সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বলছেন, ‘ওরা আমাদের দেশে ঢুকে সাধারণ মানুষ হত্যা করবে আর আমাদের কমেডিয়ান ওদের রগড়ে দিলেই দোষ? অন্য সময় তো এ-দেশের কমেডিয়ানদের খুব চোখের জল পড়ে, এখন তারা কোথায়?’– ক্ষোভ-উদ্গীরণের এই চেনা ন্যারেটিভ ভীষণ নর্মালাইজ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার চুলোচুলি অথবা ঘরোয়া আড্ডায়। তা অবশ্যই জায়েজ। অথচ আপনি যে একজন মানুষের আত্মার আগুপিছু না জেনে, না শুনে, ‘ওদের’ দলে ভিড়িয়ে দিলেন কী অনায়াসে, অপরাধবোধহীন হয়ে, ফলস্বরূপ অ্যাড্রিনালিন রাশ ছাড়া আর কিছু হবে কি? কেউ একবারও ভাবলেন না, একজন ভারতীয় স্ট্যান্ড-আপ কমিকের শো দেখতে এসেছিল সে। হাসতে এসেছিল। যে সংস্কৃতির বিনিময় স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, তা বড়ই থ্রেটের মতো শোনায়! ভয় করে।
কোন কথাতে হাসতে হবে আর কোন কথায় হাসতে হবে না– এ-নিয়ে রাষ্ট্র দুর্দান্ত কিছু আনঅফিশিয়াল নিদান দিয়েছে ঢের দিন হল। কেউ গ্রহণ করেছে সাদরে। কেউ-বা করেনি। যারা করেনি, তাদের যেমন দুমদাম গ্রেফতার করা যায়, ভাঙচুর করা যায় স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শোয়ের স্টুডিও আর অবলীলায় বলা যায়– মেরে দেব, আয় কেটে দেব, তেমনই যারা রাষ্ট্রের নিদান অনুযায়ী হাসে, কাঁদে কিংবা গান গায়, তাদের একজনের দলিত কিশোরের গায়ে কোনও উচ্চবর্ণ হিসি করে দিলে খুব হাসি পায়। মসজিদের সামনে ডিজে বাজিয়ে গেরুয়া পতাকার উদ্দাম নৃত্য দেখলে মস্তি হয় হেবি। চাকরিহারা অর্ধনগ্ন শিক্ষকেরা শহরের রাস্তায় হাঁটলে, চেতনা-চৈতন্য থেকে উপচে পড়ে হাহা রিয়্যাকশন। কী অপূর্ব মানুষ হয়েছি আমরা, মশাই! সম্প্রতি, এক ভারতীয় কমেডিয়ান গৌরব গুপ্ত, মার্কিন-মুলুকে একটি স্ট্যান্ড-আপ কমেডির শো করেছেন। ক্রাউড ওয়ার্কের মুহূর্তে, দর্শকদের মধ্যে থেকেই একজনকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’, লোকটি উত্তর দেয়, পাকিস্তান। তৎক্ষণাৎ কিছু-সংখ্যক দর্শক উসখুস করে ওঠেন আর অস্ফুটে বলেন, ‘সিঁদুর, সিঁদুর!’ তারপর সেই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে গৌরব গুপ্ত বলেন, ‘আসুন, এইবার আপনি হনুমান চালিশা পাঠ করুন।’
এমতাবস্থায় লেখক এবং স্ট্যান্ড-আপ কমিক বরুন গ্রোভারের একটি সাক্ষাৎকারের কথাই বলি। যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কমেডির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কী? বরুণ গ্রোভার বলছেন, কমেডির মধ্যেই পলিটিক্যালি ইনকারেক্টনেসের বীজ পোঁতা আছে এবং তা প্ররোচিতভাবেই আছে। তাই মানুষের হাসি পায়। সাময়িক অস্বস্তি হলেও। তবে কমেডির অন্তর্গত রাজনীতি, রিগ্রেসিভ আর প্রগ্রেসিভ– দুই-ই হতে পারে। ভারত জুড়ে এই যে রিগ্রেসিভ পলিটিক্সের হইহল্লা, তা-ই ক্রমে ক্রমে নির্মাণ করেছে: ‘আসুন, এইবার আপনি হনুমান চালিশা পাঠ করুন’। কারণ, পহেলগামে নির্বিচারে হত্যার আগে, পাকিস্তানি জঙ্গি বলেছিল কলমা পাঠের কথা। যেন অ্যান আই ফর অ্যান আই! অতএব, ভারতীয় রাজনীতি মোটামুটি যে খাতে বইছে, গৌরব গুপ্ত সেই ভাষ্যই বহন করেছেন আমেরিকায় এবং সুযোগ পেয়ে একজন পাকিস্তানিকে রগড়ে দিয়েছেন। আহা রে! দেশপ্রেমের এহেন ভ্রান্ত অথচ গৌরবান্বিত জয়ধ্বজা দুরন্ত উড়তে দেখে নিশ্চয়ই কেউ বলবেন, এমনই তো হওয়া উচিত ছিল। কেউ বলবেন, আজ রগড়ে দিয়েছে, আগামিকাল পিষে দেব। সহজ সমীকরণ।
……………………………………..
ভারত-পাকিস্তান বিদ্বেষের বিষ আসলে সর্বত্র– রাষ্ট্র আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে। বাধ্য করছেন গৌরব গুপ্তও। অথচ তিনি একজন কমেডিয়ান। কমেডিয়ানের কাজ কি সংখ্যাগুরুর মতামতকে কমেডির মঞ্চে, সর্বসমক্ষে, প্রতিষ্ঠিত করা? মজাচ্ছলে?
……………………………………..
কিন্তু সমীকরণ তত ‘সহজ’ নয়। চায়ের দোকানে এহেন মজা চলে, একের সঙ্গে একের সংলাপেও মজা বোধহয় ততখানিই! বৃহত্তর ক্ষেত্রে, যেমন একটি স্ট্যান্ড-আপ কমেডির প্রেক্ষাগৃহে, সে মজা আর ততখানি মজা নয়। কারণ সেখানে জড়িয়ে গেছে অডিয়েন্স, টিকিটের মূল্য, সর্বোপরি এন্টারটেইনমেন্ট। পাকিস্তানের কোনও নাগরিক দেখামাত্রই, ‘আয় তোকে হনুমান চালিশা পাঠ করাই’ বলাটাও কোনওরকম মজা নয়, তা একটি অসংবেদনশীল মন্তব্য়, মানতেই হবে। অবশ্যই ‘কৌতুক’-এর পাল্লায় পড়ে মানুষ বেজায় চটবে, বিরক্ত হবে, ক্রোধে ফুঁসে উঠে স্টুডিও ভেঙে দেবে, কিংবা সমূলে হিলে যাবে যাবতীয় বিশ্বাস– তবু এ কেমন কৌতুক! যেখানে একজন কমেডিয়ান ‘তৃতীয় চোখ’-এর দৃষ্টি থেকে সরাসরি নেমে এলেন ব্যক্তি-পরিসরে। আমেরিকায় দাঁড়িয়ে, গৌরব গুপ্ত আখেরে হনুমান চালিশার অবমূল্যায়ন করলেন না? একুশ শতকে এতই কি ঠুনকো হয়েছে আমাদের ভক্তি?
ব্যক্তির আত্ম-পরিচয়, দেশ এবং রাষ্ট্র– পৃথক করতে শিখিনি এখনও। যদি শিখতে পারতাম, তাহলে বুঝতাম, পাকিস্তান রাষ্ট্রের কুৎসিত ক্রিয়াকলাপের দায় নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাই বলে কি সে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন? উঁহু। একেবারেই নয়। তবু, একটি স্বাধীন আত্ম-পরিচয় সে বহন করে। সেই আত্ম-পরিচয়ের জোরেই কিন্তু হাজির হয়েছিল একটি কমেডি শো-তে। বিদেশের মাটিতে। হয়তো আর পাঁচজনও তাকে রগড়ে দেবে এরপরে। কমেডিয়ান গৌরব গুপ্তর মতোই বলবে, কাশ্মীর তোদের হবে না, তবু যে কেন বারবার হানা দিস তোরা। ইত্যাদি। ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বলছেন, ‘ওরা আমাদের দেশে ঢুকে সাধারণ মানুষ হত্যা করবে আর আমাদের কমেডিয়ান ওদের রগড়ে দিলেই দোষ? অন্য সময় তো এ-দেশের কমেডিয়ানদের খুব চোখের জল পড়ে, এখন তারা কোথায়?’– ক্ষোভ-উদ্গীরণের এই চেনা ন্যারেটিভ ভীষণ নর্মালাইজ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার চুলোচুলি অথবা ঘরোয়া আড্ডায়। তা অবশ্যই জায়েজ। অথচ আপনি যে একজন মানুষের আত্মার আগুপিছু না জেনে, না শুনে, ‘ওদের’ দলে ভিড়িয়ে দিলেন কী অনায়াসে, অপরাধবোধহীন হয়ে, ফলস্বরূপ অ্যাড্রিনালিন রাশ ছাড়া আর কিছু হবে কি? কেউ একবারও ভাবলেন না, একজন ভারতীয় স্ট্যান্ড-আপ কমিকের শো দেখতে এসেছিল সে। হাসতে এসেছিল। যে সংস্কৃতির বিনিময় স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, তা বড়ই থ্রেটের মতো শোনায়! ভয় করে।
ভারত-পাকিস্তান বিদ্বেষের বিষ আসলে সর্বত্র– রাষ্ট্র আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে। বাধ্য করছেন গৌরব গুপ্তও। অথচ তিনি একজন কমেডিয়ান। কমেডিয়ানের কাজ কি সংখ্যাগুরুর মতামতকে কমেডির মঞ্চে, সর্বসমক্ষে, প্রতিষ্ঠিত করা? মজাচ্ছলে? বছর পাঁচেক আগের কথা। কুণাল কামরা অর্ণব গোস্বামী টাস্ল। মাঝ-আকাশে! বহু মানুষই বলবেন, অর্ণব গোস্বামীকে কড়কে দেওয়ারই উচিত। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিস্তর কার্যকারণ উপস্থিত। আপনিও জানেন। আমিও জানি। এও জানি, একজন কমেডিয়ানের যে কাজটি করা উচিত ছিল সময়ের দাবিতে, কুণাল কামরা তার চেয়েও বেশি করেছিলেন। সগৌরবে, শুধু কমেডিয়ান না, অ্যাক্টিভিস্ট কমেডিয়ান হিসেবে।
কমেডিয়ানের পূর্বপুরুষ বলতে জেনেছি, বিদূষক। যে রাজাকে হাসায়। প্রয়োজনে নিন্দাও করে। কৌতুকের ঢঙে। মনে হয়, সাম্প্রতিক সময়ে একজন কমেডিয়ান অনেকখানি কার্টুনিস্টের প্রতিরূপ। এক ধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চিন্তা-চেতনার আচ্ছন্ন যাঁরা। তাঁদের জোকসে, আকারে, ইঙ্গিতে, মানুষ হাসছে, সমান্তরালে, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনেতার ক্রিয়াকলাপ, নিরবচ্ছিন্নভাবে নিন্দা করে চলেছেন, যেন নিন্দা করে যাওয়াটাই এই সময়ের কর্তব্য! কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তী, বাংলার জনপ্রিয় রাজনৈতিক কার্টুনিস্টদের শেষ প্রতিনিধি যিনি, একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট আসলে একজন দূতের মতো। দূত কত অপ্রিয়, মর্মান্তিক খবর বহন করে আনে, তবু দূতকে প্রাণে মারতে নেই। একজন কমেডিয়ান উত্তর-আধুনিক দূত। দুটো লোক তুমুল মারপিট করছে, একজন কমেডিয়ান সেই ঘটনাই বর্ণনা করবেন কিন্তু একটি তৃতীয় চোখ দিয়ে, যে আশ্চর্য দৃষ্টি আমাদের, সাধারণের নেই।
গৌরব গুপ্তর দৃষ্টি বড় সাধারণ। সাধারণ যেভাবে ‘অপারেশান সিঁদুর’ নিয়ে উদ্বেলিত এখনও, সাধারণ যেভাবে রাষ্ট্রেরই দেখানো পথে ‘অপারেশান সিঁদুর’-কে বাজারি করেছে, বাড়ির ইলেকট্রিক বিল অথবা পেট্রোল পাম্প যেভাবে সিঁদুরে ছয়লাপ, গৌরব গুপ্ত সে-সবের চেয়ে একধাপ এগিয়েছেন মাত্র। ‘দূত’ হয়ে উঠতে পারেননি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved