নিজের বাড়ির পরিচিত পরিবেশের থেকে অনেক দূরে, প্রায় অচেনা শহরে, নিজের শহরের চেনা লোককে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে দৌড়ে গিয়ে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আর তার পরেই টের পেয়েছিলাম অসহ্য যন্ত্রণা। লিখছেন যশোধরা গুপ্ত
ছোটবেলা থেকে, বাবা-মায়ের কাজ থেকে একটু ছুটি মিললেই আমরা চলে যেতাম কুলটি। বড় বড় পুরনো গাছ আর ব্রিটিশ আমলের বাংলোতে এই শহরটির IISCO এলাকা ভারি সুন্দর দেখাত। কুলটিতে ছিল আমার পিসির বাড়ি। পিসেমশাই চাকরি করতেন ইস্কোতে। তাঁদেরও কর্মসূত্রে ছিল একটি ভারি মনোরম বাংলো। সে বাংলোর পিছনদিকে ছিল সুবিশাল বাগান আর বাংলোর ঠিক সামনেই একটি ভারি চমৎকার পার্ক। সে পার্কে খেলার নানা উপকরণের সঙ্গে সঙ্গে ছিল অজস্র গাছ। সন্ধেবেলা আমার পিসেমশাই কাজকর্ম সেরে ফিরলে আমি আর আমার দিদিয়া তাঁর সঙ্গে পার্কে খেলতে যেতাম। ওই সময়টুকুতে কোনও বাধানিষেধের বালাই থাকত না। পিসেমশাই ক্লান্ত দিনের শেষে পার্কের কোনও বেঞ্চিতে বসে থাকতেন নিরিবিলিতে। অন্যরা ততক্ষণে বাড়ি ফিরেছে, পার্কে আমরা কেবল তিনজন। পিসেমশাই ছাড়া আমার দিদিয়া আর আমি। দিদিয়ার ভারি সাহস ছিল, সে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ত একটা উঁচু স্লিপে, সেখান থেকে গড়িয়ে নামত। আমার অত উঁচু দেখলেই ভয় লাগত। অতঃপর আমি, একটি শান্ত-একাকী শিশু আলো-আঁধারি পার্কে ঘুরে বেড়াতাম। দোলনায় গিয়ে না দুলে বসতাম। গুনগুন করে গানও গাইতাম। আর তারপরে একসময়ে বাড়ি ফেরার ডাক এলে চুপচাপ ফিরে যেতাম। এমনই একদিন ঘুরছি পার্কে, হঠাৎ দেখলাম, দূর থেকে আমার পরিচিত একজন দীর্ঘ মানুষ হেঁটে আসছেন আমারই দিকে। তাঁর যে সেই সন্ধেয় সব ভৌগোলিক দূরত্বকে অতিক্রম করে, সেখানে উপস্থিত থাকা প্রায় অসম্ভব, এত ভাবার চেষ্টাই করিনি পাঁচ-ছয় বছরের আমি। কিন্তু মাঝে আড়াই দশক অতিক্রান্ত হলেও, আজও সে দৃশ্য আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি।
আরও পড়ুন: একঝলকে যা দেখলাম ওর মুখটা বিবর্ণ, ফ্যাকাসে
নিজের বাড়ির পরিচিত পরিবেশের থেকে অনেক দূরে, প্রায় অচেনা শহরে, নিজের শহরের চেনা লোককে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে দৌড়ে গিয়ে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আর তার পরেই টের পেয়েছিলাম অসহ্য যন্ত্রণা। এরপরের অংশটা ভালো মনে নেই আমার। কয়েকটা ছবি আর ব্যথার অনুভূতি মনে আসে টুকরো টুকরো। আমাকে আমার পিসেমশাই কোলে তুলে দৌড়ে বাড়ি আসছেন, পাশে আমার দিদিয়ার উদ্বিঘ্ন মুখ, বাড়ি ফিরে বসার ঘর, বাবা-মা-পিসি, দিদিয়ার খেলার বড় বড় পুতুলগুলো, একটা আরতি মুখার্জির গান বাজছে অস্পষ্ট, আর আমার হাঁটু থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে, তারপর এক টুকরো সাদা কাপড়, ওষুধ ওষুধ গন্ধ, ডেটল, ব্যান্ডেজ…।
আরও পড়ুন: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
পরে শুনেছিলাম, আমি নাকি দৌড়ে গিয়ে আদতে জড়িয়ে ধরেছিলুম একটি দীর্ঘ গাছকে। তার গা থেকে বেরনো ধারালো ডালপালায় আমার হাঁটু কেটে যায়।
আমি জানি আপনারা এ গল্প শুনে কী বলবেন, বলবেন কল্পনাপ্রবণ শিশুর মনের ভুল। আমিও তাই বলি। কিন্তু আজও যখন একা একা নিরিবিলিতে বসে শৈশবের সেই কুলটির সন্ধ্যাবেলার কথা ভাবি, সেই বাংলো, বাংলোর বিপরীতের সেই পার্ক, পার্কের হলুদ, নির্জন অস্পষ্ট আলোগুলি, বনতুলসির উগ্র-মিষ্টি গন্ধ, পাপার বেঞ্চিতে বসে থাকা, মাটিতে ঝরে পড়া শুকনো ফুল, রঙিন ফল, দিদিয়ার অনেক উঁচু জায়গায় উঠে খিলখিল করে জয়ের হাসি, হেমন্তের গা শিরশির করা ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় সেই কতদিনের চেনা, দীর্ঘ, হাসিমুখ মানুষটির কথা, যিনি বহুবছর আগের একটি দিনে, চন্দননগর-কুলটির ভৌগোলিক দূরত্বকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে, হাসতে হাসতে, গাছপালার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন আমার দিকে।
আরও পড়ুন: মুখের জায়গায় একটা চেরা জিভ লকলক করছে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি থেকে এই ঘটনা হয়তো অস্পষ্ট হতে হতে একদিন সম্পূর্ণ মুছে যাবে। কিন্তু একটি জিনিস সম্ভবত রয়ে যাবে, গাছের ধারালো ডালে কেটে যাওয়া হাঁটুর ক্ষতের দাগটি।
যে মানুষটিকে দেখেছিলাম, তাঁর কথা বলে শেষ করি। সত্যি ভূতের গল্প হলে, চন্দননগরের থেকে ক’দিন পরে কুলটিতে একটি টেলিফোন আসত, আর একথা-সেকথার পরে জানতে পারা যেত, সে মানুষটি সেদিন, হয়তো বা ঠিক সেই হেমন্ত-সন্ধ্যায়ই মারা গিয়েছেন। কিন্তু এ গল্পে তেমন হয় না, আজও সেই হাসিমুখ, দীর্ঘকায় মানুষটি চন্দননগরে দিব্যি ঘুরে বেড়ান, দেখাও হয়। সবকিছু ঠিকই আছে। কেবল সেই শিশুর চোখের ভুল আর হাঁটুর কাটা দাগটি ছাড়া।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী