Robbar

বিগত যুগের স্মৃতি নয়, বিনোদিনীর থিয়েটার আজকের নাট্য আন্দোলনেও জুড়ে থাক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 6, 2025 4:11 pm
  • Updated:January 6, 2025 4:11 pm  

এই নামকরণের মধ্য দিয়ে একটা নতুন পথ উন্মোচিত হল, যে পথে হেঁটে, বিনোদিনী থিয়েটারে আর‌ও বেশি বেশি করে নাটক অভিনয় মঞ্চস্থ করার দাবি আমরা জানাতে পারি। নানা ধরনের নাটকের চর্চা ওই মঞ্চে হোক। সবমিলিয়ে একটা উন্মুক্ত পরিসর, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেছেন বিনোদিনী।

দেবশঙ্কর হালদার

আমরা যারা থিয়েটারের সঙ্গে থাকি, চেষ্টা করি থাকার, পারি কি না, জানি না। কিন্তু যখন বিপথগামী হ‌ই, অন্য কাজে যখন নিজেকে নিয়োজিত করি, অভিনেতা হিসেবে থিয়েটার কিন্তু আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের ছেড়ে সে যায় না। সেই থিয়েটার যখন যায়, তখন সেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কিংবদন্তিরা, যাঁরা থিয়েটারের মাটিকে ঊর্বর করেছেন, তাঁরাও যান। সেই রকম একজন মানুষ, যাঁকে নিজের অভিনয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি, বিনোদিনী দাসী অর্থাৎ, নটী বিনোদিনী তেমনই একজন। সেই কিংবদন্তির নামে এত বছর পর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটছে, সেটা পরম আনন্দের ব্যাপার।

বিনোদিনী দাসী - উইকিপিডিয়া
বিনোদিনী দাসী

এই যে মাটিতে আজ আমরা অভিনয়ের চেষ্টা করছি, নিজেদের প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আদ্যোপান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সেখানে নিজের সর্বস্বটুক দিয়ে অভিনয়ের ফসল ফলিয়েছেন নটী বিনোদিনী। ঊর্বর করেছেন অভিনয়ের মৃত্তিকাকে। জীবনে তাঁর একটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, স্বনামে তাঁর একটি থিয়েটার হবে। ইতিহাস সাক্ষী, সেই আকাঙ্ক্ষা তাঁর অপূর্ণ ছিল। নানা কারণে সে-সময়ে এই মহৎ কর্মটি করা গেল না। তা বাস্তবায়িত হল না, কারণ, ওই সময়কালে দাঁড়িয়ে একজন নারীর নামে মঞ্চের নামকরণ হবে, থিয়েটারের নামকরণ হবে, তা মেনে নেওয়া সেই সময়ের ‘বীরপুঙ্গব’দের কাছে বড় কঠিন ছিল!

কাছের মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিশ্রুতি যখন পূর্ণ হল না, তখন মানসিক ভাবে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন বিনোদিনী। আসলে মানুষ নানা ভাবে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন অকস্মাৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে মনকে শক্ত করা খুব কঠিন হয়। বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেকেই বলতে পারেন, এই খ্যাতির চেয়ে অভিনয়, এই যাপন তো অনেক বড় ব্যাপার, তা আঁকড়ে ধরলেই তো এই ক্ষতের নিরাময় হতে পারত বিনোদিনীর। আসলে মানুষ নানা ভাবে তার স্বপ্ন বোনে। বিনোদিনী‌ও সেভাবেই নিজের স্বপ্নটাকে লালন করেছিলেন, যে তাঁর নামে সাধের একটি থিয়েটার হবে। আমি, থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষ হিসেবে এইভাবে তাঁর স্বপ্নটাকে দেখতে পাই যে, একজন নটীর নামে বা একজন নারীর নামে যখন একটা থিয়েটার হয়, যখন সেই নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে, তখন আসলে নাটক অর্থাৎ সেই শিল্প মাধ্যমকেই সম্মান জানানো হয়। বিনোদিনী‌ও হয়তো তাই ভেবেছিলেন। ব্যক্তিগত খ্যাতির চেয়েও তাঁর থেকে এই শিল্প মাধ্যমের প্রাপ্তি, যা তাঁকে পরিচয় দিয়েছে, সেখানে চথচলতি মানুষের কাছে জীবৎকালে নিজ নামে থিয়েটার হ‌ওয়া অনেক গৌরবজনক ছিল।

কলকাতার ঐতিহ্যবাহী স্টার থিয়েটারের নাম বদলে রাখা হলো বিনোদিনী থিয়েটার | প্রথম আলো
স্টার এখন বিনোদিনী থিয়েটার

নানা কারণে তা হয়নি। কেন হয়নি, তার নানা তথ্য, নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। আজ তার সবিস্তারে আলোচনায় আর যাচ্ছি না। কিন্তু যা এককালে হয়নি, সম্প্রতি তা হয়েছে। স্টার থিয়েটার এখন বিনোদিনী থিয়েটার। এই সম্মাননার মধ্য দিয়ে শুধু একজন কিংবদন্তিকে নয়, সামগ্রিক ভাবে একটা পরম্পরাকে‌ও সম্মান জানানো হয়েছে। সেই পরম্পরা কি? জীবনযাপন যেমন নরনারী ছাড়া হতে পারে না, দিনরাত্রির মতোই যেমন তার সহাবস্থান, ঠিক তেমন‌ই নাটক নির্মাণে‌ও নারী এবং পুরুষের সমান অবদান অনস্বীকার্য। সেই ঘটনাটিকে যিনি ঘটিয়ে তুলেছেন শরীর দিয়ে, মন দিয়ে, আবেগ দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে, উচ্ছ্বাস দিয়ে, তাঁর নামে যখন কো‌ন‌ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়, তা যখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে, তখন আমরা আরও একটু উৎসাহ বোধ করি, সম্মান বোধ করি, অনুভব করতে পারি, আমরা যে শিল্প মাধ্যমটির সঙ্গে জড়িত তার গৌরববৃদ্ধি হচ্ছে। যে সময়ে এটি হ‌ওয়ার কথা ছিল, সে সময়ে তা হয়নি। এতদিন পরে, সেই সত্য-উপলব্ধ আকাঙ্ক্ষা, তাই যে বাস্তবায়িত হল, তার ওপর যে আলো পড়ল, এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দের। আসলে সময়ের পলি যত‌ই জমা হোক না কেন, সত্য সুন্দর, সমস্ত মলিনতা ঘুচিয়ে সে ঠিক প্রতিষ্ঠিত হয়, উদ্ঘাটিত হয়, হয়ে অনাবিল আনন্দ দান করে, উদ্বেল করে তোলে। তখন মনে হয়, এই সত্য অমোঘ। এ একদিন ঘটত‌ই। আমরা সেই শুভক্ষণের সাক্ষী।

…………………………………………..

আমি, থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষ হিসেবে এইভাবে তাঁর স্বপ্নটাকে দেখতে পাই যে, একজন নটীর নামে বা একজন নারীর নামে যখন একটা থিয়েটার হয়, যখন সেই নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে, তখন আসলে নাটক অর্থাৎ সেই শিল্প মাধ্যমকেই সম্মান জানানো হয়। বিনোদিনী‌ও হয়তো তাই ভেবেছিলেন। ব্যক্তিগত খ্যাতির চেয়েও তাঁর থেকে এই শিল্প মাধ্যমের প্রাপ্তি, যা তাঁকে পরিচয় দিয়েছে, সেখানে চথচলতি মানুষের কাছে জীবৎকালে নিজ নামে থিয়েটার হ‌ওয়া অনেক গৌরবজনক ছিল।

…………………………………………..

নাটকের মাধ্যমে আমরা যাঁরা বঙ্গ-সংস্কৃতির চর্চা করে থাকি, তাঁরা কোন‌ও না কোন‌ও ভাবে, কখন‌ও নটী বিনোদিনীর ভাবনাকে ছুঁয়ে গেছেন। কেউ নটী বিনোদিনীকে নিয়ে নাটক করেছেন, কেউ গিরিশ ঘোষকে নিয়ে, কেউ বা রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দকে নিয়ে। সেই সূত্র ধরে নটী বিনোদিনী নামটা এবং নাটক ফিরে এসেছে। আমি একটি নাটকে অভিনয় করি ‘এক মঞ্চ, এক জীবন’ নামে, নামটিও খুব সদর্থক। কারণ, মঞ্চ আর জীবন উভয়েই অভিন্ন। একটা মঞ্চ এবং একটা জীবন কেমন ভাবে হাত ধরাধরি করে বিস্তৃত হতে হতে একটা নতুন ঢেউ তুলল, আমাদের উদ্বেল করল, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই নাটকে গিরিশ ঘোষের চরিত্রে অভিনয় করার সময় আমকে যখন নটী বিনোদিনী বলছেন, ‘মাস্টারমশাই কেন আমার নামে থিয়েটার হল না…’ তখন বিনোদিনীকে প্রবোধ দিতে গিয়ে আমি বলছি, ‘আরে, তুই তো নিজেই স্টার! তাই তো এটা স্টার থিয়েটার।’ এই সংলাপ আমি উচ্চারণ করেছি। তারপরে আর‌ও যে সংলাপ বলতাম বিনোদিনীর দিকে তাকিয়ে, তা বলার জন্য আজ‌ও বেদনা হয় মনে, ভবিষ্যতে‌ও হবে। তার কারণ, সেই প্রবোধ-বাক্য আসলে মূল্যহীন। বলতাম– একটা মেয়ের নামে কি কখনও থিয়েটার হয়, যে কি না আগে বারবনিতা ছিল! একটা ঘৃণ্য জীবন, যাকে কি না সমাজ ‘ঘেন্না’ বলে দেগে দিচ্ছে। যার জন্য দায়ী উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা থিয়েটারে পুরুষতন্ত্র। এরপরের সংলাপ ছিল: ‘এই মরদেহ- জলে ভেসে যায়, ছিঁড়ে খায় কুকুর শৃগাল! কিংবা চিতাভস্ম পবন উড়ায়। এই নারী- এর‌ও এই পরিণাম এই নশ্বর সংসারে, তবে হায়! প্রাণ দিছি কারে? কা‌র তরে শবে করি আলিঙ্গন। দারুণ বন্ধনে ছায়ায় মাতিয়া রাখি।’ এই সংলাপ বলতে প্রতিদিন আমার কষ্ট হত। আজ‌ও হয়। মনে হত, সামান্য একটা আকাঙ্ক্ষা, সেটুকু দিতে এত বাধা, এত আপত্তি!

Amar kotha
বিনোদিনীর আত্মজীবনী

অনেক আগে একটা কবিতা পড়েছিলাম- ‘নিঃসঙ্গতা’, কবি আবুল হাসানের লেখা। লাইনগুলো ছিল:

‘অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

………………………………………………

আরও পড়ুন অর্পণ দাস-এর লেখা: ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অবশেষে ‘খোদাই’ হল বিনোদিনীর নাম

………………………………………………

আমার পড়ে মনে হয়েছিল, মেয়েটির চাওয়াগুলো কত কম, আবার কতটা বিরাট মাপের! আমার চোখে যা ছোট চাওয়া, ব্যক্তিমানুষের আকাঙ্ক্ষায় সেই চাওয়া কত বড় হয়ে যায়। নটী বিনোদিনীর নিজের নামে থিয়েটার চাওয়া হয়তো সেই সময়ে সমাজের চোখে ছিল সামান্য, কিন্তু তার আদপে ছিল অসামান্য এক আকাঙ্ক্ষা। সেই চাওয়াকে আজ যে আমরা সম্মান দিতে পারলাম, মর্যাদা দিতে পারলাম, সেটাই বড় কথা।

File:Binodini Dasi - Mohila Press.jpg - Wikipedia

এই নামকরণের মধ্য দিয়ে একটা নতুন পথ উন্মোচিত হল, যে পথে হেঁটে, বিনোদিনী থিয়েটারে আর‌ও বেশি বেশি করে নাটক অভিনয় মঞ্চস্থ করার দাবি আমরা জানাতে পারি। নানা ধরনের নাটকের চর্চা ওই মঞ্চে হোক। আমরা জানি, গিরিশ ঘোষ বিনোদিনীকে চার্লস ডিকেন্সের আত্মজীবনী পড়িয়েছিলেন। বিনোদিনী নিজে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। চেয়েছিলেন, সে-ব‌ইয়ে ভূমিকা লিখুক তাঁর মাস্টারমশাই গিরিশ ঘোষ। গিরিশ ঘোষ তা লিখেছিলেন কিন্তু অন্যভাবে। সবমিলিয়ে একটা উন্মুক্ত পরিসর, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেছেন বিনোদিনী। তাঁর সাধের সেই থিয়েটার নাট্যকলা চর্চার এক উৎকর্ষ কেন্দ্রে পরিণত হোক, সেই আলোড়ন সৃষ্টি হোক বঙ্গজীবনে, এই আশা রাখি।

………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………….