
কখনও-কখনও জ্যোতির সঙ্গে ইংরেজ কবির বিভেদরেখা হারিয়ে যায় আমার চোখে। শেলির মতো সেও বানায় নিজের সমুদ্র-যাত্রার নৌকো। শেলির মতো সেও দেখে ডিঙিনৌকোয় সাগর পাড়ির স্বপ্ন। সে তো প্রায় ৪৮ বছর আগের ঘটনা। কাকদ্বীপে জ্যোতি। তার মুখেই শুনেছি সে-গল্প। সেখানে সে দেখা পেয়েছে এক প্রাচীন, শরীর হারানো নৌকোর। তাকে শাল আর সেগুনকাঠে তাগড়াই করার ভার সে তুলে নিয়েছিল। ক্রমে যৌবন ফিরে পেল সেই সাগরডিঙি। শেলি তাঁর নৌকোর নাম রেখেছিল ‘এরিয়েল’।
‘দ্যাট ফেলো হ্যাজ্ টাচড্ আ নিউ লো’। যে মুহূর্তে জ্যোতির মুখে এই বাক্য শুনলাম, সেই মুহূর্তে আমার মনে ‘হি টাচড্ আ নিউ হাই’। বুঝলাম, জ্যোতি বাংলা-ইংরেজি– দুটো ভাষাই তুখড় জানে। তখন বোধহয় ‘যুগান্তর’ কাগজে নিয়মিত বেরচ্ছে জ্যোতির কলাম, ‘কোমল-ক্যাকটাস’। এর পরে, কিংবা হয়তো পাশাপাশি, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত হতে লাগল জ্যোতির ‘প্রিকলি পিয়ার্স’। আর আমি পড়ে শুধু বিস্মিত হচ্ছি, মানুষটা দুটো ভাষায় সাবলীল সাংবাদিকতা করে চলেছে কী অসামান্য দক্ষতায়! ‘কোমল-ক্যাকটাস’-এর বাংলা আরও কোনও বাঙালি সাংবাদিকের হাতে তখন নেই। ‘প্রিকলি পিয়ার্স’-এর ইংরেজি তখন অমৃতবাজারের নাগালের একেবারে বাইরে। জ্যোতি কী যুগান্তরে, কী অমৃতবাজারে, ‘এয়ারড্রপড্’।
জ্যোতির সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে আমার প্রথম আলাপ। এবং প্রথম আলাপেই বুঝলাম, জ্যোতি নেমে এসেছে বাঙালি আটপৌরেমিতে– প্যারাশুটে, অনেক দূরের আকাশ থেকে। তবু আমার পক্ষে জ্যোতির কাছে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কারণ আমরা পিঠোপিঠি সমসময়ের। জ্যোতি ৮৯ বছর বয়সে চলে গেল। আমি ৮৫-তে বেঁচে আছি। কিন্তু খুব কাছে গিয়েও জ্যোতিকে সূচ্যগ্র জানাও বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার কারণ, আমি এক পা এগোই তো তিন পা পিছিয়ে যাই। ভীরুতায় ও শ্লথতায় ক্লেদাক্ত আমি সংশয়ে ও অনিশ্চয়তায় সদা বিপন্ন। আমার চোখের সামনে জ্যোতি দৌড়চ্ছে, পুলিশ তার পিছু নিয়েছে, সে তিনতলা থেকে সোজা লাফিয়ে পড়ছে। পুলিশ দোতলার পাঁচিলের সামনে হ্যামলেট-অনিকেত: ‘টু জাম্প অর নট টু জাম্প?’ জ্যোতি ততক্ষণে ‘ভ্যানিশ’!
কখনও-কখনও জ্যোতির সঙ্গে ইংরেজ কবির বিভেদরেখা হারিয়ে যায় আমার চোখে। শেলির মতো সেও বানায় নিজের সমুদ্র-যাত্রার নৌকো। শেলির মতো সেও দেখে ডিঙিনৌকোয় সাগর পাড়ির স্বপ্ন। সে তো প্রায় ৪৮ বছর আগের ঘটনা। কাকদ্বীপে জ্যোতি। তার মুখেই শুনেছি সে-গল্প। সেখানে সে দেখা পেয়েছে এক প্রাচীন, শরীর হারানো নৌকোর। তাকে শাল আর সেগুনকাঠে তাগড়াই করার ভার সে তুলে নিয়েছিল। ক্রমে যৌবন ফিরে পেল সেই সাগরডিঙি। শেলি তাঁর নৌকোর নাম রেখেছিল ‘এরিয়েল’।
জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর ডিঙির নাম রাখল ‘মণিমেখলা’। ‘মণিমেখলা’ যে জ্যোতির জীবনে নতুন নারী– মনে হয়েছিল আমার। কোন নদীর ধারে মণিমেখলাকে পেয়েছিল জ্যোতি? কাকদ্বীপের কালনাগিনী নদীর ধারে। কলকাতার উট্রাম ঘাট থেকে মহাসমুদ্রের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল জ্যোতিকে নিয়ে মণিমেখলা। তারপর আর কোনও খবর নেই। প্রায় দু’-মাস পরে ফিরেছিল জ্যোতি। আর কোনও বাঙালি লেখক, কবি, সাংবাদিক, ইন্টেলেকচুয়াল এমন ঝোড়ো জীবন যাপন করেছে বলে আমার জানা নেই!

জ্যোতির দারুণ কীর্তি তার ‘কলকাতা’ পত্রিকা। কিন্তু সেই পর্বে যাওয়ার আগে, জ্যোতির জ্যোতির্ময় গান্ধীবাদ? জ্যোতি জুতো পরে না। জ্যোতি নিরামিষ খায়। জ্যোতি খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায় সারা কলকাতা। আমি কখনও গরম পিচে পা রাখি। কখনও পরম গোবরে। দুটোই সমান সহনীয়। কিংবা সুন্দর। বলল একদিন জ্যোতি। এবং গান্ধীবাদের সময়েই জ্যোতি ডাকল আমাকে তার বাড়িতে ওয়াইন উৎসবে। সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম, জ্যোতি এবং জ্যোতির স্ত্রী মীনাক্ষীর সুবিমল সৌজন্যে, ‘কেকস অ্যান্ড এল্’ শুধু ইংরেজি উপন্যাসের উপহার নয়, বাঙালির জীবনেও, চূড়ান্ত গান্ধীবাদের মধ্যেও, ‘কেকস অ্যান্ড এল্’ হয়ে উঠতে পারে জীবনের উৎসব। এবং প্রেমেরও। সেদিন প্রেমিক জ্যোতিরও অকুণ্ঠ প্রকাশ দেখেছিলাম। তবু এই জুতোহীন উদ্বেল প্রেমিককে আনন্দবাজারের বরুণ সেনগুপ্ত ‘খালিপদ’ নামেও ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঙালির ঘরে ঘরে। তাকে বাঙালির অনেকেই ‘খালিপদ’ ডাকতে ভালবাসে। বিদ্রুপে নয়, কিছুটা নিরীহ মজায়।
এহেন বর্ণময় মানুষ নিজের সম্পাদনায় নিয়ে এলেন মাসিক পত্রিকা ‘কলকাতা’। নতুন শহুরেপনা চমকে উঠল বাংলা সাহিত্যে। নব আশনাই ঝিলমিল করে উঠল বাংলা ভাষায়। বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মীনাক্ষীকে বিয়ে করেছে জ্যোতি। বুদ্ধদেব তখন বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম তারকাদের একজন। এবং নিজস্ব দ্যুতিতে ভাস্বর। তবুও বুদ্ধদেবকে দিয়ে একটি লেখাও লেখানোর চেষ্টা করেনি জ্যোতি। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, বুদ্ধদেব-বর্জিত কলকাতার দু’টি বিশেষ সংখ্যা হল বুদ্ধদেব প্রসঙ্গেই। সারকথা ছোট করে বলি, ‘কলকাতা’র মতো কোনও পত্রিকা বাংলা ভাষায় আগে হয়নি। পরেও হবে না। তার কারণ, জ্যোতির ভাবনা ও ভাষা আর কারও সাধ্যে আসবে বলে তো মনে হয় না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। বুদ্ধদেবের লেখার প্রসঙ্গে অনবদ্য এবং অনন্য জ্যোতি। লক্ষ করুন এই অননুকরণীয় এবং ঈর্ষণীয় আধুনিকতা: ‘রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ পেশাদার, মনস্ক লেখক হলেন বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দের অধ্যাত্মজীবন নীরব ও আত্মগোপনকারী; তিনি তার জটিল সৃষ্টিপ্রক্রিয়া– একটা রোমশ ওলের মতো– মাটির তলায় লুকিয়ে রাখেন।’ আহা! এমন বাংলা যদি লিখতে পারতাম!

এবার আসি জ্যোতির বুদ্ধদেব থেকে তার বুড়ো আঙুলে। নিজের বুড়ো আঙুলের স্বার্থকতা সম্বন্ধে জ্যোতির এই উচ্চারণ অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য:
‘কী জন্যে বল তো ঈশ্বর আমার বুড়ো আঙুলের ফাঁকে
রেখেছেন ঐ অপেক্ষমাণ খাঁজ ঐ ক্ষুদিত কুঞ্চন
কী আছে এই চরাচরে যা নিটোল ভরিয়ে দিতে পারে
ঐ শূন্যস্থান
তোমার বামস্তনের কুঁড়ি ছাড়া’
আমি আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর সাহায্যে গোল বৃত্তাকার ফাঁক তৈরি করে ভালবাসার মেয়ের বাম ও ডান স্তনের কুঁড়ি সেখানে গলিয়ে দেখেছি, জ্যোতি কতদূর নির্ভুল নিটোল তার কবিতায়! এবং সেকথা জানাতে ভুলিনি তাকে!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved