পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দীর্ঘদিন ধরে লালিত নারীবিদ্বেষ কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। কথায়-আচরণে আমরা প্রায়শই যা প্রকাশ করে ফেলি। যা পরিবর্তনের লড়াই শুরু হয়েছে ঘরে-বাইরে। চলছে মানসিকতায় বদল আনার লক্ষ্যে নানা কাজ। কিন্তু তাতে সময় লাগবে। হাজার হাজার বছরের অভ্যাস কতদিনে পাল্টাবে, তার নির্দিষ্ট সময়সীমা বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই দরকার প্রতিরোধ। মেয়েরা যেমন নানা ভাবে ময়দানে নামছেন, রাষ্ট্রেরও উচিত এই যুদ্ধে শামিল হওয়া।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
এখন সময়টা বড় অস্থির। পারিপার্শ্বিক সমাজ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ। ভাল নেই। আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ-খুন এই পচাগলা সমাজকে আরও নগ্ন, বেআব্রু করে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাই রসাতলে যাওয়ার পথে। যার প্রতিবাদে, ন্যায়-বিচার চেয়ে পথে নেমেছে লাখো জনতা। শামিল হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।
কিন্তু তাতে কি স্বস্তি মিলবে? মানুষের প্রতিবাদের নজর ঘুরিয়ে দিতে কতই না পাঁয়তাড়া। নানা ধরনের বক্তব্য উঠে আসছে সোশাল মিডিয়ায়। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সংকীর্ণ স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাপাদাপি। আসল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নজর। প্রশ্ন উঠছে, তিলোত্তমা বা অভয়া কি আদৌ বিচার পাবেন। আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের এই আবহেই গত ক’দিন ধরে একের পর এক মহিলা-শিশু নির্যাতনের খবর ঠাঁই করে নিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, বিহার, মহারাষ্ট্র, অরুণাচল প্রদেশ– সর্বত্রই।
প্রশাসন, সংবাদমাধ্যমের অগোচরেও এমন বহু ঘটনা রয়েছে। অর্থাৎ, নারীদের উপর এই ধরনের বর্বরোচিত আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্যা ধর্ষকামী ‘মানুষ’। তাদের অবাধ বিচরণ সর্বত্র। আমাদের মা-বোন-মেয়েরা আদৌ কোথায় নিরাপদ, তা এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, সত্যিই কি মহিলাদের নিরাপত্তা রাষ্ট্র তথা সমাজের কাছে অগ্রাধিকার। রাষ্ট্র মেয়েদের কথা আদৌ ভাবে? ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ দাবি করেছে, এই ধরনের ঘটনা রুখতে ২০১৯ সালে ‘দ্য প্রিভেনশন অফ ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ডক্টরস, মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস’ বিল তৈরি হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত তা সংসদে পাশ হয়নি। কেন? কাদের স্বার্থে? শুধু হাসপাতাল, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী কেন, অন্যত্রও মহিলারা সমানভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। তাঁদের সুরক্ষায় রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
কীভাবে পাল্টানো যাবে এই পরিস্থিতি? অনেকেই নানা প্রস্তাব পরামর্শ দিচ্ছেন। ছোট থেকে মেয়েদের ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’ শেখানোর কথা বলছেন। কেউ বলছেন মার্শাল আর্ট শেখানোর কথা। কারও মতে, সঙ্গে ছুরি-কাঁচি-লঙ্কার গুঁড়ো রাখার দরকার। সে সবই তো হল। কিন্তু কেন দিনে হোক বা রাতে, নিজের শহরে, এলাকায় মেয়েদের সন্ত্রস্ত থাকতে হবে, কেন তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, তার সদুত্তর কে দেবে? পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি, ধর্ষণ যে ক্ষমতা দেখানোর অন্যতম হাতিয়ার, সেটা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়। তাই সমাজের নানা চোখরাঙানি, বিধিনিষেধ সব আরোপিত হয় মেয়েদের কেন্দ্র করেই। ছেলেদের ক্ষেত্রে সাত খুন মাফ। ছোট থেকে কেন তাদের শেখানো হবে না যে, মেয়েরা শুধুই ভোগের সামগ্রী নয়। তাদেরও সমমর্যাদায়, সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। অনেক বাবা-মা, পরিবার কেন পুত্র ও কন্যাসন্তানের মধ্যে বৈষম্য বন্ধ করবে না! অন্যের দিকে আঙুল তোলা সহজ। কিন্তু নিজেদের দায় এড়িয়ে শুধু অন্যের কাঁধে বন্দুক রাখলে আখেরে লাভ নেই। সমাজের ঘটমান বিপদ যেকোনও সময় আমাদের দরজাতেও হাজির হতে পারে।
………………………………………………………………….
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমতুল্য নারীবিদ্বেষের গুরুত্ব। সন্ত্রাসবাদ যেমন কোনও দেশ ও জনজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, একই ভাবে সমাজ-সভ্যতাকে নষ্ট করছে নারীবিদ্বেষ। সন্ত্রাস বৃদ্ধি পায় উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, সামাজিক অবক্ষয়, ভ্রান্ত চিন্তার জন্য। ঠিক সেই সমস্ত কারণ কি চরম নারীবিদ্বেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?
………………………………………………………………….
এই পরিস্থিতির মধ্যেই বসন্তের এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতো খবর দিয়েছে ব্রিটেন। গত মাসে ব্রিটেনের পুলিশের তরফে নারীবিদ্বেষ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিষয়টা দ্রুত দমন করা না গেলে জাতীয় বিপর্যয়ের সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কালবিলম্ব না করে তাতে পদক্ষেপ করেছে ব্রিটিশ সরকার। কী করেছে? এবার থেকে চরম নারীবিদ্বেষী কার্যকলাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করলে জঙ্গি-দমন আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে দোষীদের বিরুদ্ধে। নতুন কী কী উপায়ে নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে দেশে, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রসচিব ইয়েভেট কুপার দেশজুড়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস-দমন নিয়ে ইংল্যান্ডে যে সমস্ত আইন রয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। প্রচলিত আইনের ধারাগুলোয় নারীবিদ্বেষকেও যুক্ত করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিবের তরফে। নারীবিদ্বেষী আচরণের খবর পেলেই সেই বিষয়টি নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে জঙ্গিদমন শাখা। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীবিদ্বেষ দেখা গেলে তাদেরও সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী প্রোগ্রামে পাঠাতে শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেওয়ার বিধান থাকছে। আর যেসব শিক্ষার্থীকে এই প্রোগ্রামে পাঠানো হবে, তাদের মধ্যে উগ্রবাদী কোনও লক্ষণ আছে কি না, তা খুঁজে বের করবে স্থানীয় পুলিশ। তাদের লক্ষ্য হবে উগ্রবাদী ভাবনা থেকে এসব শিক্ষার্থীকে সরিয়ে আনা।
সন্ত্রাসবাদ কেন? কারণ, হিংসার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করার হাতিয়ার সন্ত্রাসবাদ। কখনও তা রাজনৈতিক, কখনও বা ধর্মীয় কারণে ব্যবহৃত হয়। আবার জাতিগত ও মতাদর্শগত বিরোধের জায়গা থেকেও কাজে লাগানো হয়। এ কথা অনস্বীকার্য, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দীর্ঘদিন ধরে লালিত নারীবিদ্বেষ কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। কথায়-আচরণে আমরা প্রায়শই যা প্রকাশ করে ফেলি। যা পরিবর্তনের লড়াই শুরু হয়েছে ঘরে-বাইরে। চলছে মানসিকতায় বদল আনার লক্ষ্যে নানা কাজ। কিন্তু তাতে সময় লাগবে। হাজার হাজার বছরের অভ্যাস কতদিনে পাল্টাবে, তার নির্দিষ্ট সময়সীমা বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই দরকার প্রতিরোধ। মেয়েরা যেমন নানা ভাবে ময়দানে নামছেন, রাষ্ট্রেরও উচিত এই যুদ্ধে শামিল হওয়া।
…………………………………………………
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা নেই বইয়ে, জোর দেওয়া শুধু ‘জয় হিন্দ’ সম্ভাষণে
…………………………………………………
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমতুল্য নারীবিদ্বেষের গুরুত্ব। সন্ত্রাসবাদ যেমন কোনও দেশ ও জনজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, একই ভাবে সমাজ-সভ্যতাকে নষ্ট করছে নারীবিদ্বেষ। সন্ত্রাস বৃদ্ধি পায় উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, সামাজিক অবক্ষয়, ভ্রান্ত চিন্তার জন্য। ঠিক সেই সমস্ত কারণ কি চরম নারীবিদ্বেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? ভারতের সংবিধান রচিত হয়েছিল ব্রিটেন, আমেরিকার মতো বিভিন্ন দেশের থেকে সার সংগ্রহ করে। সময় পাল্টেছে। সরকার আইনকে যুগোপযোগী করছে।
ব্রিটেনের এই শিক্ষা কি ভারত গ্রহণ করবে? নাকি নারীদের শিক্ষা, ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, পুরুষের অধীন ভাবা মনুবাদী সংস্কৃতিই মেনে চলবে রাষ্ট্র? প্রতীক্ষায় থাকবে দেশ।
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved