দূরদর্শী ছিলেন বলেই টমাস বাটার আত্মজীবনী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন এবং উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, এই ব্যক্তির মধ্যে যে আগ্রাসী মনোভাব আছে, সেই মনোভাবাপন্ন হওয়া উচিত প্রতিটা বাঙালি তরুণ-তরুণীর। শুধুমাত্র চাকরির খোঁজ না করে নিজের মতো করে কিছু একটা গড়ে তোলার কথা উঠে এসেছিল টমাসের জীবনীতে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবন সংগ্রাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিনিদ্র রাত উপহার দিয়েছিল। বারবার মনে হয়েছিল, টমাস বাটা যদি পারেন, কেন বাংলার যুবসমাজ পারবে না?
১৭৪ পাতার একটি বই। বইয়ের শুরুতে লেখা ‘টমাস বাটার আত্মজীবনী’। জান বাবোস কৃত ইংরেজি হইতে শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandyopadhyay) কর্তৃক অনুলিখিত। বইটির প্রকাশকাল: জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০। মূল্য: চার টাকা। মুদ্রণে জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, ১১৯ ধর্মতলা। ভূমিকা লিখেছেন আচার্য স্যর প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
ইংরেজির ১৯৪৩ সাল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সৃষ্টিকর্মের শিখরে। ততদিনে তিনি শিল্পকর্মের মায়াজাল এমনভাবে বুনে ফেলেছেন যে, অন্তত আগামী একশো বছর তাঁর লেখার প্রতি বাঙালি ঝুঁকে থাকবে। সেই বিভূতিভূষণ, মৃত্যুর ৭ বছর আগে, নিজের মৌলিক লেখার পাশাপাশি এমন একজনের জীবনী অনুবাদ করতে বসলেন, যাঁকে অধিকাংশ বাঙালি চেনেই না!
বাজারে বইটি একদমই চলল না! তাহলে কি তিনি সময় নষ্ট করলেন? সেই সময়ে তিনি আরও একটা কালজয়ী উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন? তবুও এই সাহেবের আত্মজীবনী তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল বড্ড প্রাসঙ্গিক। দূরদর্শী ছিলেন বলেই টমাস বাটার আত্মজীবনী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন এবং উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, এই ব্যক্তির মধ্যে যে আগ্রাসী মনোভাব আছে, সেই মনোভাবাপন্ন হওয়া উচিত প্রতিটা বাঙালি তরুণ–তরুণীর। শুধুমাত্র চাকরির খোঁজ না করে নিজের মতো করে কিছু একটা গড়ে তোলার কথা উঠে এসেছিল টমাসের জীবনীতে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবন সংগ্রাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিনিদ্র রাত উপহার দিয়েছিল। বারবার মনে হয়েছিল, টমাস বাটা যদি পারেন, কেন বাংলার যুবসমাজ পারবে না?
আজকের দিনে ‘বাটা’ নামটা শুধুই একটা জুতোর ব্র্যান্ড নয়, এ এক ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানও। যার মূল সূত্রপাত এক যুবকের হাত ধরে। তিনি টমাস বাটা। চর্মকারের ছেলে থেকে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যতম বড় জুতোর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু এই গল্পটি বাংলায় আলোচিত হয়তো ততটা নয়, যতটা তা হওয়া উচিত।
১৮৭৬ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম টমাস বাটার। মাত্র ১০ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। তাঁর পরিবারের রক্তে ছিল চর্মশিল্প। বাবা, ঠাকুরদা– প্রত্যেকেই ছিলেন দক্ষ চর্মকার। টমাসও মাত্র ছ’বছর বয়স থেকেই চামড়ার কাজ শেখা শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি জুতো তৈরি করতে পারেন দক্ষতায় সঙ্গে। কিন্তু টমাস ছিলেন এক ভিন্ন স্বপ্নে বিশ্বাসী। ছোট দোকানে জুতো বেচার বদলে বড় কিছু করতে চেয়েছিলেন। ১৮ বছর বয়সে দাদা ও দিদিকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ৩২০ ডলার পুঁজি করে খুলে ফেললেন একটি ছোট জুতোর কারখানা। শুরুটা হয়েছিল ১০ জন কর্মীকে নিয়ে। কিন্তু প্রথম বছরেই কোম্পানি দেউলিয়া! তখন যদি অন্য কেউ হতেন, হয়তো এখানেই থেমে যেতেন। কিন্তু টমাস ঠিক তখনই শুরু করলেন আসল লড়াই। চামড়া কেনার পয়সা না থাকায় ভাবলেন, ক্যানভাস কাপড় দিয়ে জুতো বানানো যায় কি না। ফলাফল? পৃথিবীর প্রথম ‘ক্যানভাস কেডস’– সস্তা, টেকসই এবং ঝড়ের গতিতে বিক্রি হয়েছিল।
এই বইটি যখন বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল (মূল বইটি ছিল ‘হাউ আই বিগ্যান’) তখন সারা বিশ্বে যন্ত্র এবং কুটিরশিল্পের যুদ্ধে যন্ত্র জিতছিল। ফলশ্রুতিতে, প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়ছিল। এআই আসার ফলে যেমন বহু লোকের চাকরি গিয়েছে অথবা টেকনোলজি আসার ফলে বহু জায়গায় অটোমেশনের ব্যবহার, বহু মানুষকে বেকার করে তুলেছে। কিন্তু টমাস বাটা আশ্চর্য লোক ছিলেন। তিনি ম্যাজিক জানতেন। আর জানতেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যন্ত্র আর মানুষের মেলবন্ধন কোথায় করতে হবে। তিনি একজন দূরদর্শী শিল্পপতি– যিনি জুতো-শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। তাঁর কারখানায় যখন যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেন, তখন বিতর্ক তৈরি হয়– এতে তো বহু মানুষ চাকরি হারাবে! কিন্তু বাটা এই চিন্তাকে একেবারে ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যন্ত্র মানুষের কাজ কেড়ে নিতে নয়, বরং সহজ করতে এসেছে। বাটা ছাঁটাইয়ের পথ বেছে না নিয়ে কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যাঁরা পুরনো কর্মী– হাতে তৈরি জুতো বানাতেন, তাঁদের শেখানো শুরু হল কীভাবে মেশিন পরিচালনা করতে হয়, কীভাবে নতুন ডিজাইন তৈরি করতে হয়, অথবা কীভাবে গুদামজাতকরণ বা বিক্রয় বিভাগে কাজ করা যায়। যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়লে, চাহিদা ও বাজারও বাড়ে। ফলে বাটা তার কোম্পানির বিক্রয় কেন্দ্র, গুদাম, পরিবহণ ও বিপণন বিভাগে আরও মানুষ নিয়োগ করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, তিনি ‘বাটানগর’ নামক একটি গোটা জনপদ তৈরি করেন, যেখানে কর্মীদের জন্য বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল ও খেলাধুলার মাঠ ছিল। এসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাটা বলতেন, ‘আমরা জুতো তৈরি করি, কিন্তু আগে তৈরি করি মানুষ।’ তিনি শিল্পায়নের ভেতরেই এক মানবিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন। তার কাছে কর্মচারী কেবল উৎপাদনের যন্ত্র ছিল না, বরং ছিল একটি পরিবারের অংশ। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তোলে।
বর্তমান সময়ের কথা বললে, গত দুই বছরে এআই এবং অটোমেশনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪ লক্ষ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ৫৮২ জন এবং প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৪ জন মানুষ কর্মহীন হচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি, গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং, কাস্টমার সার্ভিস ও ডেলিভারি সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে এই প্রভাব আরও স্পষ্ট। রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দুই বছরে ভারতে প্রায় ৩৬,০০০ কর্মী এআই–এর প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন। ২০২১ সালে ব্যাংক অব আমেরিকার এক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে আইটি খাতে প্রায় ৩০ লক্ষ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন। এর মধ্যে ৭ লক্ষ কর্মী শুধু রোবটিক প্রসেস অটোমেশনের কারণেই চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন। যদিও এআই কিছু খাতে চাকরি হ্রাস করছে, তবে এটি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি করছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতে এআই খাতে প্রায় ২৩ লক্ষ নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, ২০২৮ সালের মধ্যে দেশে প্রায় ৩.৩৯ কোটি নতুন চাকরি তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে খুচরো বাজার, উৎপাদন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে। এই তথ্যগুলো আমাদের শেখায় যে, প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে তা কর্মসংস্থান হ্রাস নয় বরং বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
টমাস বাটা কখনওই কেবল ব্যবসায়ী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ভাবুক, উদ্ভাবক। আমেরিকা গিয়ে হাতে–কলমে অ্যাসেম্বলি লাইনের কাজ শিখে এলেন। শিখলেন কীভাবে উৎপাদন বাড়াতে হয়, খরচ কমাতে হয়, কর্মীদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘পথের দৈর্ঘ্য কম হলে, জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ে।’ এই ধারণা থেকেই তিনি নিজ শহরের রাস্তাও পুনর্গঠন করান, যেন মানুষ কম সময় রাস্তায় কাটিয়ে বেশি সময় বাঁচতে পারে। কারখানা থেকে শোরুমে নিয়ে যাওয়ার পথে চুরি যাচ্ছে জুতোর বাক্স! সবাই টমাস সাহেবকে বুদ্ধি দিল সিকিউরিটি গার্ড ভাড়া করার। তিনি বললেন, ‘‘প্রথমে বাঁ পায়ের সব জুতোগুলো পাঠিয়ে দাও, তার দু’দিন পর ডান পায়ের!” জুতো চুরি রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল!
জুতোর দামের ক্ষেত্রেও তিনি অদ্ভুতভাবে ৯ সংখ্যাটা দিয়ে শেষ করতেন, কেননা উনি বুঝেছিলেন ১০০-র জায়গায় ৯৯ লিখলে ক্রেতারা বলবেন– ‘একশো টাকারও কমে পেলাম।’ সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু এখনও চলেছে! ১৯৩২ সালে, সুইজারল্যান্ডে বাটা কোম্পানির নতুন শাখা উদ্বোধনের সময় বিমান দুর্ঘটনায় টমাস বাটা মারা যান। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, সততা, ব্যবসায়িক মেধা ও মানবিক দর্শন আজও বেঁচে আছে বাটা কোম্পানির প্রতি জোড়া জুতোয়। বর্তমানে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে বিস্তৃত এই কোম্পানির হেড অফিসটিও সেই সুইজারল্যান্ডেই।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে রোদ, পানের দোকানের আড্ডা, কিংবা নিঃস্ব গ্রামবাংলার নিঃশব্দ কান্না। তিনি যখন টমাস বাটার আত্মজীবনী পড়লেন, সেটি তাঁর কাছে হয়ে উঠল শুধুমাত্র একজন উদ্যোক্তার গল্প নয়, এক দর্শনের বিবরণ। বিভূতিভূষণ এমন একজন লেখক, যিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ গড়ে ওঠে তার স্বপ্ন, সাধনা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে। টমাস বাটার জীবন যেন সেই তত্ত্বেরই বাস্তব রূপ। তিনি দেখলেন এক নিম্নবিত্ত চর্মকারের সন্তান কীভাবে শুধু শ্রম, উদ্ভাবন আর আদর্শ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান, যেখানে কর্মী মানে কেবল শ্রমিক নয়, বরং একসঙ্গে এগিয়ে চলার সাথী। এই আত্মজীবনী বিভূতিভূষণের মনে এমন গভীর প্রভাব ফেলেছিল যে, তিনি স্বয়ং অনুবাদের কাজে হাত দেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার তরুণ সমাজ, যারা কেরানির চাকরি বা সরকারি দপ্তরে নিয়োগের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা যেন জানে সৃষ্টির আনন্দ কী, আত্মশক্তির মূল্য কতটা। তিনি স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে এই অনুবাদের ভূমিকাও লিখিয়ে আনেন। প্রসঙ্গত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভূমিকা লিখতে গিয়ে প্রথম লাইনেই উল্লেখ করেন, টমাস বাটা পৃথিবীর প্রধান শিল্পপতিগণের মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ পুরুষ’।
বিভূতিভূষণ কখনও সরাসরি বাঙালিকে ব্যবসা করার কথা বলেননি। কিন্তু তাঁর কাজ, বিশেষত টমাস বাটার আত্মজীবনী অনুবাদ, স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়– তিনি চাইতেন বাঙালি শুধু চাকরিপ্রার্থী না হয়ে হোক সৃষ্টিশীল, উদ্যোগী ও আত্মনির্ভর। এই অনুবাদ ছিল তাঁর পক্ষ থেকে এক নিঃশব্দ সামাজিক আহ্বান। তিনি বুঝেছিলেন, আত্মবিশ্বাস, শ্রম এবং নতুন কিছু গড়ার মানসিকতা একজন মানুষের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। টমাস বাটার জীবন আমাদের শেখায়, ব্যবসা মানে শুধু মুনাফা নয়; এটি হতে পারে এক মানবিক কর্মযজ্ঞ যাতে সমাজ উপকৃত হয়, কর্মসংস্থান তৈরি হয় এবং মানুষ স্বপ্ন দেখতে শেখে। বিভূতিভূষণের সাহিত্যেও এই আত্মনির্ভরতার বীজ ছড়িয়ে আছে, কখনও পথের পাঁচালিতে, কখনও আরণ্যকে, আবার কখনও এই অনূদিত জীবনীতে। তাই বলা যায়, তিনি পরোক্ষভাবে হলেও বাঙালিকে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার এবং ব্যবসায়িক মানসিকতা গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved