মুখখারাপ করা কিছু নতুন নয়। পরিবেশ-পরিসর মেনে, আশপাশ আলগা থাকলে, এ জিনিস লিঙ্গনিরপেক্ষভাবে অনেকেই করে থাকেন। যাঁরা করেন না, তাঁরা নেহাতই ভদ্রজন। কিন্তু জনপরিসরে, নেহাত দুর্বিপাকে না পড়লে, চট করে এসব বাংলা ভাষা বেরয় না। আজকের রাজনীতিতে, ২০২৪-এর প্রথম মাস যখন রিটায়ার করতে চলেছে, রাজনীতি আর অপভাষার যে পুরনো বন্ধুত্ব, তাকে ফের লেপের তলা থেকে ডেকে তোলা হল।
রাজনৈতিক নেতাদের অপশব্দ প্রয়োগ এখন একটি নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু বাংলার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যে ভাষায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করলেন, তাতে বিতর্কটা আর শুধু অপশব্দ প্রয়োগে সীমাবদ্ধ নেই। অপরাধ জগতের ভাষাও রাজনীতিতে ঢুকে পড়ল কি না, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এই বিতর্কে ইতিমধ্যে শামিল হয়ে গিয়েছেন ভাষাবিদরাও।
রাহুলের প্রতি শুভেন্দুর প্রয়োগ করা ‘গাণ্ডু’ শব্দটি বাংলা ভাষায় শুধুমাত্র ভদ্র-রুচিবিরুদ্ধ গোত্রের মধ্যেই পড়ে না, নিশ্চিত করেই এটা একটি অশ্লীল বা অশালীন শব্দও। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেল শুভেন্দুকে সাংবাদিকরা রাহুলের ন্যায় যাত্রা নিয়ে নিরীহ প্রশ্ন করছিলেন। মুখে একরাশ বিরক্তি এনে শুভেন্দু বলে ফেললেন, ‘গত চারদিন ধরে রাহুল গান্ধী, রাহুল গান্ধী করে যাচ্ছেন। কে হরিদাস পাল! একটা গাণ্ডু!’
মনের জ্বালা বা অতিষ্ঠতা থেকে মুক্তি পেতেই ঠিক এই ভাবে সমাজের কোনও কোনও মহলে এইরকম অশালীন শব্দের প্রয়োগ হয়। আগে এই ধরনের গালাগাল ও অশালীন শব্দ সমাজ বিরোধী বা অপরাধ গোষ্ঠীর মধ্যেই শুধু শোনা যেত। এখন অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে। ছাত্র গোষ্ঠীর আড্ডায়, চায়ের দোকানে, পাড়ার ক্লাবে এইসব অশালীন শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভদ্র সমাজে ও টিভি ক্যামেরার সামনে একজন রাজনৈতিক নেতার মুখে এই শব্দের প্রয়োগ আজও আমাদের রাজ্যে অকল্পনীয়। এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে প্রকাশ্যে চার অক্ষরের শব্দ প্রয়োগ যে আর বিশেষ দূরে নেই, তা বোঝাই যাচ্ছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সমীর মণ্ডলের লেখা: কাঠ খোদাইয়ের কবি, আমার শিক্ষক হরেন দাস
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাহুল স্টোভের উপর কয়লা দিয়ে চা করার কথা বলেছিলেন বলেই তাঁকে ‘বোকা’ ইঙ্গিত করতে ‘গাণ্ডু’ শব্দের প্রয়োগ করেছিলেন নাকি! ‘গাণ্ডু’কে তিনি ‘বোকা’ অর্থে ব্যবহৃত কথ্যভাষা হিসেবে দাবিও করেছেন! ‘গাণ্ডু’ শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়ে ইতিমধ্যেই ভাষাবিদরা সংবাদমাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, এটির অর্থ শব্দটির ব্যবহারকারীদের কাছেও শুধু ‘বোকা’ নয়। হিন্দিতে ‘গাণ্ডু’ বলতে বোঝায় সমকামের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিটিকে। বাংলাতেও এই শব্দটির গঠনের মধ্যে পশ্চাৎদেশের ইঙ্গিত রয়েছে। এটা ঘটনা যে কথ্য ভাষা ও অশোভন শব্দের মধ্যে অনেক সময় বিভেদটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। অনেক অশোভন অপশব্দ শিষ্টভাষায় উন্নীত হয়েছে, সেই উদাহরণ রয়েছে। কারণ, ভাষা একটি চলমান বিষয়। কিন্তু ‘গাণ্ডু’ শব্দটি এখনও অন্তত বাংলায়, ভদ্র সমাজের কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত হয় না। ভাষাবিদরা বলছেন, এটি ব্যক্তিবিশেষের বা গোষ্ঠীবিশেষের হীন-উদ্দেশে ব্যবহার করা ইতর শব্দ হিসেবেই চিহ্নিত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেকারণে অপরাধীর ভাষাকে সহজবোধ্য কথ্য ভাষার তকমা লাগানোর চেষ্টাও নিন্দনীয়। ভাষাবিদদের মতেই ‘গাণ্ডু’ হল বাংলা ভাষার ‘অপরাধ জগতের শব্দকোষ’-এর অন্তর্ভুক্ত শব্দ। অধুনা সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মুখ দিয়েই। সেখানে অপশব্দ বা অশালীন শব্দ ব্যবহারে আমরা রক্ষণশীল থাকব কি থাকব না, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে নেতারা শব্দগুলো ব্যবহার করতে থাকলে অপরাধ গোষ্ঠীগুলিই উৎসাহ পেতে থাকে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাংলার রাজনীতিতে এই স্তরের অশালীন ভাষা একবার প্রয়োগ করেছিলেন সিপিএম নেতা অনিল বসু। রাজনৈতিক নেতারা যখন অশালীন শব্দ প্রয়োগ করেন তখন তা দ্রুত সমাজে বিস্তার লাভ করে। শুভেন্দু যে ওই প্রয়াত সিপিএম নেতার দ্বারা সংক্রমিত তা বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের মুখের ভাষা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। আবার ভাষার পরিবর্তন সমাজ ও সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলে। তাই অপরাধ জগতের ভাষা রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে দ্রুত সমাজে ছড়াতে থাকলে তা অপরাধ প্রবণতাকেই বাড়াতে সাহায্য করে বলে অভিমত সমাজবিজ্ঞানীদের। বিপদটা এই জায়গাতেই।
সেকারণে অপরাধীর ভাষাকে সহজবোধ্য কথ্য ভাষার তকমা লাগানোর চেষ্টাও নিন্দনীয়। ভাষাবিদদের মতে ‘গাণ্ডু’ হল বাংলা ভাষার ‘অপরাধ জগতের শব্দকোষ’-এর অন্তর্ভুক্ত শব্দ। অধুনা সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মুখ দিয়েই। সেখানে অপশব্দ বা অশালীন শব্দ ব্যবহারে আমরা রক্ষণশীল থাকব কি থাকব না, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, নেতারা শব্দগুলো ব্যবহার করতে থাকলে অপরাধ গোষ্ঠীগুলিই উৎসাহ পেতে থাকে।
কয়েক দিন আগে রাহুলও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে অপশব্দ প্রয়োগ করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। বিশ্বকাপে ভারত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারার পর মাঠে হাজির থাকা মোদিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘পনৌতি’ অর্থাৎ অপয়া। এই ভাষা প্রয়োগ অবশ্যই সমাজের পশ্চাৎপদ মানসিকতাকে উৎসাহ দেয়। যা ডেকে আনে কুসংস্কারের অন্ধকারকে। মোদি নিজেও বিধানসভা ভোটের প্রচারে রাজ্যে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুরুচিকরভাবে ‘দিদি’ সম্বোধন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। রাহুলকে যেভাবে বিজেপি নেতারা ‘পাপ্পু’ সম্বোধন করেন, তাও শিষ্টাচারের মধ্যে পারে না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সনাতন রুদ্র পালের সাক্ষাৎকার: যতদিন মূর্তি গড়া, ততদিনই কাজ শেখা, এখনও শিখছি
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সামগ্রিক রাজনীতিতে দেশ ও মানুষের সমস্যাগুলি ক্রমশ গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রশ্নে দলগুলির নীতির বিভেদরেখাটাও আবছা হয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন মানুষের নজর ও আবেগ কাড়তে নানা চমকের প্রয়োজন হচ্ছে, তেমন নেতারা পরস্পরের প্রতি আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে অপশব্দের ব্যবহার বাড়াচ্ছেন। বারবার মনে রাখতে হবে যে সমাজের অপরাধ গোষ্ঠী তাদের হতাশা ও রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে। অপরাধ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে সেই শব্দ আরও অনেকে বললেই কথ্যভাষা হয়ে যায় না।
শুভেন্দু যেভাবে তাঁর ভাষা প্রয়োগকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস করছেন তা উদ্বেগের। অনিল বসুকে দল থেকে সাজা পেতে হয়েছিল! নেতাদের অপশব্দ প্রয়োগ বন্ধে দলীয় সাজা দেওয়ার প্রথা চালু থাকা কিন্তু জরুরি। কংগ্রেস শুভেন্দুর বিরুদ্ধে আইনি পথে গিয়েছে। আইনি পথে এর বিধান কী হয়, তা নিয়ে নিশ্চিত বাঙালিসমাজের কৌতূহল থাকবে!