বেড়িয়ে আসার বেশ ক’-মাস পর ফেসবুকে একটা ট্রাভেল গ্রুপের পোস্ট চোখে পড়ল। এক ভদ্রলোক সপরিবারে জুলুক ঘুরতে গিয়েছিলেন, তারই বৃত্তান্ত। হোমস্টের যে-বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমাদের হোমস্টেটার মিল আছে। আরও বড় মিল জলের কলে। ওঁরাও নাকি একইরকম একখানা বাথরুমের কল থেকে জল পড়ার উপদ্রবের সম্মুখীন হন। সেইসঙ্গে সারা রাত বেশ কয়েকবার বারান্দা ও ছাদে কারও পায়ের শব্দ শুনেছেন। তারপর সকালে হোমস্টের মালিককে চেপে ধরায় সে এক কাহিনি শোনায়। লিখছেন অরিন্দম অধিকারী
কয়েক বছর আগের কথা। পুজোর ছুটিতে বন্ধুবান্ধব মিলে গেছিলাম জুলুক। দলে আমি, শ্বেতাব্জ ও ওর স্ত্রী সুতনুকা, কৌনিশ ও ওর স্ত্রী মৌসুমী, প্রীতিন, ব্রজ এবং জিতু। অষ্টমীর দুপুরে যখন জুলুক এসে পৌঁছলাম, তখন বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। পূর্ব সিকিমের সাড়ে ন’হাজার ফুট উচ্চতার এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম সত্যিই সুন্দর। হোমস্টের পার্কিং লট থেকে বেশ খানিকটা নীচে দুটো ডাবল বেড রুমে দুই কাপল, আর উপরে একটা ফ্যামিলি রুমে চারজন ব্যাচেলরের থাকার ব্যবস্থা হল। লাগেজ গুছিয়ে রেখে চটপট খেতে বসে গেলাম আমরা। পাতে গরম গরম ভাত ডাল ও মুরগির ঝোল। বৃষ্টিতে ঠান্ডাও পড়েছিল জাঁকিয়ে। খাবার পর গানে-গল্পে সেই ঠান্ডাকে খানিক কাবু করা গেল। বৃষ্টি কমল বিকেলে চা-জলখাবারের সময়। সামনের পাহাড় স্পষ্ট হল অমনি, আর মেঘের পাল গিয়ে ঠেকল খাদের কিনারায়।
হোমস্টের মালিক সপরিবারে কিচেনের পাশের ঘরে থাকেন। ডিনারে রুটি আর ঝাল ঝাল লাল ডিমের ঝোল। কিচেনে বসে খেতে খেতে আর একচোট গল্প জমল বেশ। যে যার মতো ঘরে গিয়ে ঢুকলাম তারপর। পরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে। কিছু সাইটসিয়িং করে চলে যাব ইচ্ছেগাঁও।
উপরের ঘরটায় আমরা চারজন আলো নিভিয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লাম। চারিদিক নিঝুম, শুধু কিছু ঝিঁঝিপোকা একনাগাড়ে ডেকে চলেছে। কতক্ষণ হয়েছে জানি না, হঠাৎ আমার মনে হল বাথরুমে জলের আওয়াজ হচ্ছে। ভাবলাম কেউ বাথরুমে গেছে, যদিও ঘরে আলো নেভানো। বাথরুমের দরজার ফাঁক থেকেও কোনও আলোর আভাস পেলাম না। আমার পাশে প্রীতিন দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ওপাশের বেডে দু’জনেই শুয়ে কি না, ঠিক বুঝতে পারলাম না। হাঁক দিলাম, ‘কেউ কি বাথরুমে গেছিস?’
দু’বার ডাকার পর সকলে উঠে পড়ল, বুঝলাম কেউ-ই বাথরুমে যায়নি। অগত্যা উঠে বাথরুমে গিয়ে দেখি কল থেকে জল পড়ছে। আমি বেশ ভালো করে কলটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তার আগেই জলের ছিটেতে পা ভিজে গেল একটু। যারপরনাই বিরক্ত হয়ে ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেউ বাথরুমে জল ছেড়ে এসেছিলি?’
সকলেই জানাল যে, শোওয়ার পরে কেউ-ই নাকি লেপ-কম্বল ছেড়ে আর বেরয়নি। আমি আর কী বলি, তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
আরও পড়ুন: ওই বাঁশবাগানের বেশ বদনাম আছে
বোধহয় আধ ঘণ্টা পার হয়েছে, হঠাৎ ব্রজ দেখি আমার নাম ধরে ডাকছে।
‘অরিন্দম, এই অরিন্দম! আবার জল পড়া চালু হয়েছে।’
‘কেউ গেছিল বাথরুমে?’
‘না না, আমি তো জেগেই ছিলাম। হঠাৎ একটু আগে শব্দ শুরু হল। প্রথমে টুপটুপ করে, আর এখন তো দিব্যি জোরে পড়ছে!’
‘তুই নিজেই মজা করছিস না তো? বারবার কল চালিয়ে এসে ভয় দেখাতে চাইছিস নাকি?’
শুনেই চটে গেল ব্রজ, ‘বাজে বকিস না তো, ঠান্ডায় আমার দায় পড়েছে এসব করতে! তাছাড়া এই তো পাশে জিতু শুয়ে। শোন ওর কাছে আমি উঠেছি কি না!’ এই বলে ব্রজ নিজেই উঠে কলটা বন্ধ করে এল।
আরও পড়ুন: রাতে শুধু মেসের ছাদে যাস না
সবাই বুঝলাম কলটা খারাপ। সকালে উঠে হোমস্টের মালিককে জানাতেই হবে। আপাতত ঘুমনো যাক। কিন্তু সে-গুড়ে বালি! মিনিট পনেরো পর আবার বাথরুমে জলের শব্দ। উঠে বসলাম সবাই, এ তো ভারী মুশকিল হল! ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি রে বাবা!
রেগেমেগে ঘর ছেড়ে বেরলাম। ভাবলাম আমরা যদি ঘুমোতে না পারি, হোমস্টের লোকেদেরও ঘুমের পরোয়া করে লাভ নেই। ওদের কল ওরা ঠিক করে দিয়ে যাক। সবাই মিলে কিচেনের কাছে গিয়ে ‘ভাইয়া ভাইয়া’ বলে ডাক দিলাম বেশ কয়েকবার। কিন্তু ডাকাডাকিই সার হল, কেউ উঠল না। অগত্যা ফিরে এসে আবার কল বন্ধ করে এসে শুলাম। কী মনে হতে বললাম, ‘সব আলো জ্বালা থাক। এবার যদি জলের শব্দ হয়, কেউ উঠবি না। পড়ুক জল। আমাদের ঘুমটা জরুরি। শব্দ সয়ে যাবে কানে।’
আরও পড়ুন: আড়াই দশক আগের দৃশ্য, আজও আমি স্পষ্ট দেখি
ভাগ্যক্রমে এইবার আর উঠতে হল না। ঘুম ভাঙল একেবারে সকালে। উঠে দেখি বাথরুমের কল বন্ধই আছে। কেউই আর জলের শব্দ শোনেনি। শুধু ব্রজ বলল ও নাকি রাতে বারান্দায় না ছাদে কারও পায়ের শব্দ শুনেছে। ভাবলাম হোমস্টের লোকেরা বোধহয় রাত থাকতেই কাজকর্ম শুরু করে দেয়, সেই শব্দই শুনে থাকবে। মালিককে যদিও আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিলাম। সে আমতা আমতা করে বলল কলটা সারিয়ে নেবে। আমরা আর আমল দিলাম না ওতে। তাড়া ছিল, জলদি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেলাম সবাই।
এ-ঘটনার একটা উপসংহার আছে। বেড়িয়ে আসার বেশ ক’-মাস পর ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ট্রাভেল গ্রুপের পোস্ট চোখে পড়ল। এক ভদ্রলোক সপরিবারে জুলুক ঘুরতে গিয়েছিলেন, তারই বৃত্তান্ত। হোমস্টের যে-বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমাদের হোমস্টেটার মিল আছে। আরও বড় মিল জলের কলে। ওঁরাও নাকি একইরকম একখানা বাথরুমের কল থেকে জল পড়ার উপদ্রবের সম্মুখীন হন। সেইসঙ্গে সারা রাত বেশ কয়েকবার বারান্দা ও ছাদে কারও পায়ের শব্দ শুনেছেন। তারপর সকালে হোমস্টের মালিককে চেপে ধরায় সে এক কাহিনি শোনায়। হোমস্টের আগের মালিকের ছোট্ট মেয়ে নাকি ভয়ংকর জ্বরে মারা গিয়েছিল বছর দশেক আগে। সেই থেকে বছরে এক-দু’বার নাকি এমন ঘটনা ঘটে। ওঁদের ধারণা সেই মেয়ের আত্মাই এসব ঘটায়, তবে কারও ক্ষতি করে না। হোমস্টের বর্তমান মালিক বারবার অনুরোধ করেছেন একথা যেন চাউর না হয়, হলে তাঁদের ব্যাবসার ক্ষতি হবে। পোস্টদাতা যে সে-অনুরোধ রাখেননি, তা বলাই বাহুল্য। আমি বন্ধুদের সে-পোস্টটা ফরোয়ার্ড করতেই সবাই আঁতকে উঠল। নাগরিক কোলাহলে আমাদের ভয় তেমন করল না ঠিকই, তবে এ-ঘটনা আগে থেকে জানা থাকলে সেই রাতে যে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে যেতাম, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভূতের ভয় ভূতে বিশ্বাস থেকেই যে সবসময় হয়, তা তো নয়। আশপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপরও তা নির্ভর করে। কথাটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী