Robbar

ন্যায়ে ফিরল ভারত, সুপ্রিম কোর্টের রায় বিলকিসের হাসির পক্ষে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 10, 2024 6:13 pm
  • Updated:January 10, 2024 6:13 pm  

দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি দোষীদের ফাঁসির দাবি তুলেছিল। নির্ভয়ার দোষীদের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু খোদ নরেন্দ্র মোদির গুজরাতে বিলকিসের ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের হত‌্যাকারীদের সাজা কমানো হয়েছে। দেশের আইন ও ন‌্যায় ব‌্যবস্থার এত বড় পরিহাস হয়তো আর কিছু নেই। বিলকিস বানোর ঘটনা বিচ্ছিন্ন একটা অপরাধের ঘটনা নয়। এটা একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে থাকা ঘৃণা থেকে উদ্ভূত অপরাধ। 

সুতীর্থ চক্রবর্তী

২০২২-এর ১৫ আগস্টকে শুধু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির জন‌্যই দেশের ইতিহাস মনে রাখবে না। একটি কলঙ্কিত ঘটনাও এই ঐতিহাসিক দিনটির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।

এই দিনেই গুজরাতের বিজেপি সরকার বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সাতজন সদস‌্যকে খুনের মামলায় দোষী সাব‌্যস্ত ১১ জনকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল। জঘন‌্য অপরাধে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ওই ১১ জনকে মালা পরিয়ে, মিষ্টি বিতরণ করে, জেল থেকে মুক্ত করে এনেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। যা দেখে নিন্দার ঝড় উঠেছিল বিশ্বজুড়ে। সুপ্রিম কোর্ট ওই ১১ জনকে ফের জেলে ঢোকানোর নির্দেশ দিয়ে, কলঙ্ককে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করলেও স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির দিনটি উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে গুজরাত সরকারের কীর্তিটি বারবার সামনে আসবেই।

Bilkis Bano case: No information yet about surrender of convicts, says Dahod SP

গোধরা কাণ্ডের পর ঘটে যাওয়া, গুজরাত দাঙ্গার নৃশংসতম অধ‌্যায়টি নিশ্চিত করেই বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সাত সদস্যর খুন হয়ে যাওয়া। গুজরাতের দাহোদ জেলার বাসিন্দা বিলকিসের বয়স তখন ২১ বছর। গণধর্ষণের সময় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাও ছিলেন বিলকিস। ধর্ষণকারীরা বিলকিসের সামনেই হত‌্যা করেছিল, তাঁর তিন বছরের মেয়েকে। ২০০২ সালের ৩ মার্চের ঘটনা। ২০০৩ সালে ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ২০০৪ সালে গ্রেপ্তার হয় ২০ জন অভিযুক্ত। তারপর থেকেই বিলকিসকে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হতে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা স্থানান্তরিত হয় মহারাষ্ট্রের আদালতে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

তৃণমূলের বহিষ্কৃত সাংসদ মহুয়া মৈত্র, সিপিএম নেত্রী সুভাষিণী আলি-সহ আরও কয়েকজন গুজরাত সরকারের সাজা কমানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। বিচারপতি বিভি নাগরত্ন ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভূঁইয়ার বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের ২০২২-এর রায়ে গুজরাত সরকারকে অপরাধীদের সাজা কমানোর কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। গুজরাত সরকার শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত, ১১ জনকে দোষী সাব‌্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। বাকিরা বেকসুর খালাস হয়। ১১ জনের সাজা বম্বে হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখে। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি দোষীদের ফাঁসির দাবি তুলেছিল। নির্ভয়ার দোষীদের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু খোদ নরেন্দ্র মোদির গুজরাতে বিলকিসের ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের হত‌্যাকারীদের সাজা কমানো হয়েছে। দেশের আইন ও ন‌্যায় ব‌্যবস্থার এত বড় পরিহাস হয়তো আর কিছু নেই। বিলকিস বানোর ঘটনা বিচ্ছিন্ন একটা অপরাধের ঘটনা নয়। এটা একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে থাকা ঘৃণা থেকে উদ্ভূত অপরাধ।  এই অপরাধের সামাজিক অভিঘাত অনেক ব‌্যাপ্ত। সেই অপরাধ যারা সংঘটিত করেছিল, আদালতে যারা দোষী প্রমাণিত, তাদের সাজা কমানো চ‌্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল আইন, আদালত, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি-সহ সবাইকে। সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে সবার মুখ রক্ষা করল।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: জনগণের করের টাকায় সরকারি বাসভবনে বৈভবের কুৎসিত প্রদর্শন, দৈনিক ৬০,১৮৫ টাকা বরাদ্দ খানাপিনায়

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

যে অপরাধের বিচার হয়েছিল মহারাষ্ট্রে, সেই অপরাধের সাজা কমানোর ক্ষমতা যে গুজরাত সরকারের নেই, তা সিআরপিসির ধারা উল্লেখ করে বলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। রাধেশ‌্যাম ভগবানদাস শাহ নামে ১১ দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপকের অন‌্যতম যে, সুপ্রিম কোর্টে সাজা কমানোর প্রথম আর্জি জানিয়েছিল, সে আগে প্রত‌্যাখ‌্যাত হয়েছিল গুজরাত হাই কোর্টে এবং মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে। গুজরাত হাই কোর্টই ২০১৯ সালে রাধেশ‌্যামকে বলে দিয়েছিল, সাজা কমানোর অধিকার এক্ষেত্রে একমাত্র মহারাষ্ট্র সরকারের। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার সাজা কমানোর আর্জিতে সাড়া দেয়নি। মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তর সেসময় সিবিআই আদালতের অভিমত নেয়। আদালত সাজা কমানোর আর্জি পত্রপাঠ খারিজ করে।

बिलकिस बानो के गुनहगारों को मजबूरी में छोड़ना पड़ा घर, परिजन बोले- जानबूझ फंसाने की साजिश - the culprits of bilkis bano had to leave the house under compulsion-mobile

এইসব তথ‌্য গোপন করে রাধেশ‌্যাম সাজা কমানোর আর্জি নিয়ে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। ২০২২ সালের ১৩ মে সুপ্রিম কোর্ট সাজা কমানোর আর্জিটি পাঠিয়ে দেয় গুজরাত সরকারের কাছে। গুজরাত সরকারের আইনজীবীরা, সুপ্রিম কোর্টে উল্লেখ করেননি হাই কোর্টের রায়ের কথা। শোনা হয়নি বিলকিসের বক্তব‌্যও। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে হাতিয়ার করে গুজরাত সরকার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের অধিকার, নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। উপরন্তু সাজা কমানোর ক্ষেত্রে, ১৯৯২ সালের জেল কোড প্রয়োগ করে। কারণ, ২০১৪ সালের জেল কোডে ধর্ষকদের সাজা কমানোর সুযোগ নেই। সাজাটি ২০০৮ সালের, এই যুক্তি দেখিয়ে ১১ জন অপরাধীর ক্ষেত্রে ১৯৯২-এর বিধি প্রয়োগ হয়। গুজরাত সরকারের যে ১০ সদস্যের কমিটি সাজা কমানোর সুপারিশ করে তার মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন বিজেপির নেতা। তাঁদের মধ্যে দু’জন বিজেপির বিধায়ক। বিজেপি বিধায়করা বলেন, ‘১১ অভিযুক্তই সংস্কারি ব্রাহ্মণ। এরা কেউ অপরাধে যুক্ত ছিল না।’

বিরোধীদের বরাবরের অভিযোগ, গুজরাতের বিধানসভা ভোটের আগে হিন্দুদের মন জয় করতেই বিজেপি সরকার বিলকিসের ধর্ষকদের সাজা কমিয়েছিল। তাই সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পর রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘নির্বাচনী ফায়দার জন‌্য ন‌্যায়কে হত‌্যা করার প্রবৃত্তি গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।’ তৃণমূলের বহিষ্কৃত সাংসদ মহুয়া মৈত্র, সিপিএম নেত্রী সুভাষিণী আলি-সহ আরও কয়েকজন গুজরাত সরকারের সাজা কমানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। বিচারপতি বিভি নাগরত্ন ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভূঁইয়ার বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের ২০২২-এর রায়ে গুজরাত সরকারকে অপরাধীদের সাজা কমানোর কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। গুজরাত সরকার শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল।

২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক ইউডি সালভি ১১ জন অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছিলেন। গুজরাত সরকারের সাজা কমানোর সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এখন অবসর নেওয়া ওই বিচারক। সংবাদমাধ‌্যমকে তিনি বলেছেন, ‘ওই ১১ অপরাধীকে এই যুক্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিইনি কারণ তারা অপরাধটা ঘটিয়েছিল অন‌্যদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে। কিন্তু তা বলে তাদের সাজা কমানো মেনে নেওয়া যায় না। সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত সমাজকে খুব ভুল বার্তা দিচ্ছিল।’ মহারাষ্ট্রে এখন বিজেপির সরকার। এবার ওই ১১ জনের সাজা কমানোর আর্জি যদি আইনি পথ ধরে ফের মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে যায়, তা হলে কি অবসর নেওয়া বিচারক সালভির মতামত আর আদৌ গুরুত্ব পাবে? বিলকিসের মতো দেশবাসীকেও এখন সেই ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বিলকিস মামলার উপসংহার টানা হয়নি। বিলকিসের লড়াই নিঃসন্দেহে আরও বাকি রয়েছে।