রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দেশ মানে একরৈখিক, অবিভাজ্য কিছু। তা যদি মেনেও নিই, আমরা নুসরত ফতেহ আলি খান, নায়রা নূর, আবিদা পারভিন, সাফকাত আমানত আলি, আতিফ আসলাম, আলি শেঠি কিংবা ব্যান্ড হিসেবে জল-এর কাছে অস্ত্র ধরার, হিংসা ছড়ানোর কিংবা ভারতকে কবজা করার কথা বলতে শুনেছি কি কখনও? শুনিনি এমন কোনও গান যাকে মৌলবাদ প্রচারের পথ হিসেবে তৈরি করেছেন তাঁরা। তাঁদের গান, তাঁদের কণ্ঠে যে বেদনার নিরাময় মিশে থাকে, তা বহুদিন ধরেই আমাদের ব্যক্তিগত শান্তিসূত্র। সেই সময় এই গানগুলো আমাদের কাঁদায়, থামায়, শান্ত করে। তাঁরা বহুকাল আমাদের ভিতর-দেশের নাগরিক, আমাদের অনুভবের পড়শি। কিন্তু এই ভিতর-দেশ তত বড় নয়, বিখ্যাতও নয়। অন্তত ভারত রাষ্ট্রের মতো নয় নিশ্চয়ই। না হলে উগ্রপন্থা আটকাতে গেলে গানও থামাতে হবে, এহেন সিদ্ধান্ত কি শান্তির বিরুদ্ধে নয়?
অতঃপর গান দিয়ে দ্বার খোলানোর দিন শেষ। এখন কান দিয়ে দ্বার খোলানোর যুগ বাওয়া– এমনই হেঁয়ালি চলছে। টার্গেট– প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আদনান সামি। কী হেতু? পহেলগাম অ্যাটাক পরবর্তী ভারতে পাকিস্তান-বিরোধিতার জিগিরে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে পাকিস্তানি শিল্পীদের যখন ধরে ধরে ব্যান করার ক্রিয়াকাণ্ডে কর্তনমুখর, তেমন সময়ে এই প্রাক্তন পাক-নাগরিক কি না তাঁর সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন নতুন ইয়ারফোন-সহ কর্ণপ্রজ্জ্বল এক সেলফি এবং সেই ইয়ারফোনের গায়ে রয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকার অলংকরণ ছাপ, যা তিনি নিজে কাস্টোমাইজ করিয়েছেন বিশ্বখ্যাত এক মার্কিন কোম্পানির থেকে, ভারতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের লাগি!
মিছে বলে কী লাভ, সেই ভালোবাসা তিনি কিঞ্চিৎ ‘শো-অফ’ই করেছেন। কিন্তু, সোশাল মিডিয়ায় এই প্রবণতাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। কে করে না শো-অফ? ফেক প্রোফাইলও নিজের ডিপি বদলায়! তাহলে কী দোষ করলেন সামি? ওই যে, জন্মসূত্রে পাকিস্তানি, লন্ডনে বেড়ে ওঠা এবং একাধারে পাকিস্তানি ও কানাডিয়ান পাসপোর্ট থাকা কোথাকার এই ব্যান্ডমাস্টার যে দেশপ্রেমের আলগা আদিখ্যেতা করছেন, বুঝতে কি আর বাকি আছে, এসব গা-বাঁচানোর চেষ্টা! তা সে হোক, যতই তিনি ২০০১ থেকে ভারতেই বসবাস করুন, ২০১৬ সালে ভারতের নাগরিকত্ব পান, বা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ২০২১-এ ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি পেয়ে থাকুন না কেন– জন্মসূত্রে পাকিস্তানি, বাবা পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের প্রাক্তন কমান্ডার, এটুকু অবিশ্বাস তো তাঁর প্রাপ্যই। তাই না?
গুজব ওই স্তরে পৌঁছে গিয়েছে যে, আদনান সামি বর্তমানে ভারতের একাংশের কাছে পাকিস্তানের গুপ্তচর, আবার পাকিস্তানের একাংশ টিটকিরি দিচ্ছে– তা’বলে ভাই এভাবে ভারতকে লয়্যালটি দেখাবি?
এই ঘোঁট পাকার উৎস আসলে ২০১৬, আদনান সামির ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির বছর। আবার একই সঙ্গে বছরটা উরি অ্যাটাকেরও, যেখানে বিনাযুদ্ধে শহিদ হন ১৯ জন ভারতীয় সেনা। এর প্রতিক্রিয়ায়, ‘ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ রাতারাতি ঘোষণা করল, ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে, অভিনেতা হোক বা গায়ক, কোনওভাবেই আর কোনও পাকিস্তানি শিল্পীকে কাজ দেওয়া হবে না। এক অর্থে কান ঘেঁষেই বেঁচে গেলেন আদনান সামি। তাই কি এই রোষ দো-তরফা? আগামী সময়ে আদনানকে টিকে থাকতে গেলে আরও কী কী ভাবে ভারতের জাতীয় পতাকার রং নিয়ে খেলতে হবে, দেশের সাচ্চা নাগরিক প্রমাণ করতে হবে, জানা নেই। তা, রাতারাতি সেই বছর ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ ও ‘এ দিল হ্যায় মুশকিল’-এর মতো বিগবাজেট স্টারকাস্ট সিনেমা বক্স অফিসে মার খেয়েছিল, কারণ একটাই, দুই সিনেমাতেই অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন পাকিস্তানি অভিনেতারা। ডিয়ার জিন্দেগি-তে আলি জাফর। এবং অন্যটিতে নিতান্ত ক্যামিও রোলে ফাওয়াদ খান। সর্বোপরি, পাকিস্তানি গায়কদের জন্য ভারতীয় সিনেমায় প্লেব্যাকের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, অনির্দিষ্টকালের জন্য।
এত কিছু যে ঘটল, একগুচ্ছ আগামী প্রোজেক্ট বাতিল হল, মুলতবি হল, কিমাশ্চর্যম, এহেন ব্যানের ঘোষণা রাষ্ট্রের তরফে দফতরি বা অফিসিয়ালভাবে কিন্তু হয়নি। কেবলমাত্র একটি অ্যাসোসিয়েশনের পত্র মিদং এহেন কঠোর ব্যান লাগু হয়ে গেল, এবং সেখানে বৃহত্তর কোনও প্রভাবের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা নেই, সম্ভব?
বর্তমানে, সোশাল মিডিয়ায় প্রোফাইল ব্যান করাটা যে পড়শিদেশি শিল্পীদের ফলোয়ার কমিয়ে আয়ের রাস্তা বন্ধ করে একপ্রকার শাস্তি দেওয়ারই বন্দোবস্ত, তা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, শিল্পীদের গানও নিষিদ্ধ করলে শাস্তির ঘা কি একপাক্ষিক থাকে! এ তো নিজেদেরও ক্ষতি। এর শুরু যদিও ২০১৯-এর পুলওয়ামা অ্যাটাকের পর থেকেই। যাবতীয় রেডিও প্ল্যাটফর্ম পাকিস্তানি শিল্পী বা ব্যান্ডের গান সম্প্রচার করাই বন্ধ করে দিল। আর এখন? বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া, অডিও প্লাটফর্মের সিদ্ধান্তে– পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী ও শিল্পীদের সোশাল মিডিয়া প্রোফাইল ভারত থেকে ইতিমধ্যে নিষ্ক্রিয় করা হয়ে গিয়েছে, তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে এবং তাঁদের গান স্পটিফাই, সাভন, গানা, ইউটিউব, ও অন্যান্য যাবতীয় স্ট্রিমিং সার্ভিস থেকে উবে যাচ্ছে– যেন ছিলই না কখনও। সোশাল মিডিয়ায় পুরোদস্তুর কবজা, এটাই হয়তো বাকি ছিল যা পহেলগাম সন্ত্রাসের পর চুকিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হল বললে ভুল হবে না।
ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই দেশ, যার প্রধান সংস্কৃতি-সাহিত্য-ধর্ম-দর্শনের গোড়া ছিল ‘শ্রুতি’ দিয়ে ঘেরা। স্তোত্রের ধ্রুপদী, রাজদরবারে শাস্ত্রীয় সংগীত পেরিয়ে ফসল তোলার বিকেলে, ছাদ পেটানোর বেলাতেও যেখানে চাষি-শ্রমিক-মজদুরকে সুর সঙ্গ দিয়েছে, জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন শৈলী। অগণিত ঘরানায় মোড়া দুই ধারার রাগসংগীত বিশ্বকে দিয়েছে সুরের অন্যতম বুনিয়াদ, তার টানে সেই কোন কাল থেকে এখনও বিভিন্ন ভূখণ্ডের মানুষ এসে পড়ে থাকে এই সুরের অক্লান্ত অবিরাম রহস্যকে এক চিলতে নিজের করে নেবে বলে। যে ভূখণ্ডের কিছুমাত্র মাটির তফাতে সুফি-বাউল-কাওয়ালি জন্মায়, ভিন্ন কথা বলে, আবার একও হয়ে যায়। আর বাকি পৃথিবীর সমস্ত সুরভঙ্গিমার মিলমিশ যেখানে পাওয়া যায়। যে দেশের প্রথম নোবেল আসে গীতাঞ্জলির হাত ধরে, যেদেশে আজও একটা শান্তিনিকেতন আছে কোনও এক বুড়ো ঠাকুরের গড়ে যাওয়া, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ রবীন্দ্রসংগীতকে ভারতীয় সংস্কৃতিকে অনুভব করতে আসে– সেই বৈচিত্রময় দেশ কি না গানকে দূরে সরিয়ে দিল কেবল সীমান্ত সমস্যার জন্য! অথচ, মনে করে দেখুন, এই তো কোভিডের সময়ই সোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল হয়েছিল পাকিস্তানের একটি টিভি সিরিয়াল। সেখানে সিন বুঝে বুঝে রবীন্দ্রসংগীতকে ব্যবহার করা হয়েছে এত নিপুণভাবে, যা ভারতীয় সমক্ষেত্রে এত গভীরভাবে কেউ আজ আর ভাবে কি না সন্দেহ। অনুরাগ বসু চেষ্টা করেছিলেন ‘গল্পগুচ্ছ’ ভিত্তি করে একটি ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে, যা প্রায় আলোচনাই হয় না। এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ আর নেই, তাঁর ‘গানের ওপারে’ টিভি সিরিয়ালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল টিআরপির অভাবে!
পাকিস্তানি গায়কদের নিয়ে কী বলব, যোগী আপন গ্রামেই তো ব্রাত্য। এই তো, এই কিছুকাল আগেও দেখা যেত, ভারতীয় সংগীতশিল্পীর পাশে একজন পাকিস্তানি শিল্পী, একসঙ্গে গাইছেন, গল্প করছেন। যদিও সত্যি বলতে শিল্পী ছাড়া আর কোনও পরিচয় দাগানোর অভ্যাসই ছিল না। লতা মঙ্গেশকর বেশুমার প্রশংসা করছেন মেহেদি হাসান-কে নিয়ে, ফরিদা খানুম ওদিকে লতা-কে তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা ‘সাক্ষাৎ সরস্বতী’ বলে গুণগান করছেন, একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছেন গজল দুনিয়ার দুই জ্যোতিষ্ক জগজিৎ ও গুলাম আলি। সম্প্রীতির স্মৃতি অনন্ত। দুর্ভাগ্যবশত, এই নিষেধাজ্ঞার ছায়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছে একটা যুগ– যেখানে সীমান্ত উপেক্ষা করে অপরূপ নিকিয়ে ছাপোষা নির্বিঘ্ন মিলমিশের উঠোনখানি তৈরি করে রেখেছিলেন শিল্পীরা। প্রাচীন যৌথতাকে অস্বীকার করে শেষমেশ গানকেও বকলমে হিংসা বা সন্ত্রাসের উপকরণ ঠাওরানো হল যে, এর নেপথ্যে তাহলে কার ভূমিকা? দেশ না রাষ্ট্র? না কি বাজার? আদপে সব জগাখিচুড়ি হয়ে বদলে গিয়েছে বিগত মাত্র দুটো দশকেই। একটু ফিরে গেলেই বোঝা যাবে।
১৯৯৭। ভারত স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছর। স্বাভাবিকভাবেই হাফ সেঞ্চুরির উদ্যাপনে দেশজুড়ে সাজ সাজ রব। মিডিয়া, সরকার, বাজার– রাষ্ট্রের এই তিন স্তম্ভই তখন জাতীয়তাবাদের এক নতুন ব্র্যান্ডিংয়ে মেতে উঠেছে। মোক্ষম সময়ে ভারতের বাজারে প্রবেশ করার ছক কষেছিল বটে সোনি মিউজিক। ভারতীয় সংগীতশিল্পীদের আন্তর্জাতিক স্তরে টেনে তোলার সুপ্রতিশ্রুতি নিয়ে, নাম খোঁজা চলছে তখন। শেষে সোনি মিউজিকের সঙ্গে প্রথম যে ভারতীয় সংগীতপ্রতিভা চুক্তিবদ্ধ হলেন, তিনি– এ আর রহমান। যদিও, আন্তর্জাতিক চিঁড়ে ভেজানোর মতো বিখ্যাত তখনও তিনি হয়ে ওঠেননি। তাই ঠিক করা হল, পাল্লা ভারী করতে সঙ্গে থাকবেন তৎকালীন প্রখ্যাত পপ গায়িকা সেলিন ডিওন, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘টাইটানিক’ সিনেমার থিম গান গেয়ে তিনি ততদিনে ভারতীয় উপমহাদেশের ঠোঁটে ঠোঁটে ইংরেজি গানের প্রতিভূ। কিন্তু, সেলিন ডিওনের সঙ্গে ভারতের কী সম্পর্ক ভাই? রহমানের সপাট যুক্তি– এ তো জল আর তেল। মেশে না। এরপর যাঁকে চাইলেন, তাঁর দেশীয় পরিচয় নিয়ে বাধল তুমুল চাপানউতোর, দেশের জয়গান হচ্ছে হোক না, পড়শিকে টানার কী দরকার!
শেষে জয় হো রহমানেরই হল। নুসরত ফতেহ আলি খান। অনেক তামঝাম, কপালের ভাঁজ পেরিয়ে। এবং, সেই প্রথম ঘটল একজন ভারতীয় ও একজন পাকিস্তানি সংগীতশিল্পীর অ্যালবামীয় যুগলবন্দি। গানের অদৃশ্য সীমান্তকে রহমান উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন বহু আগেই, তা এখন বোঝা যায়।
সোনি ও রহমানের তিনটি অ্যালবামের চুক্তি নিয়ে, তৈরি হল প্রথম অ্যালবামখানি, যা ইতিহাস গড়ল– বন্দে মাতরম্। কী বিপুল জনপ্রিয়তা পেল এই অ্যালবাম, তার নিদর্শন এখানেই যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারত-কে উৎসর্গ করা অ্যালবামের প্রথম গানটি আর কেবলই ভারতের রইল না। এখনও অবধি সর্বাধিক ভাষায় (২৭৭টি) অনূদিত ও গাওয়ার রেকর্ড হয়ে আছে, ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে তাকে আপন করে নিয়েছে আরও অসংখ্য দেশ। ঠিকই ধরেছেন, ‘মা তুঝে সালাম’।
অ্যালবাম এখানেই থেমে থাকেনি। ভারতের স্বাধীনতা, দেশমাতৃকার জয়গান পেরিয়ে রহমান পৌঁছে গেছিলেন আরও গভীরে। ভাবলে অবাকই লাগে, ৫০ বছরের স্বাধীনতা পূর্তি বলে কথা, অথচ সেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বে অন্যতম অস্থির শরিককে বাদ দেননি রহমান, বরং শান্তির একান্ত চেষ্টায় আজকের নিরিখে এই প্রয়াস দুঃসাহসিক। এবং তা বিফলেও তো যায়নি। নুসরত ফতেহ আলি খানের জ্যান্ত গলা কেঁদে উঠেছিল শান্তির আহ্বান নিয়ে, রহমানের সুরে। বিখ্যাত সেই গান ‘Gurus of Peace’, নুসরত ফতেহ আলি খানের জীবনের শেষ রেকর্ডিং, যা রেকর্ড করতে পাকিস্তান পৌঁছে গিয়েছিলেন রহমান নিজে। ভারত-পাক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে এই গান ডাক দিয়েছিল শান্তি, কোলাকুলির, বন্ধুত্বের, ভালবাসার।
ছিল আরও একটি গান ‘তওবা তওবা’– যেখানে রহমানের ওই হাই পিচ মৌতাতে ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়ল দেশের বৈষম্য, ব্যর্থতা নিয়ে একরাশ ক্ষোভ, বিরক্তি, গুস্সা।
‘কব পায়েঙ্গে সব দিল কে আজাদি কো?
কব আয়েগা উয়ো প্যায়ারি প্যায়ারি সুবাহ
দৌলত বঢ়তি হ্যায় রোজ তো আমিরো কি হি
ভুক বঢ়তি হ্যায় রোজ হি গরিবোঁ কি’
‘মা তুঝে সালাম’ বন্দনা পেরিয়ে গানে গানে একই সঙ্গে বিত্তবান ভারত আর ভুখা ভারতকে মাপতেও ছাড়েননি রহমান তাঁর অ্যালবামের শেষপাতে।
জাতীয়তাবাদের যত সম্ভাব্য পরত– সমালোচনা, শান্তি, অহং, আশাবাদ– সবই ছিল সেখানে। তখন কেউ ‘দেশবিরোধী’ তকমা দিয়েছিল এই অ্যালবামকে? খুঁজে দেখুন, পাবেন না। কেউ বলেনি, পাক শিল্পীর সঙ্গে গান বেঁধেছে, ও ব্যাটা দেশদ্রোহী, বলেনি কেউ, রেকর্ড করতে গিয়ে ওখানেই থেকে গেলে না কেন বাছা! বরং, এমন শান্তির গানকে তখন সরকার, বাজার, জনগণ মাথায় তুলে নিয়েছিল। কারণ সময় আর বাজার উভয়ই তখন এক ধরনের ‘inclusive nationalism’, আধো আধো সোশালিজম-এর ভাবধারায় ছিল হাসিখুশি, জাঁকজমক নয়, খুব অনাড়ম্বরও নয়। মুক্ত অর্থনীতির পালিশ করা নখ ও সফেদ দাঁত তখনও কামড় বসায়নি জনগণের মননে। আর আজ কী হল? হায়, রহমানের ‘বন্দে মাতরম’ অ্যালবামে নুসরত ফতেহ আলি খানের উল্লেখটুকু নেই, কেবল কণ্ঠ ছাড়া। সেটাও না বাদ পড়ে যায়!
একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এই ছাঁকনি প্রক্রিয়া কিন্তু একধার থেকে কচুকাটা নয়, খুব বেছে বেছে বিখ্যাত জনপ্রিয় সাম্প্রতিক কালের উঠতি শিল্পীকে তাক করেই করা হয়েছে। আতিফ আসলাম, আলি শেঠি, বাদ যাননি নুসরত ফতেহ আলি খানও। আবার রয়ে গিয়েছেন বেশ অনেক বিখ্যাতই, যাঁদের নাম নিয়ে বিড়ম্বনা বাড়াতে চাই না। ফলে, প্রশ্ন জাগে– এ কি একপ্রকার হুমকি? চাপ তৈরি করা? রেডি থাকো, এবার তোমার পালা?
এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি ‘সনম তেরি কসম’ ছবিটি রি-রিলিজ হওয়ায় পুনরায় সিনেমার গানগুলি শ্রুতিজগতে হাওয়া তুলেছে, হলেও বেশ উত্তেজনা দেখা যাচ্ছিল। সিনেমার সিকুয়েলের দাবিও উঠেছিল খুব, কিন্তু পহেলগাম ঘটামাত্র রাতারাতি সেসব ঢাকাচাপা পড়ে যেতে দু’দণ্ড সময়ও লাগেনি। নায়িকা মওরা হুসেন পাকিস্তানি হওয়ায়, তাঁর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে সিনেমার পোস্টার থেকে। ভাবি, গোটা সিনেমায় নায়িকাকে বাদ দিতে গেলে কাঁচিমশাইদের কী অবস্থা হবে?
বিদ্বেষ বিষ বর্তমানে যতই সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক না কেন, কেবলমাত্র গণতান্ত্রিকতার যুক্তিতেই বলা যায়, ভারত দেশ আর রাষ্ট্র এক নয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তা অন্যথা হয় না। মৌলবাদীর গলা দিয়ে গোটা দেশের সুর ধরা যায় না কখনও।
যদিও, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দেশ মানে একরৈখিক, অবিভাজ্য কিছু। তা যদি মেনেও নিই, আমরা নুসরত ফতেহ আলি খান, নায়রা নূর, আবিদা পারভিন, সাফকাত আমানত আলি, আতিফ আসলাম, আলি শেঠি কিংবা ব্যান্ড হিসেবে ‘জল’-এর কাছে অস্ত্র ধরার, হিংসা ছড়ানোর কিংবা ভারতকে কবজা করার কথা বলতে শুনেছি কি কখনও? এমনকী শুনিনি গানকে কোনও মৌলবাদ প্রচারের পথ হিসেবে তৈরি করেছেন তাঁরা। তাঁদের গান, তাঁদের কণ্ঠে যে বেদনার নিরাময় মিশে থাকে, তা বহুদিন ধরেই আমাদের ব্যক্তিগত শান্তিসূত্র। আমাদের ভেতরের অস্থিরতা, ক্ষোভ, হাহাকার, মাঝে মাঝে যখন তীব্র হয়ে ওঠে, সেই সময় এই গানগুলো আমাদের কাঁদায়, থামায়, শান্ত করে। গানগুলির তালিকা লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁরা বহুকাল আমাদের ভিতর-দেশের নাগরিক, আমাদের অনুভবের পড়শি।
কিন্তু এই ভিতর-দেশ তত বড় নয়, বিখ্যাতও নয়। অন্তত ভারত রাষ্ট্রের মতো নয় নিশ্চয়ই। না হলে উগ্রপন্থা আটকাতে গেলে গানও থামাতে হবে, এহেন সিদ্ধান্ত কি শান্তির বিরুদ্ধে নয়?
জানতাম, যুদ্ধ থামাতে গেলে আগে ‘Gun’ নামাতে হয়। এখন দেখছি, গান থামানোও নীতিগত যুদ্ধের অঙ্গ। রাষ্ট্র কীভাবে গান-নিষেধাজ্ঞায় নিরাপদ হয়, তা আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি– সংগীত শোনা মানে তো শান্তি চাওয়া। শান্তি চাওয়া মানে রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়।
এখন বাজারই হয়ে উঠেছে যুদ্ধঘোষক, এখন গান সেটাই যা ‘দেশপ্রেমের প্রমাণ’, শিল্পী মানেই ‘দেশের পক্ষে’ না হলে কমপক্ষে আরবান নকশাল, বাড়াবাড়ি করলে উগ্রপন্থী। তবু শ্রোতা ঠিক কান পেতে রয়েছে। আসলে গান বরাবরই অশান্তির দিকে তাক করে রাখা। তাকে থামাতে গেলে এই হাওয়াকে থামাতে হবে মশাই। তাই, এই মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া যত বাড়বে, ততই গজিয়ে যাবে ঠিক বিকল্প কোনও আশ্রয়।
যা হোক, শান্তির কথা বেশি বলব না, আজকাল তো তাতে আরও বেশি অশান্তি!
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোবববার ডিজিটাল
………………………………………