বাংলাদেশের বাঙালি লেখকরা পশ্চিমবঙ্গে আদৃত হচ্ছিলেন। বইয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠছিল এক শক্তপোক্ত সাহিত্যসংস্কৃতির সেতু। ১৯৯৯-এর কলকাতা বইমেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেই বইমেলা উদ্বোধন করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। ১৯৯৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বইমেলায় বিশেষ বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে দল বেঁধে এসেছেন বাংলাদেশের প্রকাশক, লেখক ও সাধারণ মানুষ। আমরা সানন্দে দেখেছি দুই সংস্কৃতির মিল-মিশ।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার ফলে পূর্ববঙ্গ হল পূর্ব পাকিস্তান। ভৌগোলিক দূরত্ব ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য দু’টি দূরত্বও ছিল। একটি হল ভাষার দূরত্ব, অন্যটি সাংস্কৃতিক দূরত্ব। উর্দু খুবই মিষ্টি ভাষা হলেও এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ভাষা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা বাংলা উচ্চারণে ও প্রকরণে ভিন্ন। শস্যশ্যামলা নদীমাতৃক বাংলা শুষ্ক ও উর্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদম আলাদা। ধর্মভিত্তিক ভারত বিভাজনে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা অগ্রণী ভূমিকায় এবং আর সেই সমগ্র পাকিস্তান পুরোটা ধরলে পাকিস্তানের জনক মুহম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কোনও সম্পর্কই নেই। ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকের ভূমিকা এবং কৌশল সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১– এই ২৪ বছর নানা টানাপোড়েনের মধ্যে টিকে থাকা পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ বরাবরই ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা কখনওই রাষ্ট্রশাসনে প্রাধান্য পায়নি। অবশেষে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া উর্দুকে মেনে নিতে পারেনি বলেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। সৃষ্টি হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ এবং সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ সত্যি কথা বলতে কী, সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য ও সাহসিক সিদ্ধান্ত ছাড়া ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটি হতেই পারত না।
১৯৭১ থেকে ২০২৪– কেটে গিয়েছে ৫২ বছর আর এই ৫২ বছরে ‘বাংলাদেশ’ একটি রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতির দেশ হিসেবে বিশ্বনন্দিত। আর এই বাহান্ন বছর সর্বদাই যে সুখে কেটেছে বাংলাদেশের বাঙালিদের, তেমনটি নয়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান নিহত হয়েছেন, সামরিক শাসন হয়েছে ও অবশেষে নির্বাচনের মাধ্যমে ফিরে এসেছিল গণতন্ত্র। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান এবং অন্য জনজাতি মিলে গড়ে তুলেছিল এক সমবেত সংস্কৃতি। মৌলবাদী মুসলিমদের ধর্মীয় সংঘর্ষ চোরাগোপ্তা চললেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি অগ্রগামী দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে উঠেছিল, এই শতাব্দীর বছরগুলিতে।
সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক নতুন ভাষা সাহিত্য। উঠে আসছিলেন অনেক শক্তিশালী কবি, লেখক, গায়ক। ১৯৪৭-এর বিভাজনের ফলে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের গরিষ্ঠাংশ দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ফলে যে সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধর্মান্ধতা পরিত্যাগ করে এক উদার সাংস্কৃতিকবিশ্ব নির্মাণ করে তুলেছিল। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নবনির্মাণের সূচনা হয়েছিল। প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের বাঙালি লেখকরা পশ্চিমবঙ্গে আদৃত হচ্ছিলেন। বইয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠছিল এক শক্তপোক্ত সাহিত্যসংস্কৃতির সেতু। ১৯৯৯-এর কলকাতা বইমেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেই বইমেলা উদ্বোধন করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। ১৯৯৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বইমেলায় বিশেষ বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে দল বেঁধে এসেছেন বাংলাদেশের প্রকাশক, লেখক ও সাধারণ মানুষ। আমরা সানন্দে দেখেছি দুই সংস্কৃতির মিল-মিশ।
হঠাৎ ঘটে গেল বিনা মেঘে বজ্রপাত! বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রেশ থেকে গিয়েছিল। একদল ধর্মান্ধ মুসলমান হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করা এবং তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করত। এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মুসলিমরা বরাবরই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক মুসলমানরা নানা সময় ক্ষমতা দখলের কারণে শাসকদলের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে। শুধু যে হিন্দুরাই এই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার শিকার তাই নয়। বৌদ্ধ চাকমা এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের অন্য সংখ্যালঘু নাগরিকরা মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হয়েছে এই সব মৌলবাদীদের দ্বারা। কিন্তু সব কিছু সহ্য করেই বাংলাদেশ তাঁদের আপন দেশ বলে, তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন।
…………………………………….
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রেশ থেকে গিয়েছিল। একদল ধর্মান্ধ মুসলমান হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করা এবং তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করত। এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মুসলিমরা বরাবরই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক মুসলমানরা নানা সময় ক্ষমতা দখলের কারণে শাসকদলের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে। শুধু যে হিন্দুরাই এই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার শিকার তাই নয়। বৌদ্ধ চাকমা এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের অন্য সংখ্যালঘু নাগরিকরা মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হয়েছে এই সব মৌলবাদীদের দ্বারা।
…………………………………….
দু’-হাজার সালের প্রথম দিকে আমি একবার ‘রাঙামাটি’ ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি বৌদ্ধদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণের ঘটনা। চাকমারা সেদিনও অভিযোগ করেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলবাদীরা তাঁদের জমিজমা দখল করে নিচ্ছেন এবং জনসংখ্যার অনুপাত বদলে দেওয়ার অসাধু খেলায় নেমেছে কিছু মৌলবাদী মুসলিম। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ফলে এবং বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ভারতে চাইতে ছোট রাষ্ট্র হলেও সেখানে ক্রমশ গড়ে উঠছিল এক শিক্ষিত উদারপন্থী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইউরোপ, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় তাদের দেশের বহু মানুষ শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক নবরূপায়ণের প্রলক্ষণ সূচিত হচ্ছিল।
সাম্রাজ্যবাদীশক্তি চিরকাল মৌলবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং অস্ত্রবিক্রি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক স্বার্থে গরিষ্ঠাংশকে উগ্রপন্থী ও যুদ্ধবাদী করে তোলে। বাইডেন ও মৌলবাদী মুসলমান একযোগে ভারতবিরোধী গরিষ্ঠাংশকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ফলে ইসলামিক মৌলবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রবিরোধী যুদ্ধবাদিত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শিক্ষিত, উদারপন্থী ও প্রগতিশীল মুসলমান মধ্যবিত্ত মানুষও অসহায়। সুতরাং, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিপন্ন। তাই দুই বাংলার সেতু পুস্তক-সংস্কৃতিও বিপন্ন। কিছু করার নেই।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানার জায়গায় আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর ঠিকানা, ১৩ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট লেখা আছে। যদি খুব ভুল না করি তাহলে এই ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ দু-বার মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ সংকলন ও ছাপার ভার ছিল বামাদার ওপর।