Robbar

রাপ্পা রায়ের চরিত্রগুলো যেভাবে তৈরি করেছিলাম

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 4, 2025 8:27 pm
  • Updated:December 4, 2025 8:51 pm  

আমার বাবার চেহারার মধ্যে এক ধরনের বাঙালিয়ানা ছিল– সেটা আমার মনে হত চরিত্রটার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে। ওই চেহারা নিয়ে মজা-ঘষা করতে করতে তৈরি হলো রাপ্পা। রাপ্পা আমার বড় আদরের মিথ্যেদেশের রাজপুত্তুর। আর রাপ্পার সঙ্গে রাপ্পার বাবার সম্পর্কর ছবি এঁকেছি নিজের বাবাকে মনে রেখেই। অবশ্যই অতিরঞ্জিত করে ভালোবাসাময় মিথ্যের প্রলেপ লাগিয়ে। আমার বাবা এতটা রাগী ছিলেন না। আর টনিকে তৈরি করেছি নিজেকে ব্যঙ্গ করে।

প্রচ্ছদ শিল্পী: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়

সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছোটবেলা থেকেই আমি মিথ্যেকথা বলতে ভালোবাসি। শুধু আমি কেন? আমার ধারণা বড় হওয়া, মানে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ার পর থেকেই যে দক্ষতা বা স্কিলগুলো আয়ত্ব করে মানুষ, সেগুলোর মধ্যে মিথ্যে কথা বড় জরুরি বিষয়। মিথ্যে কথার প্রসঙ্গ টেনে আনলাম কেন, মনে হচ্ছে তো? বিশদে বলি।

মিথ্যের কিন্তু নানা সূক্ষ্ম প্রকারভেদ আছে, যেমন– সত্য গোপন এবং অতিরঞ্জন। আমরা বড় হয়ে গেলে দু’রকমই শিখে যাই। যাঁরা খুব খারাপ লোক নয়, অন্য লোকের ক্ষতি করেন না– তাঁরা সাধারণত বদ উদ্দেশ্যে এই দক্ষতা ব্যবহার করেন না। তবে উদ্দেশ্যহীনভাবেও আমরা মিথ্যে কথা বলে থাকি। কারণ আমাদের মন, অন্তরাত্মা– আপনারা যা-ই বলুন, তার গতিপ্রকৃতি বিচিত্র এবং জটিল! আমরা নিজেকেও অনেক সময় নিজের সম্পর্কে ভুল বোঝাই, আর অন্য লোককে তো বোঝাই বটেই। অন্য লোকে আমার মিথ্যেটা চোখ বড় বড় করে গোগ্রাসে গিলছে– এটা একজন দক্ষ, পাঁড় মিথ্যাবাদীকে দুরন্ত ফুর্তি দেয়।

কারণ একমাত্র মিথ্যেবাদীই জানেন, কী নিপুণ দক্ষতায় তিনি মিথ্যে বুনেছেন, তাঁর তো নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে আমি এমনই একটা মিথ্যে পৃথিবী তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলাম। একটা চরিত্র, তার পরিবার, বন্ধু, তার পারিপার্শ্বিক জগৎ– সে এক বিরাট সাতকাহন। একটা মানুষ, তার জামাকাপড়, চশমা, চুলের স্টাইল, স্বভাব, কথাবার্তা, রাগ, হাসি, অভিমান, পাড়া, অফিস, শহর তথা সারা পৃথিবী– সমস্ত কিছু একটা চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে। ‘রাপ্পা’ বলে সত্যিই তো কেউ নেই, তবু মানুষ ভালোবাসছেন মিথ্যেটাকে বিশ্বাস করে। আর এই গল্পটাকে কিছু মানুষ উদ্যোগ নিয়ে সিনেমার মতো মাধ্যমে নতুন করে আবার মানুষের কাছে নিয়ে আসছেন, নতুন করে নির্মাণ করছেন।

এবার এই মিথ্যের কী প্রয়োজন বা আমি এত মিথ্যে গল্প পেলামই কোথা থেকে। আমার চারপাশে আমি যা কিছু দেখছি– সেসব দিয়েই তো আমি মিথ্যে বুনে চলেছি।

আমরা যা হতে চাই, হতে পারি না কিংবা একরকম হতে গিয়ে তার উল্টো কিছু একটা হয়ে যাই অথবা যা কোনও দিন হয়ে ওঠা বা ঘটা সম্ভব নয়– যা অবিশ্বাস্য, অবান্তর– এমন সব কিছু নিয়েই তো তৈরি করি গল্প। আমার গল্প যদি আমি নিজে বিশ্বাস করতে না পারি, তাহলে অন্যরাও বিশ্বাস করবে না। নিজেকে বিশ্বাস করাতে না-পারলে সেই ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে পাঠকদের কাছে, দর্শকদের দরবারে। এ বড় কঠিন কাজ। গালগপ্প বানানোর মজা আছে, তবে খুব যে সহজ তা নয়। এই বিশ্বাস করানোর খেলায় নিজেকে নিংড়ে ফেলতে হয় নানা সময়। যাঁরা তৈরি করেন গল্প, গল্প বোনেন– ঔপন্যাসিক, গল্পকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, কমিকস স্ট্রিপ রচয়িতা– প্রত্যেকের কাছেই এ এক সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ!

‘রাপ্পা’ নামটা আমি দিয়েছিলাম অনুপ্রাস এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে একটা সুবিধেজনক নাম হিসেবে। আর রাপ্পাকে আমি তৈরি করতে চেয়েছি সবসময় এই আমারই মতো মধ্যবিত্ত বাঙালি হিসাবে– যার ট্যাঁকের জোর এবং গায়ের জোর বিরাট কিছু নয়। তবে ফেলুদার মতো ‘মগজাস্ত্র’র ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতীও ছিলাম না। রাপ্পা হল পাশের বাড়ির ছেলে। পাঠকরাও কিন্তু রাপ্পাকে তা-ই মনে করেন। রাপ্পার চেহারা কেমন হবে তাই নিয়ে নানা খসড়া আমি করেছিলাম। একদিন আমার বাবার ২১ বছরের ছবিটা দেখে মনে হল এই চেহারাটা ধরে রাখলে কেমন হয়?

আমার বাবার চেহারার মধ্যে এক ধরনের বাঙালিয়ানা ছিল। সেটা আমার মনে হত চরিত্রটার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে, ওই চেহারা নিয়ে মাজা-ঘষা করতে করতে তৈরি হল রাপ্পা।

রাপ্পা আমার বড় আদরের মিথ্যেদেশের রাজপুত্তুর। আর রাপ্পার সঙ্গে রাপ্পার বাবার সম্পর্কের ছবি এঁকেছি নিজের বাবাকে মনে রেখেই। অবশ্যই অতিরঞ্জিত করে ভালোবাসাময় মিথ্যের প্রলেপ লাগিয়ে। আমার বাবা এতটা রাগী ছিলেন না। আর টনিকে তৈরি করেছি নিজেকে ব্যঙ্গ করে।

লোকে যে যা-ই বলুক, আমি তো জানি– আমি বিশেষ কিছুই পারি না।