‘পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই, যার মধ্যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, লোভ ইত্যাদি নেই, আবার সেই মানুষই এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে মরণজয়ী হয়।’ আজিজুল হক তাঁর তোবড়ানো গাল নিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও জীবন উথলে আওড়েছেন ‘মানুষকে ভালবাসতে হবে, পাগলের মতো ভালবাসতে হবে।’ কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েও পাঁচশো বছর ঘুম না আসা আমার প্রজন্মের কাছে এই কথা অমৃতবাণীর মতো শোনায়, চোখের তলায় দু’-তিন পোচ কালি নিয়ে হতবাক হয়ে ভাবি, ‘মানুষকে ভালবাসতে হবে, পাগলের মতো ভালবাসতে হবে। কারণ এই মানুষই মানুষকে দুর্দিন থেকে সুদিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।’ এই কথার রোমান্টিকতায় ডুবে গিয়ে নয়, কনটেক্সট বিছিন্ন করে নয়, ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে প্রতিটি শব্দের অর্থ চেতনায় প্রোথিত করেই এর সত্যি বা সত্যির কাছাকাছি প্রয়োগ সম্ভব।
গ্রাফিক্স দীপঙ্কর ভৌমিক
‘রাজকুমার, রাজকুমারী নাচে, গায়, হৈ-হুল্লোড় করে। সেপাই দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল! তারও প্রাণ চায় ওদের সাথে ভিড়ে যেতে, পারে না। কারণ সে সেপাই! তাই বুকের সাধ বুকে চেপে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। অপলক দৃষ্টিতে টান টান বুকে মাস্কেটটা চেপে ধরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে সে।’
লাল টুকটুকে দিন। আজিজুল হক
দুনিয়া জুড়ে যখন পুঁজিবাদী শক্তি একের পর এক প্রজন্মের মস্তিষ্ক কিনে ফেলছে নিতান্ত বিনে পয়সায়, তখন একটি হাড় গিলগিলে লোক কোনওরকমে একটা ঢলঢলে পাঞ্জাবি গলিয়ে বাঁকা শীর্ণ আঙুলগুলো মেলে নিজের সারাটা জীবন ব্যয় করে বলে চললেন, ‘বাবারা, ঋণ শোধ করো।’ কীসের ঋণ? আমরা নিজেদের ঋণী বলে আইডেন্টিফাই করব কী করে, ঋণ কাকে বলে, তাই তো জানলাম না কখনও। এই গ্রহ তো এখন সেই যন্তর-মন্তর ঘর, যার বাইরে দাঁড়ানো কতিপয় কীটের আঙুলের ওঠাপড়ায় নির্বিবাদে হয়ে চলেছে মানুষের মস্তিষ্ক ধোলাই, যন্ত্রেরও কোনও বিরাম নেই।
থালার ওপরে সাজানো সাদা ঝরঝরে ভাত দেখে আমরা ক’জন কতদিন কতবার মনে করতে পেরেছি ভারত জুড়ে কৃষক আত্মহত্যার কথা? কোনও চাষি ফসলের দাম না পেয়ে নিজের খিদে চেপে রাখা ঘাম ঝরানো বস্তা বস্তা ফসল নিজে হাতে বাঁশের বাড়ি মেরে মেরে নষ্ট করছে, আমরা তো দেখেছি, ‘ঋণ’ বুঝেছি কি? বুঝিনি, কারণ আমাদের উইকেন্ড ভ্যাকেশন স্পট ওই যন্তর মন্তর ঘর। ওখানে এসি রুম, অ্যাটাচড টয়লেট, সমস্ত মডার্ন ফ্যাসিলিটি, উপরি ইনফিনিটি পুল। আপনি-আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি কি এই যে বিশাল ব্যবস্থা, এই সবের আগে ওই জায়গায় কী ছিল? জঙ্গল ছিল, হাজার হাজার গাছ ছিল, গাছ জড়িয়ে ছিল শয়ে শয়ে মানুষের জীবন। তারা কারা? ভূখণ্ডের আদিম অধিবাসী। কখনও তারা সাঁওতাল, কখনও ওরাও, কখনও ‘রেড ইন্ডিয়ান’। তথাকথিত সভ্যতাকে মধ্যমা দেখানো গরিবগুরবো প্রান্তিক মানুষসকল। অকৃপণ পৃথিবী অক্সিজেন জুগিয়েছে, আমরা কোল মাইন বানিয়েছি, ‘O what a world of profit and delight,/ of power, of honor, of omnipotence.’ (Doctor Faustus– Christopher Marlowe)। আজিজুল হক, কাদের দিয়েছেন ঋণ শোধের পাঠ?
আমরা আসলে সেই সুইসাইড বম্বার আরডিএক্সের ভারে দেহ নুয়ে পড়েছে যাদের, নাকের সামনে মুলো ঝোলানো সেই গাধার দল, যারা সৃষ্টির কোন আদিকালে নিজেদের কবর খুঁড়ে এসেছি, অথচ মূলোর পিছনে দৌড়ে চলেছি যুগ-যুগান্তর ধরে, কখন কে ফেটে যাব, আর শোষকের গ্যাং লাশের চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে ফেলবে আমাদেরই খোঁড়া কবরে। বন্দোবস্ত সব পাকা।
সাংবাদিক: বোঝাই যাচ্ছে এই গৃহযুদ্ধ ফলাফলশূন্য, ব্যর্থ।
বিপ্লবী (সাংবাদিককে মাঝকথায় রুখে): এটা গৃহযুদ্ধ নয়, এটা একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, যেটাকে আপনি সমর্থন করছেন, মানুষের আত্মরক্ষার একটি পথ। এটা গৃহযুদ্ধ নয়।
সাংবাদিক: বা একটা দ্বন্দ্ব, কনফ্লিক্ট।
বিপ্লবী: না, এটা কনফ্লিক্টও নয়, এটি ন্যায়ের পক্ষে একটি জনগোষ্ঠীর ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধ।
সাংবাদিক: যেটাই হোক।
বিপ্লবী: না, যেটাই হোক নয়, ইটস নট হোয়াটএভার, আর ঠিক এইখানেই সব সমস্যার শুরু, মানুষ তার অধিকারের জন্য লড়াই করছে।
সাংবাদিক: আপনারা আলোচনায় বসছেন না কেন? এই হত্যা, এই ধ্বংসের পরিবর্তে ‘পিস টক’ কি শ্রেয় বলে মনে হয় না আপনার?
বিপ্লবী: peace talk with whom?
সাংবাদিক: ইজরায়েলি সরকারের সঙ্গে।
বিপ্লবী: that’s a kind of conversation between the sword and the neck, you mean?
…একটি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং মুক্তিকামী মানুষের কথোপকথনের প্রশ্ন অবান্তর।
সাংবাদিক: better that way than dead though?
বিপ্লবী: আপনার জন্য হতে পারে, তবে আমাদের জন্য দেশের স্বাধীনতা, সম্মান, মানবাধিকার জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
বিপ্লবীর নাম ঘাসান কানাফানি, প্যালেস্তিনিয়ান গেরিলা যোদ্ধা, ১৯৭২-এর প্যালেস্তিনিয়ান ইন্তিফাদার মাঝে যাকে ইজরায়েলি মোসাদ বাহিনী হত্যা করে। এর ঠিক দু’-বছর আগে বেইরুট শহরে আপাত শান্ত কানাফানি কি অনায়াস সহজতায় উত্তর দিয়ে যান, সাংবাদিকের শ্রেণি চিনিয়ে দেন অকৃত্রিম স্পর্ধায়।
একটু, বলতে পারি সামান্য নজর দিলেই বোঝা যায় আসলে কে কোন ভাষায় কথা বলে, ভাষা উঠে আসে যাপন থেকে। সাংবাদিকের ‘better that way than dead though?’ প্রকৃতপক্ষে কাদের হয়ে কথা বলে? ১৯৪৮ থেকে মরতে মরতে পঁচাত্তর বছর ধরে মরে চলেছে প্যালেস্তাইন। গোটা আরব দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সর্বাগ্রে আমেরিকা নামক পৈশাচিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে স্রেফ ধুলো হয়ে গেল লক্ষ লক্ষ প্রাণ, বাড়ি ঘর, শেষ সম্বল। তবু মাথা ঝুঁকল না, বুক রইল টানটান।
আঠেরো বছর কারাবাস আজিজুল হকের। ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশিত বই ‘লাল টুকুটুকে দিন’-এ উনি লিখছেন, জেলমুক্তির আগে হাসপাতাল-জীবনের শেষ সময়ে তৎকালীন সিপিআইএম-এর কোনও মন্ত্রীর সঙ্গে ঈষৎ তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন, অলমোস্ট ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো আওড়েছেন– ‘‘কংগ্রেসে ভয়, (মানুষকে) তোমাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, কংগ্রেসের ভয় তার আছে, তোমরাও তাদের সরিয়ে নিয়ে এসে তাদের কোনো ‘রিফ্লেক্স অফ পারপাস’ গড়লে না, সেরেফ নেতিবাচক রিফ্লেক্স গড়ে ঠেলে দিলে এক বিপজ্জনক পথে… সেই চাষ করা জমিতে ফ্যাসিবাদ আসছে… ফ্যাসিবাদকে গণতন্ত্রীকরণের কাজে নেমেছে যে পার্টি তার নাম বিজেপি। ….ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার সপক্ষে জনমানস প্রস্তুতির পর্ব… ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা। মানুষের মধ্যে পশু প্রবৃত্তির সংস্কৃতিটা ঢুকিয়ে তোমরা তার জন্য জমি চষে যাচ্ছ… আপশোষ।” কী অপরিসীম দূরদৃষ্টি এবং নিখুঁত সামাজিক আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একটি দীর্ঘদিনের জেল-খাটা প্রাণেও আলোকবর্তিকা হয়ে থাকতে পারে। পুলিশি অত্যাচারে মুড়মুড়ে হয়ে যাওয়া দেহ, তবু ওই বুক ঠোকা বৈপ্লবিক সাহসের খামতি নেই এতটুকু, ‘তা মশায়, জেলটা নরক, চিরকালই ছিল, আজও আছে। তাছাড়া আমি তাদের উচ্ছেদ করার জন্য লড়াই করব– তারা আমাকে দুধে-ভাতে রাখবে এটা ভাববই বা কেন? তাই জেলে অত্যাচারটা কোনও বলার মতো ঘটনাই নয়। বলার যেটা, সেটা হল এই অত্যাচারের জাল কেটে জীবন কীরকম নিজেকে ঘোষণা করেছে– জীবনের এই দৃপ্ত ঘোষণাই জেল-জীবনের বলার কথা। বাকি সব কথার কথা। ন্যাকামি বই কিছুই নয়।’
আমরা দেখেছি, জেনেছি, তবু কই, শরীরে মনে মননে কণামাত্র লজ্জা পেয়েছি কখনও? আমরা লিখি টিখি, সিনেমা বানাই, আহ, আমরা আর্ট করি। বুদ্ধিজীবী সাজার অধিবেশনে লাইন লাগিয়েছি আজন্মকাল। সমাজ তো সমাজের মতো চলবে, ‘আমাদের দায়’ আবার কী! অর্থাৎ এই পচাগলা গা ঘিনঘিনে বমি উগড়ে আসা সমাজব্যবস্থা যা আপনাকে-আমাকে পুতুল বানিয়ে নাচাচ্ছে, তাকে টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাই কি আমাদের একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তি হয়ে ওঠেনি?
যে লোকটি মাটি কুঁপিয়ে ফসল বোনেন, আর যে লোকটি বাড়িতে বসে কবিতা ফলান– এই দু’টিই তো শারীরিক বৃত্তি, কিন্তু সভ্য হওয়ার আমাদের এই নিরলস চেষ্টার কোনও এক ফাঁকে আমাদের মস্তিষ্ক মুড়িয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মেঠো ওই কৃষকের চেয়ে কবির স্থান অনেক ওপরে, কারণ কবির কাজ কলমের, আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝে ফেলেছি, কবির মস্তিষ্কের নিউরোনগুলি আসলে শরীরের বাইরে থাকা কোনও জাদুবল, অর্থাৎ কবির শ্রম কায়িক নয়। আর কৃষক, সে তো মাঠে লাঙল চষছে সারাদিন। আজিজুল হক বলছেন, আসলে শ্রমজীবীদের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগিয়ে তুলে একদল মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসেই ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির ইচ্ছাকৃত উদ্ভাবন, এটি পুঁজিবাদের পক্ষে একটি রাজনৈতিক চালবিশেষ। এই বিশেষ গোষ্ঠী এবং বুর্জোয়া অর্থনীতি প্রকৃত অর্থেই একে অপরের স্বার্থে পরস্পরের জন্য অপরিহার্য থেকেছে চিরকাল।
১৯২৬, মুসোলিনির ইতালি তখন ফ্যাসিজমের আঁতুড়। ইতালিয়ান কমিউনিস্ট আন্তোনিও গ্রামশিকে পুরে দেওয়া হল জেলে ২০ বছরের জন্য, বলা হল, ‘এই মস্তিষ্কটি যাতে অন্তত ২০ বছরের জন্য অচল হয়ে থাকে, তারই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’ যথারীতি ঘুরেফিরে সেই মস্তিষ্ক, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি। আজিজুল হক বলছেন মানুষের মস্তিষ্কের ওপর আধিপত্য বিস্তারই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কী এই আধিপত্য? এখানেই এসে পড়ছে গ্রামশির প্রসঙ্গ, জেলে বসে লেখা ‘জেলখানার নোটবই’-তে পাওয়া থিওরি অফ ‘হেজিমনি’ (আধিপত্য) এবং ‘ডমিন্যান্স’ (প্রাধান্য) আমাদের বোঝায় যে কোনও শ্রেণিক্ষমতা লাভ এবং সেই ক্ষমতা জারি রাখার জন্য জোর খাটায়, এই ক্ষমতাই গ্রামশির ভাষায় প্রাধান্য আর ক্ষমতা লাভের আগে থেকেই এবং অব্যবহিত পরেই উক্ত শ্রেণিকে তার ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ এবং সামগ্রিক চিন্তাপদ্ধতি সমাজের প্রতিটি স্তরে, বলা ভালো প্রতিটি মস্তিষ্কে চালান দেওয়ার চেষ্টাকেই গ্রামশি বলছেন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। অর্থাৎ মস্তিষ্ককে গ্রাস করতে পারলেই খেল খতম।
আজিজুল হক বারবার বারবার বলেছেন পক্ষের কথা। পক্ষ নেওয়ার কথা। সোজা করে বললে আমার মাথা গ্রাস করবে কোন পক্ষ? কার হাতে আমি আমার মাথার অধিকার অর্পণ করব? আমার মাথা নিয়ে যে শোষক ফুটবল খেলবে নাকি আমার আমার মাথা যার কাছে কেবল একটি সাংখ্যিক পরিচিতি না, একটি মনুষ্য-মস্তিষ্কের স্বীকৃতি পাবে। পক্ষ নিতে হবে। আমরা যারা আজন্ম দোদুল্যমান থেকে বছর বছর বাচ্চা বিইয়ে নিজেদের জীবনকাল পার করে চলে যাচ্ছি, বংশের ধারায় মাথা বিক্রি করে দিয়েছি সেই সব পিশাচদের কাছে, যারা আমার রক্তের ঘামের শ্রমের টাকার সিংহভাগ তুলে দিয়েছে আম্বানি আদানি আপদদের পকেটে, আর হরির লুটের মতো খুচরো পয়সা ছুড়েছে আমার দিকে, বিগলিত আমি তাই কুড়িয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছি, বিয়োনো বাচ্চাদের রেখে যাচ্ছি এই শয়তানেরই ছত্রছায়ায়, এই আমাদেরও পক্ষ নিতে হবে। কারণ আমাদের ঋণশোধ করতে হবে।
‘একজন ডাক্তারের কাজ শুধুমাত্র রোগের বাহ্যিক কারণগুলো দূর করা নয়, রোগীর মনটাকেও মেরামত করা। পাভলভ পড়লে বুঝতে পারতেন। আর মনের কারবারি, শেক্সপিয়র-দস্তয়ভস্কি-বালজাক-তলস্তয়-গোর্কি– বাদ দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে পারেন– একজন ডাক্তার? উনি জানেন না, লেডি ম্যাকবেথের মন, হ্যামলেটের ‘ডিলেরিয়াম’, টেম্পেস্টের ‘হ্যালুসিনেশন’, ওথেলোর ‘প্যারানইয়া’ নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকশো’ ডাক্তার ডি এস-সি পেয়েছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন দর্শন জন্ম নিতে চলেছে। আর ইঞ্জিনিয়ার? বিঠোফেন জানেননা বা বোঝেন না, এমন একজন ইঞ্জিনিয়ার তো– নিছক হাতুড়ে রাজমিস্ত্রি। হেগেলের ভাষায়– ‘আর্কিটেকচার ইজ আ ফ্রোজেন মিউজিক!’ অর্থাৎ তাজমহলকে যদি গতিশীল করা যায়– সৃষ্টি হবে– ওমর খৈয়ামের রুবায়েত, বিঠোফেনের সোনাটা আর রবিশঙ্করের সেতার কিংবা পাগিনিনির ভায়োলিন! আর ওঁদের, এগুলোকে ‘ফ্রিজড’ করলেই হবে ‘তাজমহল’! (‘কারাগারে ১৮ বছর’– আজিজুল হক)। মায়ামাখানো এই কথার বিশ্লেষণে উঠে আসে একটি মতাদর্শের বিজ্ঞানভিত্তিক আপগ্রেডেশনের প্রয়োজনীয়তা। থিওরিকে কোলের কাছে জাপটে বসে থাকা নয়, পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে মতাদর্শের ক্রমবিবর্তন সম্ভব হলেই তার প্রায়োগিক ক্ষমতার ভিত্তি রচিত হয়।
‘পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই, যার মধ্যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, লোভ ইত্যাদি নেই, আবার সেই মানুষই এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে মরণজয়ী হয়।’ আজিজুল হক তাঁর তোবড়ানো গাল নিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও জীবন উথলে আওড়েছেন ‘মানুষকে ভালবাসতে হবে, পাগলের মতো ভালবাসতে হবে।’ কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েও পাঁচশো বছর ঘুম না আসা আমার প্রজন্মের কাছে এই কথা অমৃতবাণীর মতো শোনায়, চোখের তলায় দু’-তিন পোচ কালি নিয়ে হতবাক হয়ে ভাবি, ‘মানুষকে ভালবাসতে হবে, পাগলের মতো ভালবাসতে হবে। কারণ এই মানুষই মানুষকে দুর্দিন থেকে সুদিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।’ এই কথার রোমান্টিকতায় ডুবে গিয়ে নয়, কনটেক্সট বিছিন্ন করে নয়, ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে প্রতিটি শব্দের অর্থ চেতনায় প্রোথিত করেই এর সত্যি বা সত্যির কাছাকাছি প্রয়োগ সম্ভব। নাহলে মিথ্যের বেসাতি-পূর্ণ এই রাজ্য, এই দেশ, এই পৃথিবী তলিয়ে যাবে নিকষ আঁধারে। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আলো ঝলমলে দিনে, কিন্তু এই মিথ্যে পিছমোঁড়া করে বেঁধে ফেলেছে আমায়, স্বপ্ন টলটলে চোখ বুজে আসে শ্রান্তিতে, তবু বেঁচে থাকতে হবে, মানুষকে ভালবাসতে হবে। ‘আমি ভয়ঙ্কর রকমের আশাবাদী তাই হতাশা থাকতেই পারে। যিনি আশা-ই করেন না, তার আবার আশা-হতাশা।’ ( লাল টুকটুকে দিন। আজিজুল হক)। পৃথিবীতে কোথাও কোনও দিন কখনও কোনও বিপ্লব হবে না জেনেও বিপ্লবের আশা করে মস্তিষ্ককে প্রস্তুত রাখতে হবে। কে জানে কবে বিপ্লবের ডাক পড়ে!