়দা করতে পারিস না।’ কেউ বলেছে, ‘নিশ্চয়ই কোনও পাপের ফল।’ বনজ্যোৎস্না মন খারাপ করেনি। নিজেকে সে আগলে রাখতে জানে। বরং কঠিন সময়ে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষকেও চারপাশ থেকে মানুষ কী বলতে পারে, কী করতে পারে দেখেছে। চিনে নিয়েছে। এর চেয়ে বড় লিট্মাস টেস্ট আর কী আছে! সে শুধু কৃতজ্ঞ থেকেছে জীবনের প্রতি। আর তার মা বাবা ও জীবনসঙ্গীর প্রতি– যাদের অক্লান্ত শ্রম ও সেবাযত্নে সে শেষ পর্যন্ত সুস্থ হতে পেরেছে।
কী মনে হচ্ছে? বনজ্যোৎস্নার মতো অজস্র রুগীর জন্য এই আলোচনাটুকু জরুরি নয়? তার না হয় প্রচণ্ড মনের জোর। সকলেরই কি এমন? এই সমস্ত আচরণ, কথা পায়ের নিচ থেকে যদি শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয় কারও? তাকে না হয় মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হয়নি, বরং নিজের কাছের মানুষজনকে সে-ই কাউন্সেলিং করে মনের জোর দিয়েছে, বুঝিয়েছে শক্ত হতে। কিন্তু সকলের পক্ষেই কি তা সম্ভব?
ক্যানসার রুগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত?
প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন জানার। কারণ, এই অসুখ আজ মহামারীর আকার নিতে চলেছে। ঘরে ঘরে তার প্রমাণ। এমন একটি পরিবারও পাওয়া মুশকিল, যেখানে কারওর না কারওর এই অসুখের অভিজ্ঞতা হয়নি, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে।
একথা ঠিকই, চিকিৎসাবিজ্ঞান অভূতপূর্ব উন্নতি করে চলেছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ওষুধ, চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হচ্ছে। গবেষণা চলছে। ক্যানসার ঠিক সময়ে ধরা পড়লে আর আগের মতো প্রাণনাশী না-ও হতে পারে। অসংখ্য রুগী প্রতিদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। নতুন করে জীবন শুরু করছেন। আয়ুক্ষয় আটকানো যাচ্ছে অনেকের। রিহ্যাবিলিটেশনের চেষ্টা করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। এরকম অবস্থায় বাড়ির লোকজন, আশপাশের মানুষজন এবং সমাজের একজন হিসেবে জানা প্রয়োজন রুগীকে মানসিক ভরসা কীভাবে দেওয়া সম্ভব। এবং কী কী আচরণ রুগীকে মানসিকভাবে দুর্বল এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে দিতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোনও রোগের মতোই ক্যানসারেও মানসিক সুস্থতা রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় এবং মানসিকভাবে খারাপ থাকলে রোগ সারতে সময় লাগে।
…………………………………………………..
কেউ প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও মনোবল অটুট রাখতে পারেন, হাসিমুখে থাকতে পারেন, সারাক্ষণ কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন জীবনের প্রতি। কেউ ভেঙে পড়তে পারেন, সব আশা-ভরসা হারিয়ে ফেলতে পারেন, কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়তে পারেন। কেউ শরীরের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করতে পারেন, চিৎকার-চেঁচামেচি, ভাঙচুর, গালিগালাজ করতে পারেন। কেউ নিজের অসুখের মধ্যেও অন্য রুগীর জন্য সেবামূলক কাজে নামতে পারেন– এই সবই কিন্তু স্বাভাবিক।
…………………………………………………..
প্রথমেই বলা দরকার, আসলে কোনও ‘সাধারণ নিয়ম’ নেই। ক্যানসার যেমন হাজার রকম, তার প্রকোপ, লক্ষণ, স্টেজ বা দশা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে তার প্রভাব, রোগের প্রগ্নোসিস বা আরোগ্য সম্ভাবনা এবং চিকিৎসার পদ্ধতিও হাজার রকম। প্রত্যেক ক্যানসার রুগী স্বতন্ত্র। কাজেই প্রত্যেকের মানসিক পরিস্থিতিও আলাদা। কেউ প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও মনোবল অটুট রাখতে পারেন, হাসিমুখে থাকতে পারেন, সারাক্ষণ কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন জীবনের প্রতি। কেউ ভেঙে পড়তে পারেন, সব আশা-ভরসা হারিয়ে ফেলতে পারেন, কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়তে পারেন। কেউ শরীরের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করতে পারেন, চিৎকার-চেঁচামেচি, ভাঙচুর, গালিগালাজ করতে পারেন। কেউ নিজের অসুখের মধ্যেও অন্য রুগীর জন্য সেবামূলক কাজে নামতে পারেন– এই সবই কিন্তু স্বাভাবিক।
তাহলে কার সঙ্গে কেমন ভাবে কথা বললে ঠিক হবে? কী করে বোঝা যাবে, কোন কথায় কার খারাপ লাগবে, কোন আচরণে কে অভিমান করবে বা কথা বন্ধ করে দেবে বা ভুল বুঝবে! কোন কথায় কে আরও অসুস্থ বোধ করবে বা কোন কথায় কে প্রাণ ফিরে পাবে?
মূল মন্ত্র: একটু চুপ করে মানুষটিকে বোঝার এবং শোনার চেষ্টা করা। একটু সৎভাবে মেশা।
যখন রুগীকে দেখতে যাবেন, তখন এই মন নিয়ে যাবেন না যে, যাক বাবা, একটা দিন দেখা করে আসার দরকার ছিল। ‘টু ডু’ লিস্টে টিক দিয়ে রাখি। তেমন হলে যাবেন না। কারণ ‘সোশালাইজ’ করার সময় বা পরিস্থিতি এটা নয়। অন্যের কাছে নিজেকে প্রমাণ করারও নয়। যদি সত্যিই মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হয় তবেই যান। হাজিরা দেওয়াটা বড় কথা নয়। কতক্ষণ মন দিয়ে তাঁর কথা শুনলেন, তার সঙ্গে থাকলেন, সেটিই দরকারি। হতে পারে আপনি তাঁর সহকর্মী বা আত্মীয় বা বন্ধুস্থানীয় কেউ। যে-ই হোন। কিছুক্ষণ নিজেকে গৌণ করে মানুষটি কী বলছেন শুনুন। কষ্টের কথা বলছেন? কোনও মজার কথা বলছেন? কোনও অভিযোগ করছেন? কোনও দুঃখের কথা বলছেন? শুধু শুনলেই কিন্তু একটা বিরাট কাজ হয়ে যায়। নিজের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি চাপিয়ে না দিয়ে, কিছু না বলে শুধু প্রাথমিক ভাবে শোনা। তারপর নিজেই বুঝতে পারবেন কীরকম আচরণ করলে, কেমন ভাবে কথা বললে মানুষটির আঘাত লাগবে না।
দ্বিতীয় বিষয়: তুলনা ও প্রতিতুলনা
বহুক্ষেত্রে দেখা যায়, রুগীর মনোবল বাড়াতে গিয়ে অনেকেই তাঁদের নিজেদের নানা অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। কোনও পরিচিত রুগী কোন শহরে বা কোন দেশে চিকিৎসা করিয়েছেন, কে কোন ডাক্তারের কাছে সুস্থ হয়েছেন, কে কী কী ওষুধ খেয়েছেন, কার কেমন উপসর্গ ছিল বা সাইড এফেক্ট হয়েছে ইত্যাদি। সব রুগীর আর্থিক অবস্থা সমান নয়। আবার অনেকের লোকবলের অভাব থাকতে পারে। অন্য নানা লজিস্টিক্স এর সমস্যা থাকতে পারে। কারওর হয়তো টাকাপয়সা বা লোকবলের সমস্যা নেই। কিন্ত চাকরি ছেড়ে বা দীর্ঘদিন ছুটি নিয়ে অথবা বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা কিংবা ছোট সন্তানকে ফেলে রেখে অন্য দেশ বা শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। লিঙ্গ এবং বয়স ভেদেও পরিস্থিতি আলাদা হয়। শুধু তাই নয়, কে কোন স্টেজে আছেন তার ওপর কে কতটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন একথা কিছু কিছু সময়ে চিকিৎসকের পক্ষেও সঠিক বলা সম্ভব হয় না। এমন কেস দেখা গেছে যেখানে চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন হয়তো এক বছর আয়ু, সেখানে রুগী আরও দশ বছর বেঁচেছেন। তাই ‘অমুক তো হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, তুমি কেন সারছ না’ অথবা ‘তমুক এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করিয়ে মারা গিয়েছে, তুমি ডাক্তার পাল্টাও’ এই ধরনের যে কোনও কথা ভয়ংকর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে রুগীর মনে। আপনার উৎকণ্ঠা যদি খাঁটি হয় তাহলে রুগীর পরিজনদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলুন বরং, কিন্তু সাবধানে। কারণ তাঁরাও কিন্তু মানসিক ও শারীরিক ধকলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।
তৃতীয় বিষয়: চিকিৎসা সংক্রান্ত অযাচিত উপদেশ
রুগীর চিকিৎসায় কী ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে, কতদিন অন্তর কেমোথেরাপি নিতে হচ্ছে, কতবার রেডিয়েশন নিতে হচ্ছে, অপারেশনের আগে কেমো চলবে নাকি পরে, কতবার অপারেশন হবে, কী কী অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা আন্তরযন্ত্র বাদ দেওয়া উচিত হবে বা হবে না এ নিয়ে কোনও মতামত জানাবেন না। রুগীর কী খাওয়া উচিত, কী খাওয়া উচিত না; কতটা পরিশ্রম করা উচিত, কতটা ঘুমনো উচিত এইসব নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। এই বিষয়টা সংশ্লিষ্ট ডাক্তার এবং কেয়ার-গিভার বা শুশ্রূষা করছেন যাঁরা সেই টিম-এর ওপরেই ছেড়ে দিন।
চতুর্থ বিষয়: রুগীর শারীরিক রূপ নিয়ে মন্তব্য
চোখের সামনে হয়তো দেখতে পাচ্ছেন আপনার সদাহাস্যময়, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, প্রিয় বন্ধুটি শীর্ণ, দুর্বল হয়ে পড়ছেন। মুখচোখ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। শরীরের সমস্ত লোম ঝরে গেছে। মাথায় চুল নেই। আপনার খুব খারাপ লাগলেও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। রুগীর সামনে কান্নাকাটি তো নয়ই। মনে রাখবেন ক্যানসার রুগীর যেসব উপসর্গ চোখে দেখা যায় তার চেয়ে বহুগুণ যন্ত্রণার বিষয় চোখের আড়ালে ঘটতে থাকে প্রতিদিন। কেমোথেরাপি চলাকালীন অনেকের রক্ত কমে যায়। অনেককে যন্ত্রণাদায়ক নানা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে চিকিৎসা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হয়। যেমন বোন ম্যারো এক্সট্র্যাকশন: যেখানে মোটা সূঁচ মেরুদণ্ডর মধ্যে ঢুকিয়ে প্যাঁচ কষে স্ক্রু ঘোরানোর মতো করেই অস্থিমজ্জা বের করে আনতে হয়। অনেকের দু’হাতের শিরা বারবার কেমো নিতে নিতে শুকিয়ে যায়। অনেকের তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, বমি হয়। অনেকে কিছুই খেতে পারেন না, খেলে হজম করতে পারেন না। মুখের ভেতরে দরকারি কমেনজাল ব্যাক্টিরিয়াগুলোও মরে গিয়ে দুর্গন্ধ হয়, গা গুলোয়। কেউ সারাক্ষণ কাঁপেন বা সুতীব্র গরমে বা অস্বাভাবিক চুলকানিতে কষ্ট পান। এইসবের পাশে মাথার চুল পড়ে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া কোনও সমস্যাই নয়। অথবা কিছুদিন পর অন্যরকম চুল উঠে অদ্ভুত দর্শন হলেও তা নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। বরং নিজের চোখ এবং মনকে সইয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
পঞ্চম বিষয়: একটা দীর্ঘ লড়াইকে জায়গা দেওয়া এবং রুগীর প্রাইভেসিকে সম্মান দেওয়া
মনে রাখতে হবে, ক্যানসার আর পাঁচটা অসুখের মতো না যে সামান্য ক’দিনের মধ্যেই সব সমাধান হয়ে যাবে। অনেকের বহু বছর ধরে চিকিৎসা চলে। অনেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও নিয়মিত নানা পরীক্ষা এবং মনিটরিং-এর মধ্যে থাকেন। অনেকে দীর্ঘ চিকিৎসার পরেও আর কোনও দিনই সুস্থ হন না। অনেকে আপাত সুস্থ হলেও পরে আবার অসুখ ফিরে আসে। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, এ যে দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার এক দীর্ঘ লড়াই, সেটা একটু বোঝা উচিত। কাজের জায়গায় সহকর্মী হিসেবেও, প্রতিদিনের জীবনে বন্ধু হিসেবেও। ক্যানসার রুগী নানারকম ফেভার বা সুযোগ নিচ্ছে, এমন কথা যেন কখনও মনে না হয়। জীবন তাকে মেরে রেখেছে এমন কথাও ভাবার প্রয়োজন নেই। অপ্রয়োজনীয় নেতিবাচক কথা বা আচরণ যেমন আঘাত দিতে পারে, করুণা দেখানোও কিন্তু তেমনই অপমানের হতে পারে। অনেক রুগীই এই করুণার ভয়ে কিংবা ‘ফেভার নিচ্ছে’ ছাপ পড়ে যাওয়ার ভয়ে রোগ নিয়ে প্রকাশ্যে একটি কথাও বলতে রাজি হন না। সেক্ষেত্রেও রুগীর প্রাইভেসি রক্ষার বিষয়টি মাথায় থাকতে হবে। অসুখ জিনিসটা ব্যক্তিগত। কে কতটুকু জানাবেন, কাকে জানাবেন, কতটুকু জানাবেন না, কতটা ওপেন সিক্রেট রেখে দেবেন সবটাই তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। সেই ইচ্ছেটাকে সম্মান জানিয়ে মানুষটির পাশে থাকাটাই সভ্যতা। কিন্তু এদেশের সমাজে অসুখকে কেন্দ্র করে এই ভদ্রতা ও শালীনতাবোধ এখনও গড়ে ওঠেনি। ওঠেনি বলেই প্রায়শই না চাইলেও নিজের অসুখের কথা গোপন রাখার প্রয়োজন পড়ে। দিবারাত্র অসুখ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় মতামত, মন্তব্য এবং নেতিবাচকতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে, নিভৃতে শান্তিতে যাতে সুস্থ হওয়া যায়।
মানুষের অসুখে তাঁকে স্পেস দেওয়া উচিত। প্রাইভেসি দেওয়া উচিত। কখনও কখনও দূরে থাকতে জানাটাও পাশে থাকা হতে পারে। মঙ্গল কামনা করা, প্রার্থনা করা, দরকার পড়লে কিছু কাজে লাগা এবং কাজে লেগে সেকথা ভুলে যেতে শেখাও দরকারি। সেটাই সত্যি পাশে থাকা।
………………………………………….
আরও পড়ুন অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: অর্থের বিনিময়ে আড্ডায় যদি একাকিত্ব কাটে, তাতে সমস্যা কী!
………………………………………….
রুগীর পরবর্তী জীবন অনেকটাই বদলে যাবে একথা জেনে রাখা ভালো। জীবনের মূল স্রোতে ফিরলেও বহু আনুষঙ্গিক ছোটখাটো বা বড় ধরনের অসুস্থতা, দুর্বলতা সঙ্গী হতে পারে রুগীর। স্ট্রেস ক্যানসারের একটা বড় কারণ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সার্ভাইভর চাইবেন স্ট্রেস দিচ্ছেন এমন মানুষ বা পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার। কাজেই তাঁর মন মেজাজ পালটে যেতে পারে। বন্ধু থাকতে চাইলে, সেই প্রতিদিনের পালটে যাওয়ার সঙ্গে নিজেদের একটু করে মানিয়ে নেওয়াই ভাল। নাহলে নিজেকেও মানসিক আঘাত পেতে হবে। আগে সব যেমন ছিল, পরেও অবিকল একই থাকবে এমন তো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনও দাবি করতে পারে না।
বনজ্যোৎস্নার ভাগ্য খুব ভালো ছিল। কঠিন অসুখ প্রথমদিকেই ধরা পড়ে। প্রথমে ভুল হলেও পরে খুব ভালো চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং তার পরিবার তার শুশ্রূষায় কোনও ফাঁক রাখে না। বনজ্যোৎস্নার বন্ধুভাগ্যও খুব ভাল ছিল। কেউ অফিস ছুটি নিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, কেউ শহরের অন্য প্রান্ত থেকে উজিয়ে এসে তার জন্য রান্না করে গেছে, কেউ দিনের পর দিন কেমোর সময় পাশে বসে থেকেছে। কত অচেনা মানুষও বনজ্যোৎস্নার জন্য প্রার্থনা করেছে এমনকী, সুদূর বিদেশে বসেও, যাদের সঙ্গে তার কোনও দিনও দেখা হওয়ার নয়। কেউ চার্চে গিয়ে, কেউ মসজিদে। কত মানুষের আশীর্বাদ আর শুভকামনা পেয়ে আজ সে সুস্থ হয়েছে। শুধু মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে সেইসব মানুষগুলোর কথা, যারা তার সঙ্গে একই ওয়ার্ডে ছিল। পাশের বিছানাগুলোয়। সেই কচি বাচ্চাগুলোর কান্নার আওয়াজ, ‘মা আমি আর করব না মা। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল’। বৃদ্ধ স্বামীর শীর্ণ হাত ধরে চুপ করে বসে থাকা সেই বৃদ্ধা, সেই অজস্র মুখেদের সারি… সেই তরুণ যার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলেছিল বনজ্যোৎস্না, যে কোনও দিন নিজের কষ্টে কাঁদেনি।
………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………..
আর হাসপাতালের বাইরে ফুটপাথে সারি সারি মশারি টাঙিয়ে শুয়ে কেমো নিতে থাকা সেইসব মানুষ? যাদের পরিজনরা ভিটেমাটি বিক্রি করে শেষ সম্বলটুকুও খুইয়ে চেয়েছিল, তারা আরও ক’টা দিন থাকুক এই পৃথিবীতে? তাদের মানসিক সুস্থতার খবর কি এ সমাজ নিয়েছে কখনও?
এই লেখাও শুধুই বনজ্যোৎস্নার মতো মানুষদেরই জন্য, যারা দু’বেলা খেতে পেলে আর মাথার ওপর ছাদ থাকলে এখনও নিজেদের প্রিভিলেজড বলেই জানে।