টিকিটে ফাঁকি দিয়ে বিনি মাগনায়, স্রেফ সময় খচ্চা করেই স্থানবদল অনায়াসসাধ্য। কিন্তু অবাক হয়ে যেতে হয় এক সাম্প্রতিক ঘটনায়। এক দরিদ্র মহিলা, যাঁকে ট্রেনের টিকিট চেকার টিকিট দেখাতে বলায় টিকিটখানা বের করে দেখালেন তো বটেই, দেখালেন তাঁর পোষ্য ছাগলের জন্যও তিনি টিকিট কেটেছেন! সে ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে বটে! কিন্তু তাঁর এই সততা কি ভাইরাল হবে?
টিকিট বিচিত্র জিনিস! সে মন্ত্রিসভা হোক বা লোকাল ট্রেন, সিনেমা হোক বা আইপিএল-ডার্বি, ট্রাম-বাসের হোক বা মিউজিয়ামের। জীবনে টিকিটের টিকিটি সর্বক্ষণই উঁচিয়ে থাকে। বিনামূল্যে পাওয়া টিকিটের প্রতি লোভের জিহ্বা দোদুল দোলে! আর টিকিটে কড়ি খরচের বেলায় পকেটে পড়ে টান ! টিকিট আসলে যাইবার পাস, কিন্তু এই নিয়মের যে ব্যত্যয় ঘটে না, এমনও নয়। টিকিট ফাঁকিও দেওয়া যায় দিব্যি, যাও কোন চুলোয় যাবে। সে-ও এক আর্ট বটে। মনে রাখবেন, লুকোচুরিই একমাত্র খেলা যা গণপরিসরেও, এমনকী, গণ-পরিবহণেও খেলা যায়। হতেই পারত ‘জাতীয় খেলা’, কিন্তু তার দাম দিল না কেউ।
বাঙালির আদ্যিকালের হরেকরকম শখের মধ্যে একটি এই টিকিট জমানোও। ট্রেনের টিকিট দিয়ে তাসের ঘর সাজানোর খেলাও ওই এককালে বাঙালি দিব্যি খেলেছে। ইদানীং, সে খেলায় ভাটা পড়েছে বইকি! রুগ্ণ ছিপছিপে রেলের টিকিটে বড়জোর নৌকো গড়া যায়, তার মেয়াদ বেশি নয়। তাছাড়া এখন তা অর্ধেক বস্তুই অনলাইন– পেপারলেস টিকিট– চারপাশের গাছগাছালি দেখে, এত সুদিং জলহাওয়া দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেমন সবুজায়নটাই না করছি আমরা! মনে পড়ে যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্রর ‘টিকেট’ গল্পখানাও। মাসের শেষে কন্ডাক্টরকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি আসার পর সীতাংশু দেখে, তার সন্তান বিনুকে স্ত্রী মল্লিকা পড়াচ্ছে– ‘নীতি এই যথা তথা। সদা বল সত্য কথা।’ সেই বিনু প্রায় কন্ডাকটরের মতোই নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে। চায় টিকিট। বাসের হোক বা ট্রামের। এই জমানোর অভ্যাস করিয়েছিল সীতাংশু নিজেই। এখন সে পড়েছে মহা বেকায়দায়। বাসের নয়, ট্রামের নয়, একেবারে বাড়ির মধ্যেই যে ঢুকে পড়েছে কন্ডাকটর, তার বিনু। প্রশ্ন করছে, সে প্রশ্ন সে এড়িয়ে চলতে চাইছিল সারা ট্রামে, এখন ঢুকে পড়েছে তা, নিজেদের ঘরেই।
যাই বলুন, টিকিটের ব্যাপারে সবথেকে বেশি যে চঞ্চল ও তৎপর, সে বাসের কন্ডাকটর। সে-ই ওই টিকিটের অমনিবাস নিয়ে চ্যাড়াৎ-চ্যাড়াৎ আওয়াজ তোলে ও ভাড়াটি আদায় করে। কেউ কেউ এমন থাকে বটে, যে, আগ বাড়িয়ে নোটখানা পৌঁছে দেয়। এমনকী, নোটখানা একেবারে কনডাক্টর স্টাইলে ভাঁজ করেও দেয়। এই সুভদ্র লোকজনদের কথা বলছি না। বলছি সেই সুবিধাবাদীদের কথা, যারা পারলেই গপ করে টিকিটের দামখানা গিলে নিজের পকেটস্থ করার ধান্দায় থাকে; অথচ পকেট যে অনুকূল নয়, তাও না। টাকা থাকতেও এমন বাঁকা কাজ করা লোকজন কিছু কম নেই। যাঁরা নিরুপায়, তাঁদের কথা এ বেলায় তোলা থাকল। কিন্তু এর বাইরের বলয়ের ফেরেব্বাজদের ট্রামে-বাসে-ট্রেনে– মুখোমুখি নিশ্চিত হয়েছেন আপনারা। গাপ্পি মেরে তারা দ্রুত কেটে পড়ে, আবার কখনও ধরাও পড়ে। তারপর বাস হলে, ‘ইয়ে মানে দিচ্ছি’ আর ট্রেন হলে আইন ও ফাইন।
এই ছিল রোজকার জীবনযাপন। বাস-ট্রামের কন্ডাকটর, রেলের টিটির সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। আত্মবিশ্বাসকে সাঁ করে একেবারে এভারেস্টে তুলে দেওয়া। এবং বিনি মাগনায়, স্রেফ সময় খচ্চা করেই স্থানবদল অনায়াসসাধ্য। কিন্তু অবাক হয়ে যেতে হয় এক সাম্প্রতিক ঘটনায়। এক দরিদ্র মহিলা, যাঁকে ট্রেনের টিকিট চেকার টিকিট দেখাতে বলায় তিনি তা বের করে দেখালেন তো বটেই, দেখালেন তাঁর পোষ্য ছাগলের জন্যও তিনি টিকিট কেটেছেন! সে ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে বটে! কিন্তু তাঁর এই সততা কি ছড়িয়ে পড়বে একইভাবে?
বিশ্ব ডাকটিকিট জানে, এই প্রথম জানল ছাগ-টিকিট। কিন্তু ফলশ্রুতি হিসেবে কি টিকিট না কাটা ধূর্ত পাবলিকের দ্রুত পলায়ন কমে যাবে? জানি, সে নিতান্তই দুরাশা। তবে ছাগলেরও যদি টিকিট হয়ে থাকে, নিদেনপক্ষে মানুষের একটা না হলেই নয়, কী বলুন?