‘ছুরি’ কেন সলমান রুশদি লিখলেন? কেননা তিনি তাঁর উপর এই মর্মান্তিক শারীরিক অত্যাচার এবং সন্ত্রাসের উত্তর দিতে চান শিল্পের মাধ্যমে: ‘আই ওয়ান্টেড টু আনসার ভায়োলেন্স উইথ আর্ট!’ এই কারণেই বইটি লেখার প্রয়োজন হয়েছিল। ‘ইট ওয়াজ আ নেসেসারি বুক ফর মি টু রাইট’। এমন একটা বই লেখা খুব সহজ কাজ নয়, যে-বইতে নেই কোনও ঘৃণা, কোনও বিদ্বেষ, ছুরির আঘাতে ছুরি!
‘এমন একটি বই লেখা পৃথিবীর সহজতম কাজ নয়। কিন্তু এই বইটি আমাকে লিখতেই হবে। কেননা এই বইটির বিষয়কে আমি যদি পিছনে ফেলে আসতে পারি, সামনের কোনও লেখা আমি লিখতেই পারব না। শুধু লেখা কেন, এই বিষয়ে লেখাটি না লিখে জীবনে অন্য কোনও কাজও করতে পারব না। এই বইয়ের বিষয়টি আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। ওকে পিছনে ফেলে আমাকে সামনে এগোতে হবে। আই নিড টু গেট পাস্ট ইন অর্ডার টু ডু এনিথিং এল্স’। সম্প্রতি জানিয়েছেন সলমান রুশদি।
কয়েক মাস আগে এক সাহিত্যসভায় হঠাৎ একটি শাণিত ছুরির আঘাতে-আঘাতে রুশদির শরীর ক্ষতবিক্ষত করে তাঁর জীবন উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণ এক ধর্মান্ধ মৌলবাদী যুবকের, যে চেয়েছিল ছুরি দিয়ে উপড়ে নিতে রুশদির চোখ, তাঁর হৃৎপিণ্ড, তাঁর কণ্ঠের উচ্চারণ। এই ছুরির আঘাতের ফলে সলমান হারিয়েছেন তাঁর ডান চোখ এবং তাঁর বাঁ হাতের কর্মক্ষমতা। সলমান রুশদি ঘোষণা করেছেন, তাঁর উপর এই অতর্কিত সন্ত্রাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি শ’-দুই পাতার আত্মকথন তিনি লিখেছেন। বইটির নাম রেখেছেন ‘নাইফ’। ‘নাইফ’ প্রকাশিত হবে ২০২৪-এর ১৬ এপ্রিল। এটি হবে তাঁর দ্বিতীয় আত্মকথন। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ২০১২-তে, ‘জোসেফ আন্তন’ নামে। পড়ার পরে মনে হয়েছিল, ‘আন্তন’ শব্দটির সঙ্গে মিশে আছে লেখকের আত্মার রণন!
‘ছুরি’ কেন সলমান রুশদি লিখলেন? কেননা তিনি তাঁর উপর এই মর্মান্তিক শারীরিক অত্যাচার এবং সন্ত্রাসের উত্তর দিতে চান শিল্পের মাধ্যমে: ‘আই ওয়ান্টেড টু আনসার ভায়োলেন্স উইথ আর্ট!’ এই কারণেই বইটি লেখার প্রয়োজন হয়েছিল। ‘ইট ওয়াজ আ নেসেসারি বুক ফর মি টু রাইট’। এমন একটা বই লেখা খুব সহজ কাজ নয়, যে-বইতে নেই কোনও ঘৃণা, কোনও বিদ্বেষ, ছুরির আঘাতে ছুরি! এই বই লিখতে লিখতে ভুলে যাইনি, আমি এক সভ্য সমাজের মানুষ। আমি বড় হয়েছি এক অভিজাত সংস্কৃতি ও শিক্ষার পরিবেশে। তবে ‘ইট ইজ আ সিয়ারিং বুক’, বলেছেন রুশদি। ‘সিয়ারিং’ শব্দটির মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার তির্যকতা! এই বই তীব্র আবেগের। বহন করছে হৃদয়ের তাপ। ছ্যাঁকা দেবে। পোড়াবে। ‘আমার ওপর যা ঘটেছে সেটাকে বাগে আনতে লিখতেই হল ‘নাইফ’– ‘আ ওয়ে টু চেক চার্জ অফ হোয়াট হ্যাপেন্ড,’ বলেছেন রুশদি।
আরও দু’টি খুব দামি কথা বলেছেন রুশদি। এক, ‘‘দিস বুক উইল রিকাউন্ট দ্য অথর’স এক্সপেরিয়েন্স অফ সারভাইভিং দ্য অ্যাটেম্পট অন হিজ লাইফ।’’ দুই, ‘দিস সিয়ারিং বুক ইজ আ রিমাইন্ডার অফ দ্য পাওয়ার অফ ওয়াডর্স টু মেক সেন্স অফ দ্য আনথিংকেব্ল।’’
রুশদি যা বলেছেন, বাংলায় তার অর্থ: এই আত্মকথনে আমি রচনা করেছি শব্দের সেই অবিকল্প প্রসার এবং প্রকাশ-ক্ষমতা, যা অভাবনীয়কে করে তুলেছে ভাবনীয় এবং বোধযোগ্য। সাহিত্যসভায় রক্তপাত এবং খুনের চেষ্টা! সত্যিই তো অভাবনীয়, বোধের অতীত এক ঘটনা! তবু ঘটল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান ও ব্যাখ্যায় রুশদির ‘নাইফ’, যা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করবে ছুরির থেকে শব্দের শান, ভাবার ক্ষমতা অনেক বেশি। রুশদি লিখেছেন ‘ছুরি’-তে: আমি একা রুখে দাঁড়িয়েছি অসংখ্য ত্রাসের বিরুদ্ধে। আবার ‘হাইডিং আফটার মাল্টিপ্ল থ্রেটস’, ভয়ে পালিয়েছি, লুকিয়ে থেকেছি। শুধু মনে রাখবেন, ব্যক্তি স্বাধীনতার যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছি।
সলমান রুশদির ‘ছুরি’ প্রসঙ্গে আরও একটি জরুরি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেই কথাটি হল, সাহিত্যসভায় ছুরির আঘাত ও রক্তপাত অভাবনীয় ঘটনা বটে, কিন্তু সাহিত্যে ছুরি এসেছে বারবার। প্রাচীন গ্রিক নাটকে ইডিপাস যে-দৃশ্যে নিজের চোখ উপড়ে ফেলছে, সে দৃশ্যে ছুরি না থাকলেও আছে ছুরির মতোই ধারালো আঁকশি! আর শেক্সপিয়র-এর ম্যাকবেথ-এ লেডি ম্যাকবেথের এই উচ্চারণ পৃথিবী কি কখনও ভুলবে? ‘অল দ্য পারফিউমস অফ আরেবিয়া উইল নট সুইটেন দিজ লিটল হ্যান্ডস!’ আরবের সমস্ত সুগন্ধিও মুছে দিতে পারবে না আমার হাতে রক্তের গন্ধ। সেই রক্তপাত তো ঘটিয়েছে আমারই ছুরি– যে-ছুরি দিয়ে আমি খুন করেছি। আর সেই ছুরি থেকে মুক্তি নেই ম্যাকবেথের। যে-ছুরি দিয়ে ম্যাকবেথ খুন করেছে, সেই ছুরি ভেসে ওঠে তার অবচেতন মন থেকে চোখের সামনে, তাকে তাড়া করে বেড়ায়। শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকে হ্যামলেটের হাতে ‘ড্যাগার’ বা ছুরির প্রতীকী, সংকেতময় ব্যবহার– তা কি কখনও ভোলা যায়? এই ছুরি হ্যামলেটের বুদ্ধিমত্তার, ইন্টেলেক্টের, এবং জীবনযুদ্ধের সংকেত বহন করছে। একইসঙ্গে এই ছুরি হয়ে ওঠে হ্যামলেটের অভিমান ও ক্রোধের প্রতীক। এবং হ্যামলেটের মুখে তার মা ও প্রেমিকার উদ্দেশে যে তীব্র ভাষা ব্যবহার করেছেন শেক্সপিয়র, তার তুলনাও তিনি করেছেন নিজেই ড্যাগারের সঙ্গে!
‘হ্যামলেট’ সিনেমায় এক অনন্য দৃশ্যে হ্যামলেটের ভূমিকায় স্যর লরেন্স অলিভিয়ের ছুরি হাতে একা দাঁড়ান এলসিনোর দুর্গের নিঃসঙ্গ শীর্ষে। নীচে বিছিয়ে আছে সমুদ্র। জীবনসমস্যার প্রতীক হয়ে। হ্যামলেটের হাত থেকে হঠাৎ খসে পড়ে ছুরি! তলিয়ে যায় সমুদ্রের তোলপাড়ে। এই দৃশ্যেই হ্যামলেটের মুখে সেই মৃত্যুহীন স্বগতোক্তি: ‘টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’। জীবনের সমস্যা সামলাতে, জীবনকে বুঝতে যা কাজে লাগে, তা ছুরি নয়, ছুরির ধার নয়– চাই বুদ্ধির শান, বোধের গভীরতা, ছুরির পরিবর্তে। এই বার্তাটুকু দিয়ে গেছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র, হ্যামলেটের হাত থেকে খসে পড়া ছুরির সংকেতে। একই বার্তা থাকবে রুশদির ‘নাইফ’-এও। ততক্ষণই ছুরির প্রয়োজন যতক্ষণ আমাদের মধ্যে কাজ করবে অশিক্ষার অন্ধকার, অন্ধবিশ্বাসের তাড়না, মগজ ধোলাইয়ের প্রেরণা। ভারি সুন্দর বলেছেন রুশদি। ‘‘আমি ‘নাইফ’ লিখেছি সন্ত্রাসের উত্তর শিল্পের মাধ্যমে দিতে। এই ছুরি শানিত শুভ বুদ্ধির, সংস্কারমুক্ত, ধর্মান্ধতাবিহীন ইন্টেলেক্টের!’’