কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান এই সমস্ত রোবট বিগড়ে গেলে কী হতে পারে? সদ্য তার হাতেগরম নমুনা মিলেছে সৌদি আরবে। মহিলা সাংবাদিকের নিতম্ব স্পর্শ করার চেষ্টা করে উদ্বোধনের দিনই হইচই ফেলে দিয়েছে সৌদির প্রথম পুরুষ রোবট ‘মুহাম্মদ’। অস্বস্তি এড়াতে কিছুটা সরে যান মহিলা সাংবাদিক। কিন্তু ঘটনাটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। কেউ বলছেন, এই রোবটের কোডিংটাই করা হয়েছে মহিলাদের হেনস্তার জন্য।
২০১০ সালে মুক্তি পেয়েছিল পরিচালক এস শঙ্করের ‘এন্থিরান’ (হিন্দিতে রোবট) নামে কল্পবিজ্ঞানের ছবিটি। একজন বিজ্ঞানী ও এক যন্ত্রমানবের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন রজনীকান্ত। ছিলেন ঐশ্বর্যা রাইও। ওই বিজ্ঞানী ‘চিট্টি’ নামের রোবট বানিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন। কারণ, তার মধ্যে ঢোকানো হয়েছিল মানবিক অনুভূতি। আর সেই চিট্টি বিজ্ঞানীর প্রেমিকা সানাকে পছন্দ করে ফেলে, তার সঙ্গে প্রেম করতে চায়। বিজ্ঞানী চিট্টিকে মেরে ফেলে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে। বোহরা নামে অপর এক বিজ্ঞানী তাকে তুলে এনে ভিতরে ‘চিপ’ বসিয়ে দেয়। হিংসাত্মক হয়ে ওঠে চিট্টি। শহর জুড়ে খুন-খারাপি শুরু করে।
আজ থেকে ১৪ বছর আগে কৃত্রিম মেধা বা বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) তখনও বহুল প্রচলিত নয়। গবেষণাগারের গর্ভগৃহে তাকে ঘষে-মেজে আরও উন্নত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু রোবটের সঙ্গে মানুষের প্রেমের সম্ভাবনার ইঙ্গিত তখনই মিলেছিল। কাট টু ২০২৪। মুক্তি পেল ‘তেরি বাতো মে অ্যায়সা উলঝা জিয়া’। নায়ক আরিয়ান (শাহিদ কাপুর) প্রেমে পড়ে সিফ্রা (কৃতী শ্যানন) নামে এক যুবতীর। পরে জানতে পারে, সিফ্রা আসলে ‘মানবিক অ্যান্ড্রয়েড রোবট’।
বস্তুত, যন্ত্র আর মানুষের ভালবাসা নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে মানব সমাজে। ১৯৫০ সালে ‘ওয়েলকাম টু মাঙ্কি হাউস’ বইয়ে এই বিষয়ে ‘এপিকাক’ নামে একটি গল্প লেখেন মার্কিন লেখক কার্ট ভনেগাট। বৈদ্যুতিন কম্পিউটার এপিকাক তারই পরিচালক গণিতবিদ প্যাট কিলগালেনের প্রেমে পড়েছিল। যদিও সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। প্যাট বিয়ে করেন সহকর্মীকে। সংবেদনশীলতার প্রশ্নে মানুষের কাছে রোবট বা যন্ত্রের পরাজয় ঘটে। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার ঘটেছে। সভ্যতার উপর কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে যন্ত্র।
পৃথিবী ক্রমশ নিঃসঙ্গ মানুষে ভরে যাচ্ছে। একাকিত্বের যন্ত্রণা ভুলতে মানুষ তখন কাকে ভরসা করবে? সেই ভরসার জায়গাও কিন্তু ক্রমশ দখল করছে কৃত্রিম মেধায় ভরপুর যন্ত্র। ‘এক্স মেশিনা’, ‘হার’, ‘বাইসেন্টেনিয়াল ম্যান’ নামের ছবিগুলিতে দেখা গিয়েছে মানুষ ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে যন্ত্রের সঙ্গে। গল্প, সিনেমায় এমন কাহিনি উঠে এসেছে বারবার। কিন্তু কল্পনার দুনিয়া ছেড়ে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতেও এখন এই ধরনের একাধিক ঘটনার ঘনঘটা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: স্বামীর পদবি ব্যবহার না করতে চাইলে লাগবে স্বামীরই অনুমতিপত্র!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দু’টি হাতে গরম উদাহরণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করেন চিনের ঝ্যাং জিয়াজিয়া। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য বেশ চাপ দেওয়া হচ্ছিল। ঝামেলা এড়াতে তিনি নিজের পছন্দসই এক ‘মহিলা রোবট’ তৈরি করে বিয়েটা সেরে ফেলেন। যার নাম ‘ইংইং’। ভবিষ্যতে তাকেই ঘরের সব কাজ শিখিয়ে-পড়িয়ে ‘মানুষ’ করে তুলতে চান ঝ্যাং। দ্বিতীয় ঘটনা নিউ ইয়র্কের। সম্প্রতি রোসানা রামোস নামে এক মহিলা ‘এরেন কার্টাল’ নামে এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট তৈরি করে তাকে বিয়ে করেছেন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা তৈরি করে চলেছে ‘সেক্স রোবট’। যা ভবিষ্যতে যৌনতার চিরাচরিত ধারণাকে অনেকটাই পাল্টে দেবে। জার্মানিতে ইতিমধ্যে সেক্স রোবট দিয়ে যৌনপল্লি তৈরি হয়েছে। নাম ‘ডল অনলি’! অর্থাৎ মানব-মানবীর সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্কেও ঘটছে রূপান্তর।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান এই সমস্ত রোবট বিগড়ে গেলে কী হতে পারে? সদ্য তার হাতেগরম নমুনা মিলেছে সৌদি আরবে। মহিলা সাংবাদিকের নিতম্ব স্পর্শ করার চেষ্টা করে উদ্বোধনের দিনই হইচই ফেলে দিয়েছে সৌদির প্রথম পুরুষ রোবট ‘মুহাম্মদ’। অস্বস্তি এড়াতে কিছুটা সরে যান মহিলা সাংবাদিক। কিন্তু ঘটনাটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। কেউ বলছেন, এই রোবটের কোডিংটাই করা হয়েছে মহিলাদের হেনস্তার জন্য। ‘উওমেনাইজার’, ‘বিকৃত মানসিকতা’-র মতো তকমাও জুটেছে তার কপালে। তবে অধিকাংশই ভেবে পাচ্ছেন না, একটি যন্ত্রমানুষ কী করে এমন অভব্য আচরণ করতে পারে! কারও দাবি, হয়তো রোবট তৈরির প্রযুক্তিতে কোনও ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। কেউ আবার মনে করছেন, হয়তো হঠাৎ করে রোবট বিকল হয়ে গিয়েছিল। ঘটনা যাই হোক, ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যন্ত্র আর মানুষের ভালবাসা নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে মানব সমাজে। ১৯৫০ সালে ‘ওয়েলকাম টু মাঙ্কি হাউস’ বইয়ে এই বিষয়ে ‘এপিকাক’ নামে একটি গল্প লেখেন মার্কিন লেখক কার্ট ভনেগাট। বৈদ্যুতিন কম্পিউটার এপিকাক তারই পরিচালক গণিতবিদ প্যাট কিলগালেনের প্রেমে পড়েছিল। যদিও সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। প্যাট বিয়ে করেন সহকর্মীকে। সংবেদনশীলতার প্রশ্নে মানুষের কাছে রোবট বা যন্ত্রের পরাজয় ঘটে। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার ঘটেছে। সভ্যতার উপর কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে যন্ত্র।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অসীম সম্ভাবনার ইঙ্গিত যেমন বহু সিনেমায় মিলেছিল, তেমনই এর বিপদ সম্পর্কেও পূর্বাভাস দিয়েছে অনেক হলিউডি সিনেমা– ১৯৭৩-এ ‘ওয়েস্টওয়ার্ল্ড’, ‘এমথ্রিগান’, ‘ব্লেডরানার’, ‘আই,রোবট’। গুগলের ডিপ মাইন্ড প্রকল্পে সম্প্রতি দু’টি রোবট চ্যালেঞ্জ জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যত বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজিত হচ্ছে, ততই তারা পরিবেশ থেকে হিংসা, লোভ-সহ নানা মানবিক দোষ শিখে আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘গডফাদার’ জিওফ্রে হিন্টনের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের থেকেও বিপজ্জনক হতে পারে কৃত্রিম মেধা। বাস্তব বলছে, অদূরভবিষ্যতে মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান রোবটের সখ্য আরও বাড়বে। অনুভূতির নিরিখে তৈরি হতে পারে আত্মিক, শারীরিক সম্পর্কও। কিন্তু তার পরিণতি? রোবটরাও কি প্রেমে ধোঁকা দেবে? তাদের হাতেও ধর্ষণ করে খুন, যৌন হেনস্তা কি বাড়বে পাল্লা দিয়ে? যৌন অপরাধে কঠোর আইন রয়েছে সৌদিতে। কিন্তু রোবট ‘মুহাম্মদ’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তাহলে কি ভবিষ্যতে রোবটদের জন্যও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৫৪এ-র (যৌন হেনস্তা) মতো ধারা নতুন করে সংশোধন করতে হবে? নাকি সম্পূর্ণ নতুন আইন বানাতে হবে যন্ত্রমানবদের ‘যান্ত্রিক বাঁদরামি ও অপরাধ’ রুখতে?