Robbar

শোকগ্রস্তদের ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ সম্বোধন করে শোকে আবদ্ধ রাখাই কি মূল উদ্দেশ্য?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 13, 2025 5:30 pm
  • Updated:June 17, 2025 8:10 pm  
An article on Pahalgam Terror Attack and the widows of the attack

এই মানুষেরা যাঁদের কেউ কেউ তাঁর স্বামীকে হারিয়ে, ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন সেই সময়ে যদি দেশের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে কর্মীরা এই মহিলাদের একই বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে তাঁদের ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ বলে সম্বোধন করেন, তখন তাঁদের কেমন লাগতে পারে? এই সম্বোধন করে তাঁরা কি ওই মহিলাদের আবার বার্তা দিচ্ছেন না যে ওই মহিলারা তাঁদের সামাজিক অবস্থান হারিয়েছেন এবং এখন থেকে সমস্ত চোখ তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখবে। অথচ যাঁরা অজান্তে এই নিদান দিচ্ছেন, তাঁদের কোনও ধারণাই নেই, এই পরিবারের মধ্যে এমন অনেক মহিলা আছেন যাঁদের মাত্র অল্পদিনই বিয়ে হয়েছিল, কেউ হয়তো মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন, আবার কেউ পুরো পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। এই মহিলাদের তো সারা জীবনটাই পড়ে রয়েছে সামনে, তাঁদের যদি সবাইকে ওইভাবে সম্বোধন করা হয়, তাহলে তাঁদের কি বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যায় না?

সুমন সেনগুপ্ত

নাজিম হিকমত লিখেছিলেন ‘জেলখানার চিঠি’। অনুবাদ করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়– ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ পহেলগাঁওয়ের ঘটনার ছয় সপ্তাহের কিছু বেশি সময় অতিক্রান্ত। সেই ২৬টি পরিবার বেঁচে আছে সন্ত্রাসবাদের বন্দুকের সামনে হারিয়ে ফেলা তাঁদের প্রিয় মানুষের স্মৃতিকে সঙ্গী করে। কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই এই শোকের। এইরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভুলতে গেলে কী করণীয়, তাঁরা নিজেরাই জানেন না, কেউ-ই জানে না। ক্ষত কতদিনে, কীভাবে সারবে– কেই-ই বা জানে! ওই পরিবারগুলোকে কোনও সান্তনাই পর্যাপ্ত নয়। সপ্তাহ কেটে গিয়ে মাস আসবে, ধীরে ধীরে ঘুরে যাবে বছর, জীবন আবার নিজের ছন্দে চলা শুরু করবে। জীবনকে ফিরতেই হয়, সাহসে ও প্রতিরোধে।

Indian security officers inspect the site in Pahalgam where militants opened fire on tourists in Pahalgam in Indian-controlled Kashmir, on Wednesday, April 23, 2025.

এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। রাজনৈতিকভাবে শাসকদল এই ঘটনার ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং আগামীদিনেও করবে বোঝাই যাচ্ছে। বিরোধীরা কীভাবে তার মোকাবিলা করে, সেটাও দেখা যাবে। কিন্তু কতজন আমরা খবর রেখেছি ওই পহেলগাঁওতে যাঁরা মারা গেছেন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে, সেই পরিবারের মানুষেরা কেমন আছেন? যে মানুষেরা তাঁদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাঁরা নতুন করে হয়তো বাঁচার চেষ্টা করছেন। ভয়ংকর কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে যদি কোনও মানুষ নিজেকে হঠাৎ আবিষ্কার করেন, যে তিনি বেঁচে আছেন, এই অনুভূতি অনেকটা সেইরকম। এই মানুষেরা যাঁদের কেউ কেউ তাঁর স্বামীকে হারিয়ে, ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন সেই সময়ে যদি দেশের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে কর্মীরা এই মহিলাদের একই বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে তাঁদের ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ বলে সম্বোধন করেন, তখন তাঁদের কেমন লাগতে পারে, এটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এই সম্বোধন করে তাঁরা কি ওই মহিলাদের আবার বার্তা দিচ্ছেন না যে ওই মহিলারা তাঁদের সামাজিক অবস্থান হারিয়েছেন এবং এখন থেকে সমস্ত চোখ তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখবে। তাঁদের চলাফেরা, তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ, তাঁদের খাওয়ার অভ্যেস সমস্ত কিছুই আর তাঁদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলবে না। সমাজ যেভাবে বলবে, সেভাবেই তাঁদের চলতে হবে। এই মহিলাদের তো নিজের পরিচয় ছিল, শুধুই স্বামীর পরিচয়ে তাঁদের পরিচিত করা হচ্ছে। অথচ যাঁরা অজান্তে এই নিদান দিচ্ছেন, তাঁদের কোনও ধারণাই নেই, এই পরিবারের মধ্যে এমন অনেক মহিলা আছেন যাঁদের মাত্র অল্পদিনই বিয়ে হয়েছিল, কেউ হয়তো মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন, আবার কেউ পুরো পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। এই মহিলাদের তো সারা জীবনটাই পড়ে রয়েছে সামনে, তাঁদের যদি সবাইকে একই বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে ওইভাবে সম্বোধন করা হয়, তাহলে তাঁদের কি বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যায় না?

………………………………….

যে মহিলারা শুধুমাত্র গৃহবধূ ছিলেন, যাঁদের কাছে পারিবারিক সম্পর্কই একমাত্র বেঁচে থাকার রসদ, ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারের কর্তৃত্বের জন্য তাঁদের স্বামীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা এখন তাঁদের বাঁচার উদ্দেশ্য এবং সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয় পাবেন। তাঁরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার অভাব এবং উত্তরাধিকার অধিকার নিয়েও সমস্যায় পড়বেন। তাঁদের সন্তানেরা তাদের বাবার আকস্মিক অনুপস্থিতির যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদি এই ধরনের শব্দ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তাদের মায়ের ‘বিধবা’ মর্যাদা তাঁদের সংসারের ওপর কর্তৃত্বকে আরও ছোট করবে।

…………………………………

আমরা নিশ্চিত ভুলে যাইনি হিমাংশী নারওয়ালকে, যাঁর ছবি পহেলগাঁও হত্যার পরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, তাঁকে কীভাবে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছিল, যখন তিনি বলেছিলেন সব কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদী নয়। আমরা ভুলে যাইনি, কীভাবে বিজেপির সাংসদেরা ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অন্যতম একজন মুখ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে অপমান করেছিলেন। আমাদের সমাজে যেখানে বিবাহ একটি সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি, সেখানে যখন কোনও এক বিজেপির সাংসদ, ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ বলে সম্বোধন করেন, তখন তিনি ওই মহিলাদের সাহসী হওয়ার, শোক ভুলে আবারও জীবনযুদ্ধে ফেরার, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুখ হয়ে ওঠার পরামর্শ দেওয়ার বদলে আরও পিছিয়ে দেন। তিনি প্রমাণ করেন, প্রিয় মানুষ হারানো এই মহিলারা আজীবন শোক করে যাবেন, অন্য কোনও পরিচয় তাঁরা পাবেন না, এমনকী পরবর্তীকালে কেউ আবারও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও ‘বিধবা’ সম্বোধন তাঁদের পিছু ছাড়বে না। যখন তিনি বলেন, ওই মহিলারা করজোরে দাঁড়িয়ে না থেকে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মানসিকতা দেখাতেন, তাহলে এত বড় বিপর্যয় ঘটত না– তখন আসলে তিনি সামাজিক জীবনে মহিলাদের লড়াইয়ে ফেরার বদলে, তাঁদের আরও পিছিয়ে দেন। এখন কী হবে? যে মহিলারা শুধুমাত্র গৃহবধূ ছিলেন, যাঁদের কাছে পারিবারিক সম্পর্কই একমাত্র বেঁচে থাকার রসদ, ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারের কর্তৃত্বের জন্য তাঁদের স্বামীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা এখন তাঁদের বাঁচার উদ্দেশ্য এবং সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয় পাবেন। তাঁরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার অভাব এবং উত্তরাধিকার অধিকার নিয়েও সমস্যায় পড়বেন। তাঁদের সন্তানেরা তাদের বাবার আকস্মিক অনুপস্থিতির যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদি এই ধরনের শব্দ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তাদের মায়ের ‘বিধবা’ মর্যাদা তাঁদের সংসারের ওপর কর্তৃত্বকে আরও ছোট করবে। আসলে এদেশের এক অংশের পুরুষরা চায় ওই নারীরা এখনও শোকে মূহ্যমান থাকুক এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীল থাকুক, যা তাদের সিঁদুরহীন মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

BS EDIT: Pahalgam attack: A test for peace, security, and unity

একটি ক্ষুব্ধ জাতি হিসেবে, আমাদের পহেলগাঁওয়ের নির্যাতিতা নারীর সিঁদুর মুছে ফেলার ঘটনা, যা তাঁদের বৈবাহিক জীবনের অবসানের প্রতীক, সেদিকে মনোনিবেশ করার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন আমরা ওঁদের কথামতো সিঁদুর হারিয়ে ফেলাকে একজন মহিলার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেল বলে মেনে নেব? এমনকী আমরা ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম নিয়েও সে সময়ে প্রশ্ন তুলিনি।

আমাদের সামাজিক নিয়মগুলো কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে না পিছিয়েছে, সেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে। একটা সময়ে বিধবা মহিলাদের সহমরণে যাওয়ার নিদান ছিল, মস্তক মুণ্ডনের নিদান ছিল, নিরামিষ খাওয়া, একাদশী পালনের নিদান ছিল, এখন কি তা আছে? একসময়ে কমবয়সি বিধবাদের আশ্রমে রেখে দিয়ে বোঝানো হত, তাঁদের পাপের জন্যেই তাঁদের স্বামীরা মারা গেছেন। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন করেছিলেন এই জায়গা থেকেই। যে দেশ ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ভেবেছে, সেই দেশে কেন ওই ২৬ জন মহিলাকে বারংবার ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ বলে সম্বোধন করা হবে এবং বোঝানো হবে তাঁদের সিথির সিঁদুর মুছে যাওয়ার জন্য তাঁরাই দায়ী, তাঁরা সরাসরি লড়াই করেননি বলেই আজ এই বিপদ হল? তাঁরাই দায়ী তাঁদের বৈধব্যের জন্য, এই ধরনের কথা বললে, তাঁরা ভবিষ্যতের লড়াই করার সাহস পাবেন কেমন করে? যখন ওই ঘটনার পরে তাঁরা ধীরে ধীরে জীবনের ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছেন, তাঁদের মৃত সঙ্গীর ভালোবাসার কথা মনে রেখেই যখন জীবনযুদ্ধে সামিল হচ্ছেন, তাঁরা কখনওই হেরে যাওয়া মহিলা নন। তাঁরাই আসল সাহসী নারী। তাঁরা ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ নন, তাঁরাই আসল ভারতবর্ষের আগামীর ভবিষ্যৎ। আগামীদিনে তাঁরাই তো হয়ে উঠতে পারেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখ।