কৃষি ও কৃষিসভ্যতার বীজ নারীশক্তির হাতেই বিকশিত হয়েছিল। ধারাকথন এখনও বুকে ধরে রেখেছে জনজাতিদের করম পার্বণ। কী সেই প্রমাণ?– পরবের আচার-প্রক্রিয়ার সংগীত। নারীরা ফল-মূল সংগ্রহ করতে গভীর অরণ্যে গিয়েছিল। সেখান থেকে তারা নিয়ে এসেছিল কিছু শস্য বীজ। তারপর সেগুলি তারা বসতির কাছাকাছি কোথাও মাটির নিচে রেখেছিল। বর্ষা শেষে তারা দেখল, সেখানে বীজগুলির অঙ্কুরোদ্গম ঘটেছে। সেই প্রাণশক্তির বিকাশ দেখে তারা এতটাই উদ্বেলিত হয়েছিল যে তারা নাচতে থাকে। গাইতে থাকে।
বড় অস্থির সময়। এক দ্বেষের দোষকালে আমরা পতিত। প্রতিদিন প্রশ্ন আত্মার কাছে, সেই অজর-অমর-অব্রনের কাছে। সেই অযোনিজ নিজের কাছে। বাইরে যে সব প্রশ্ন ঘুরছে, তার বাইরেও প্রশ্ন আছে। আছে ভিন্ন ন্যারেটিভ। একটি আপাত নিরপেক্ষ ভাবনাও আছে। আর কতটা পথ পেরলে আক্ষরিক ‘আধুনিক’ হব, না কি যে প্রাচীনকে তাচ্ছিল্য করে পিছনে ফেলে এসেছি সেখানেই ছিল সমাজশিক্ষার প্রকৃত বীজ। আমরা আকাশমুখে চাইতে গিয়ে সেই শিকড় থেকে বহু বহু দূরে এসে আজ কানাগলিতে ঢুকে পড়েছি। একটি প্রসঙ্গে বিশ্বকবি সখেদে বাহন আর বহনের যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছিলেন। ভয়ার্ত পরিবেশে আজ সেই প্রশ্নই এক অন্য চেহারায় ধরা দিচ্ছে। আধুনিকতাকেও কি আমরা শুধুই বহন করছি না? নাহ্, বিশ্বাস করুন আমি কোনও দার্শনিক নই, একটি সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাবনার কথা শুধু প্রকাশ করতে চেয়েছি। এবার এক অনাস্বাদিত প্রেক্ষাপটে এসেছে করম পরব। হ্যাঁ, কালোকেলো, আধুনিকতার ছোঁয়াচবিহীন প্রান্তজনদের করম পরব। বিজাতীয় ভাষায় গান, মহুয়ার গন্ধমাখা কয়েকটা দিন, গাছপুজোর দিন। কিন্তু বিপদ এই হল যে, সেই গাছের শিকড়, ফল, পাতা, ফুল এমনকী, কাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক তন্ত্র, এক দর্শন, এক অনন্য সমাজব্যবস্থার বর্ণময় খতিয়ান। সভ্য সমাজ থেকে বহু দূরে সেখানে সভ্যতার প্রাত্যহিক জয়ঘোষ ধ্বনিত হয়। সামাজিক মাধ্যমকে নখদর্পণে রাখা আধুনিক সেখানে এখনও পৌঁছতে পারেননি। বিচারের বাণীসমৃদ্ধ উদ্বেল রাজপথ সে সভ্যতার পথের সঙ্গে স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ করে বসেছে। এক অবিচ্ছিন্ন সত্তার হরগৌরী মিলনের পথ, পারস্পারিক সম্ভ্রমের পথ আজ রুদ্ধ। এক যৌথখামারের সভ্যতা আজ সভ্যদের সমাজে শুধুই সাবের থেকেও সাব-অলটার্ন চর্চার আধুনিক অভ্যাসে পর্যবসিত।
কৃষি ও কৃষিসভ্যতার বীজ নারীশক্তির হাতেই বিকশিত হয়েছিল। এর প্রামাণ্য নথি কোনও ইতিহাস গ্রন্থ উচ্চারণ না করলেও বহুতর গবেষণা জোরাল দাবি রেখেছে। তার ধারাকথন এখনও বুকে ধরে রেখেছে জনজাতিদের করম পার্বণ। কী সেই প্রমাণ?– পরবের আচার-প্রক্রিয়ার সংগীত। সেই সংগীতে কী বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে, নারীরা ফল-মূল সংগ্রহ করতে গভীর অরণ্যে গিয়েছিল। সেখান থেকে তারা নিয়ে এসেছিল কিছু শস্য বীজ। তারপর সেগুলি তারা বসতির কাছাকাছি কোথাও মাটির নিচে রেখেছিল। বর্ষা শেষে তারা দেখল, সেখানে বীজগুলির অঙ্কুরোদ্গম ঘটেছে। সেই প্রাণশক্তির বিকাশ দেখে তারা এতটাই উদ্বেলিত হয়েছিল যে তারা নাচতে থাকে। গাইতে থাকে। সেই প্রাণশক্তির উন্মেষের স্মরণকালের উদযাপনের দিবসই, করম পরব। যা আজও স্বমহিমায় প্রবহমান, বংশপরম্পরায় জঙ্গম। জঙ্গলমহল, ছোটনাগপুরের জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে এই পরব পালিত হয়ে আসছে সুদূরের কাল থেকে। এই সেই করম পরব যেখানে নারীরাই একচ্ছত্র, প্রাণশক্তি আবহনের নৈণায়িক ঋত্বিক। মূল পরবের দিন– যে দিন চারাকে (শস্য) পুজো করা হয়, তার সাত দিন আগে শুরু হয় পার্বণ-রীতি। প্রথম দিন মেয়েরা দলবেঁধে নদী বা জলাধারে স্নান শেষে বালি ভর্তি ডালিতে (বাঁশের ঝুড়ি) সাত বা নয় প্রজাতির শস্যবীজ রোপণ করেন। এরপর সেই ডালি (জাওয়া ডালি) ঘিরে প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় চলে করমগীত ও নৃত্য। এক একটি দলে ১০, ১২ বা ১৫ জন থাকে। যা এক যূথবদ্ধতার ছবি, নারীভুবনের বিকাশের ইতিকথা। এক, দুই বা তিন জনকে নিয়ে জাওয়া-গীতের দল হয় না। যা ইঙ্গিত দেয়, কৃষি সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই যৌথখামারের কথা বলে এসেছেন নারীরা।
বীজ বোনার প্রথম দিন থেকে পরবের শেষ দিন পর্যন্ত মেয়েরা একে অপরের হাত ধরে নৃত্য করেন। আজকের দিনের মানববন্ধনের আদিচেহারা বলাই যায়। আমরা শুধু শুরুর কাল থেকে এখনও তাকে ওই নামে ডাকিনি, এখনও দিইনি স্বীকৃতি। কারণ, মানববন্ধনে মিশে আছে আধুনিকতার স্বরারোপ। তাকে অচ্ছুতের সরণির সঙ্গে জুড়ে দিলে শব্দের আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু অর্থের? অনুভূতির? নাহ্, সে প্রশ্ন সুবেশ, সুললিত স্বরক্ষেপণের আধুনিক বিশ্বে আলোচ্য নয়। ওই যে বহন আর বাহনের সনাতন প্রশ্নের কথা আগেই বলেছি।
আর জি কর কাণ্ডের পর পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বর পথে নেমেছিল। যে অন্ধকার নারীর সনাতন ভয়ের কাল, যে রাত তাঁর কাছে শুধুই কালো, সেই ভয়কেই সে জয় করার ডাক হেঁকেছিল। কী আশ্চর্য যা তাঁর স্বাভাবিক প্রাপ্তি, সংবিধানিক অর্জন এখন তাই পেতে চেয়ে পথ খুঁজতে হচ্ছে! অথচ অসভ্য, আধুনিক শব্দের অর্থ না-জানা জনজাতিদের সমাজ এখনও মাতৃতান্ত্রিক। ভালো করে বুঝতে হবে, এ কোনও লিঙ্গতন্ত্র বা লিঙ্গবৈষম্য ও সাম্যের ন্যারেটিভ নয়। আদিবাসী সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। নারী ও পুরুষ চিহ্নের ধারেকাছে না গিয়ে নারীকে ‘মা’, ‘ধাত্রী’ করে ধরিত্রীর আদিবাসীরা তাকেই তন্ত্র করেছে। আধুনিকতার ন্যারেটিভ চর্চায় অবশ্যই প্রশ্ন আসবে নারী মা হচ্ছেন কেমন করে, সেই তো পুরুষ চাই। হ্যাঁ, চাই। কিন্তু সেটা পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে হয় না। অর্থাৎ আধিপত্যের ন্যারেটিভ থাকে না। নারীর সামাজিক অধিকার বোধেই সেই সঙ্গ বা আসঙ্গ নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরুষ বা নারী দু’-পক্ষের স্বাধীন মতামতের উপরে তা দাঁড়িয়ে থাকে। আর তা নির্ধারিত মাতৃতন্ত্রের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়। যাঁরা ভ্রু কোঁচকাবেন, ভাববেন এক ভিন্ন রকমের সাব-অল্টার্ন ন্যারেটিভ চলছে তাঁদের বলব, মহাভারতের (ব্যাসকৃত) সময়কার নারীর অবস্থানকে একটু স্মরণ করুন। রাজা পুরুষ হলেও নারীর মাতৃত্ব, তাঁর নিখাদ শরীরকেন্দ্রিক বা বিবাহকেন্দ্রিক স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন।
আদিবাসী সমাজে পরিবারের দায়-দায়িত্ব মাতৃতন্ত্রের হাতেই ন্যস্ত। এ কারণে খুন-ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের সংখ্যাও নিতান্তই কম। পণপ্রথাও নেই এই সামাজিক কাঠামোয়। মজাটা তখন হয় যখন এই আদিবাসীরাই তাঁর সমাজের বাইরের আধুনিক পৃথিবীর একজন হয়ে ওঠার অভ্যাস লালন করেন। অনেক ক্ষেত্রে যেসব আদিবাসী পরিবারে আর্থিক সংগতি বাড়ছে, সেইসব পরিবার ক্রমে নিজেদের ‘ভদ্র’ ভাবার দর্শনে আত্মনিয়োগ করছে। তাতেই সর্বনাশ ঘটছে। নবীন ধারায় অভ্যস্ত হওয়ার প্রথম শর্ত হয়ে উঠছে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারবাদকে বাদ করে দেওয়া। সামাজিক নিয়মে জেগে উঠছে অতি-পুরুষতন্ত্রবাদ। কালসর্পের মতো ঢুকে পড়ছে নারী নির্যাতন বিকৃতযৌনতা। আপাতভাবে মনে হবে, অতিসরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। মাতৃতন্ত্রই একমাত্র নারীর রক্ষাকর্তা, এমন ম্যানিফেস্টেশন চলছে। নাহ্, আসলে বিষয়টা দেখার। আদিবাসী সমাজদর্শন থেকেও বেশি করে শিকড় বিচ্ছিন্ন হওয়াটা উপলব্ধি করার। পারিবারিক ও সামাজিক বৃত্তের মধ্যে কেমন করে পুরুষের মানুষ হয়ে ওঠার প্রবণতা নষ্ট হচ্ছে, কেমন করে নারী ভোগবাদী দর্শনের কাঠের পুতুল হয়ে নিজেই পণ্য হয়ে যাচ্ছেন, তাঁর গরিমা হারাচ্ছেন, সেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার। এদেশের আধুনিকতার সঙ্গে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের আধুনিকতার তফাতকে বোঝার। সে তফাতকে গড়ে দিতে পারে সমাজের সাবেক শেকড়। আদিবাসী সমাজে যৌনতার বর্ণময় উদযাপনও নেই, আবার তা নিয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড়ও নেই। যে করম উৎসবের কথা বলতে এত আয়োজন, তা আসলে উর্বরতার উৎসব, নতুন প্রাণের সঞ্চার ও তাতে নারীর জয়ঘোষ ধ্বনিত করার উৎসব। আবারও ফিরে যাব, মহাভারতে (ব্যাসকৃত)। সেখানে দেখব, প্রান্তিক রমণী হিড়িম্বা বা উলূপী অনবদ্য সাবলীলতায় অর্জুন বা ভীমের কাছে সঙ্গম প্রত্যাশা করেন। মাতৃত্বও চান কিন্তু স্বামীত্বের দাবি তেমন প্রবল নয়। মহাভারত কাল পুরুষের আধিপত্যের, না মাতৃতন্ত্রের– সেসব কূটতর্ক আলোচ্য নয়। আলোচ্য ভেবে দেখার, ত্রুটিটা কোথায় হয়ে গেল, আধুনিকতাকে বহন করছি না বাহন করার জন্য সক্ষম হয়েছি মাত্র।
একেবারে শেষে দু’টি সিনেমার কথা বলব। জেমস ক্যামেরনের ‘অবতার’ সিনেমার সেই দৃশ্যকে স্মরণ করতে হবে, যেখানে এক প্রাচীন বৃক্ষের ডালপালা থেকে জীয়নশক্তি, স্মৃতি পাওয়া যায়। আর কল্কি সিনেমার কথা ভেবে দেখতে হবে, যেখানে সম্ভালাতে প্রাচীন বৃক্ষই নিয়ন্ত্রক। দুই জায়গাতেই দুই প্রবীণা নারীর উপস্থিতি স্মরণ করে দেখা প্রয়োজন। কীসের রূপক সেই বৃক্ষেরা, কীসের রূপক নারী, কোথায় গিয়ে করম প্রাসঙ্গিক। অন্তত দহন দিনে সভ্যতার সাজানো ড্রইংরুমে এবং আন্দোলিত রাজপথে সেই চর্চা হোক।
………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved