Robbar

সম্পাদকদের জঙ্গলে এক ‘এডিটর’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 18, 2025 2:54 pm
  • Updated:December 18, 2025 3:56 pm  

ফিচারের কথাই যদি ধরি। বছর দেড়েক আগে প্রকাশিত তার নির্বাচিত সংকলনের সূচিপত্রটিই চিনিয়ে দেয় এ পত্রিকার অনন্য স্ব-ভাবকে। অশোক রুদ্র, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভো ঠাকুর, রাধারাণী দেবী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়– বাঁধাধরা লেখক-তালিকার বাইরে সে এক বর্ণময় অভিযাত্রা। ১৯৮৩-তে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে এই বিভাগটি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘ফিচার মানেই ফিচলেমি নয়’।

আশিস পাঠক

উড়াল দিলেন অধুনা ‘গৃহ-স্থ’ সেই এডিটর। শেষবারের মতো। ‘বাঙালি এডিটর’ নামে বিলুপ্তপ্রায় যে-প্রজাতিটি, কমে গেল তার একজন সদস্য।

‘প্রতিক্ষণ’-এর স্বপ্না দেব (১৯৪১-২০২৫) ছিলেন এডিটর, নিছক সম্পাদক নন। অভিধান বলবে এডিটর-ই তো সম্পাদক। তা বলুক, বিশ্বের পত্রিকা-ইতিহাস জানে সকল এডিটরই সম্পাদক, কিন্তু সকল সম্পাদক এডিটর নন। সম্পাদক দিনগত পাপক্ষয়ের মতো তাঁর দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক পত্রটি চালিয়ে যাওয়ার কর্মটি সম্পাদন করেন মাত্র, এডিটর তাকে প্রতিটি সংখ্যায় সামনে আনেন, অগ্রবর্তী করেন।

প্রতিক্ষণ-সম্পাদক স্বপ্না দেব

ইংরেজি ‘editor’ শব্দের যে-ল্যাটিন উৎস ‘edere’, তার মানে ‘টু ব্রিং আউট’ বা ‘টু পুট ফোর্থ’। সামনে আনা। কী সামনে আনা? কী থেকে সামনে আনা। জঙ্গল থেকে অরণ্যকে সামনে আনা। কুম্ভকার যেমন একতাল মাটি থেকে সামনে আনেন বিশেষ রূপকে, হীরককার যেমন আনকাট হিরে থেকে অজস্র বিচ্ছুরণময় হীরককে, এডিটরও শব্দ আর চিত্রের জঙ্গল থেকে সামনে আনেন একটি স্মরণীয় প্রকাশকে।

স্মরণীয় হয়ে আছে স্বপ্না দেব-সম্পাদিত প্রতিক্ষণ-ও। কারণ একটি মলাট-কাহিনি আর দু’ মলাটে কয়েকটি লেখার পিনবদ্ধ চেহারাই যে পত্রিকা নয়, সেটা প্রথম থেকেই মনে রেখেছিলেন তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা। নতুন দৃষ্টিকোণ, বিশিষ্ট ভাবনা ছিল প্রতিক্ষণ-এর প্রতিটি সংখ্যার নেপথ্যে, প্রতিটি বিভাগের পরিকল্পনার নেপথ্যেও।

ফিচারের কথাই যদি ধরি। বছর দেড়েক আগে প্রকাশিত তার নির্বাচিত সংকলনের সূচিপত্রটিই চিনিয়ে দেয় এ পত্রিকার অনন্য স্ব-ভাবকে। অশোক রুদ্র, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভো ঠাকুর, রাধারাণী দেবী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়– বাঁধাধরা লেখক-তালিকার বাইরে সে এক বর্ণময় অভিযাত্রা। ১৯৮৩-তে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে এই বিভাগটি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘ফিচার মানেই ফিচলেমি নয়’।

নয় যে, তা বারবার প্রমাণ করেছে এ পত্রিকা। কিন্তু তার অভীষ্ট প্রবীণের পরম পক্বতা ছিল না। মাঝ-সত্তরের উত্তাল দিনগুলির কিছু পরে এ পত্রিকার জন্ম। বাঙালি সংস্কৃতির স্থিতধী সাজানো বয়ানটি তখন আর কমিউনিকেট করতে পারছে না পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে। বিলীয়মান আর উদীয়মান– এই দুই সময়কেই সমান মমতায় জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে প্রতিক্ষণ। প্রথম বর্ষের ১৯-তম সংখ্যায়, ২ মে ১৯৮৪, প্রকাশিত হচ্ছে বিশেষ ফিচার ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় সেখানে লিখছেন, “যতদিন যাচ্ছে, যুবক-যুবতীরা নীতি আদর্শ ব্যক্তিত্ব রুচি সব হারাচ্ছি। চাকুরি নেই বা বাপের পয়সা আছে এই অজুহাতে হীনমন্যতা কাটানোর চেষ্টায় বুকের লকেটে কখনো সাঁইবাবা, কখনো ক্রস, কখনো মা-কালী ঝোলে। গেঞ্জি বা জামার পেছনে ‘Follow Me’, তরলপদার্থের চেয়ে ট্যাবলেট সস্তা, পছন্দ তাই। সুন্দরী বিনম্র মেয়েদের আর গুডবয়দের প্যাঁচ দিই আমরা, রবীন্দ্র সদনে শান্তিদেব বা ইণ্ডোরে রবিশঙ্কর যেমন শুনি তেমনি বচ্চনের নাচ দেখতেও যাই। আমাদের প্রিয় খাদ্য চাইনিজ। বাংলা ছবি? ফুঃ। অথচ আস্তে আস্তে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছি। পাতালরেল কলকাতার বুকে যে ডানা লাগাতে ইচ্ছুক আমরা তার পালক, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যে সব গুরুজনেরা পাতলা ‘আদ্দি’ ঘামে লেপ্টে সংস্কৃতি করেন, আমরা তাঁদের ধুতির কাছা খুলতে চাই। রাজনীতি? হ্যাঁ পাড়ার দাদার কাছে নাম লেখানো আছে, তবে লাইন বিশাল বড়।”

বাংলা ভাষায় সর্বভারতীয় পাক্ষিকটির উদয়কালের ওই সংখ্যাটিকেই যদি নমুনা হিসেবে ধরি তবে দেখব তার ‘প্রধান রচনা’র বিষয় স্মাগলিং: জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আর আন্ত্রিক রোগের মহামারী। ‘গোলটেবিল’-এর বিষয় নাটকে ও চলচ্চিত্রে হিংস্রতা। নাটক সমালোচনার বিষয় হাবিব তনবীর। ধারাবাহিক-এ সলিল চৌধুরীর আত্মজীবনী, সুভো ঠাকুরের আর্ট কালেকশনের অষ্টপ্রহর। পঁচিশে বৈশাখকে মনে রেখে ক্রোড়পত্রে জীবনানন্দ দাশের রবীন্দ্রনাথ যেমন আছে, তেমনই একটি নিবন্ধের বিষয় রবীন্দ্র সংগীতের শিক্ষকেরা। বিভাগের শিরোনামও লক্ষ করার মতো। চিরাচরিত প্রচ্ছদকাহিনি নয়, প্রধান রচনা। কেবল পাঠক টানাই তো এ পত্রিকার উদ্দেশ্য নয়, পাঠককে ভাবানোও তার একটা দায়িত্ব। তাই সুখপাঠ্য কাহিনিতে মুখ ঢেকে থাকা নয়, বরং, সম্পাদক স্বপ্না দেব লিখছেন, ‘গার্ডেনরিচ হাঙ্গামার নেপথ্য সত্য উদ্‌ঘাটনের সময় এই কথাটাই আমরা বারবার বলার চেষ্টা করেছি যে, গার্ডেনরিচে মেহতা-আলী হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সামগ্রিক এক অবস্থা-ব্যবস্থারই অংশ গার্ডেনরিচ। গোয়েন্দা গল্পের মেজাজে একটি সুখপাঠ্য কাহিনী পাঠকদের উপহার দেবার বদলে, আমরা তাই চেষ্টা করেছি, যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থার পটভূমিতে এবং পৃষ্ঠপোষণায় গার্ডেনরিচের উদ্ভব, পুষ্টি এবং বৃদ্ধি-তারই একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে।’

পঁচিশে বৈশাখকে মনে রেখে ক্রোড়পত্র

কী সামনে আনতে চান এডিটর– সে বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিকোণটা যে এমন আলাদা হল, তার একটা কারণ অবশ্যই এই যে, সেই এডিটর একজন সাহসী সাংবাদিকও। উত্তাল পাঞ্জাব বা বীভৎস ভোপালে তাঁর অকুণ্ঠ গতায়াত। খবর খুঁজেছেন তিনি, কেবল খবরের জন্য নয়, মানুষের জন্য। তাই যখন সাংবাদিক এবং এডিটর অবসরের গৃহ-স্থ জীবনযাপন করেন তখনও সেই খবর খোঁড়ার দিনলিপি সংকলিত করতে গিয়ে লেখেন, ‘সাংবাদিকের প্রতিবেদন, বেশির ভাগই তাৎক্ষণিক। আমি বলি, মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা সারাইয়ের মতো। একটা বর্ষার ধকল সয় না। কিন্তু আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর পর মনে হচ্ছে, সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি তো। ভূপালের সেই দুঃস্বপ্ন পঁচিশ বছর পার হয়ে আবার আমার দিন-রাত্রিকে দুঃসহ করে তুলেছে। সেই একই রকম ক্রোধ, ক্ষোভ।’

সাংবাদিকতার পারিভাষিক ‘প্রতিবেদন’ শব্দটার সঙ্গেই যে সমব্যথী হওয়ার অন্তত চেষ্টাটা আছে সেটা ক্রমেই লুপ্তপ্রায় সাম্প্রতিক সাংবাদিকতায়। সেটাই হয়তো প্রফেশনালিজম। হয়তো নয়। অফলাইন বা অনলাইন– দুই মুদ্রণই এখন অনেক সহজসাধ্য। সাংবাদিকতার পরিমাণ তাই বেড়েই চলেছে ক্রমশ। তার উপর নানাবিধ সমাজমাধ্যম প্রতিযোগিতা আর চ্যালেঞ্জটা বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। চটজলদি সেই জোগানের আবর্তে বেড়ে উঠছে জঙ্গল, হারিয়ে যাচ্ছে অরণ্য।

সম্পাদকের সংখ্যা তাই কেবলই বাড়তে থাকে। মুছে যেতে থাকেন আদিম মহাদ্রুমের মতো এডিটররা, অ-শেষ স্মৃতি রেখে।