বাঘ বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য গঠিত বহু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী কমিটিতে বাল্মীক থাপার অনেক দিন যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সরকার পরিচালিত কমিটিগুলিতে থাকলেও তাঁর যে গুণটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে বরাবর, তা হল, লেখায় বা বক্তব্যে কখনও সরকারী সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলে চুপ করে তিনি থাকেননি। মুখ বুজে ‘ইয়েসম্যান’ হয়ে থাকা তাঁর চরিত্রে ছিল না। নিজের বিশ্বাসে অটুট থেকেছেন চিরকাল এবং সে বিশ্বাসের কথা ভয়ডরহীন ভাবে বলে গেছেন নিরন্তর।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা। দিল্লি থেকে ট্রেন ধরে রণথম্বোরে এসে নামল এক যুবক। কাঁধে তার ক্যামেরা, মনে অদম্য কৌতূহল অজানাকে জানার, বিশেষত বন্যপ্রাণকে কাছ থেকে দেখার। সমাজবিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ বনেদি বাড়ির ছেলে। বাবা-মা প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত সাংবাদিক। দিল্লিতে বসে গতানুগতিক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত নিশ্চিন্তেই। কিন্তু কেউ কেউ ছক ভেঙে হাঁটেন বলেই তাঁদের অনুসরণ করে হাজারো চোখ। কেউ বাঘের মতোই অকুতোভয় থাকেন বলেই মৃত্যু তাঁদের নামের পাশে লিখে দেয় অমরত্বের স্বাক্ষর।
২৪ বছরের সেই যুবকের স্বপ্নের পথ চলা শুরু হয়েছিল ভারতীয় বনের আরেক পুরোধা-পুরুষের হাত ধরে। তিনি ফতেহ সিং রাঠোর (১৯৩৮-২০১১)। ফতেহ তখন রণথম্বোরের রেঞ্জার। অভিজ্ঞ ‘গুরু’-র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এক লহমায় চিনে নিয়েছিল এই ব্যতিক্রমী তরুণকে। ভারতীয় ঐতিহ্যের চিরন্তন পরম্পরায় গুরু-শিষ্যের পথ চলা ভারতকে উপহার দিল দেশের অন্যতম সেরা পরিবেশ সংরক্ষণবিদ, বন্যপ্রাণপ্রেমী বাল্মীক থাপারকে (১৯৫২-২০২৫)।
বাল্মীক তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন ভারতীয় বন্যপ্রাণকে রক্ষার কাজে। বিশেষত, আজকের ভারতে বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ভারতের বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সদ্য ৫০ বছর পেরনো ‘ব্যাঘ্র প্রকল্প’ বা ‘প্রজেক্ট টাইগার’-এর সাফল্যের কথা বহুল প্রচারিত। এই ৫০ বছরের সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যেসব মানুষের ব্যক্তিগত মরণপণ উদ্যোগের কথা মনে রাখতেই হবে, তাঁদের মধ্যে প্রথমসারিতে থাকবেন বাল্মীক থাপার।
বাঘ বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য গঠিত বহু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কমিটিতে তিনি বহুদিন যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সরকার পরিচালিত কমিটিগুলিতে থাকলেও তাঁর যে গুণটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে বরাবর, তা হল, লেখায় বা বক্তব্যে কখনও সরকারি সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলে চুপ করে তিনি থাকেননি। মুখ বুজে ‘ইয়েসম্যান’ হয়ে থাকা তাঁর চরিত্রে ছিল না। নিজের বিশ্বাসে অটুট থেকেছেন চিরকাল এবং সে বিশ্বাসের কথা ভয়ডরহীনভাবে বলে গিয়েছেন নিরন্তর। লাইন দিয়ে দাঁড়ানো জিপসি-ভর্তি মানুষের হাজার ক্যামেরার সাটারের শব্দকে উপেক্ষা করে যেমন রাজকীয় ভঙ্গীতে হেঁটে যায় ভারতীয় বাঘ, তেমনই ভ্রুক্ষেপহীন ছিল বাল্মীক থাপারের কণ্ঠস্বর, লেখা।
……………………………..
তাঁর লেখা ৩০-এর বেশি বইয়ের মধ্যে ‘টাইগার ফায়ার: ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ার্স অব দ্য টাইগার ইন ইন্ডিয়া’ আমার মতে ভারতীয় বন্যপ্রাণ নিয়ে যাঁদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ আছে তাঁদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য বই। শুধুমাত্র বাঘ সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা নয়, ভারতীয় বাঘের ইতিহাস, বাঘের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নানা দিক, এককথায় বাঘ নিয়ে তাঁর ভাবনার বিচিত্র ক্ষেত্র উজাড় করে দিয়েছেন এই বইতে। তাঁর আত্মজীবনী ‘টাইগার: মাই লাইফ, রণথম্বোর অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নিশ্চিতভাবেই তাঁর এই জঙ্গলময় রূপকথার জীবনের আর এক অনন্য দলিল।
……………………………..
আফ্রিকা থেকে চিতা বা অন্য বন্যপ্রাণীকে এনে ভারতের জঙ্গলে তাদের বেড়ে ওঠার জায়গা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য শুনে চমকে উঠেছিলাম। গুর্জরদের কয়েকজনকে যদি মাসাইমারাতে ছেড়ে আসা হয় তাঁদের খাওয়ার বা থাকার ব্যবস্থা করলেই তাঁরা সুস্থ জীবন কাটাতে পারবেন তো? কিংবা যদি উল্টোটা হয়, বেশ কয়েকজন মাসাইকে এনে যদি বাধ্য করা হয় রাজস্থানের মরুভূমিতে থাকতে, তাহলে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করলেই সে প্রয়াস সফল হবে তো? আগামী দিনে কুনোর জাতীয় উদ্যানে চিতারা কেমনভাবে বেঁচে থাকবে, তাতে আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশের কেমন পরিবর্তন হবে– তার উত্তর এখনও মেলেনি, কিন্তু বাল্মীক তাঁর বিশ্বাসের কথা, তাঁর ভাবনার কথা বলতে ভয় পাননি। প্রতিপক্ষ সেখানে যতই ক্ষমতাশালী হোন না কেন!
বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও তাঁর মতামত ছিল স্পষ্ট। প্রথমদিন থেকেই তিনি বলে এসেছেন যতদিন না সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উৎসাহী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা যাবে, ততদিন এ কাজ সম্পূর্ণ হবে না। বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা এবং আমলাদের অতিরিক্ত দাদাগিরি-র বিপক্ষে তিনি বরাবর সোচ্চার থেকেছেন। প্রজেক্ট টাইগারের সাফল্য উদযাপনের মধ্যেও তিনি সর্বভারতীয় মিডিয়াকে প্রকাশ্যে বলেছেন আমলাদের ‘ট্যাপ ট্যাপ ট্যাপ’ এবং রাজনৈতিক নেতাদের ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ ভারতের বনসংক্ষণকে পুরোপুরি সফল করে তোলার প্রধান অন্তরায়।
ভারতের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা তাঁর বিরক্তির কারণ ছিল। ব্যাঘ্র প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত কোনও অর্থ প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে এসে পৌঁছতে মোট ৩৬ জন অফিসারের টেবিল পেরিয়ে আসতে হয় এবং তার জন্য ন্যূনতম ছয় মাস সময় লাগে– একথা বাল্মীক নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি– ‘ভারতীয় আমলাতন্ত্র বুলেটের চেয়ে বেশি বাঘ হত্যা করেছে’। তাই শুধুমাত্র হাওয়া ভাসিয়ে দেওয়া কথার কথা নয়। রীতিমতো যুক্তি দিয়ে সে তথ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর লেখায়।
প্রজেক্ট টাইগারের ৫০ বছরে ৩০০০ পেরিয়েছে ভারতীয় বাঘের সংখ্যা। বাল্মীক তাঁর লেখায় এবং বক্তব্যে বারবার বলেছেন ভারতে সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারলে ৫০০০ বাঘ সুষ্ঠুভাবে থাকতে পারবে। বাঘ-মানুষ সংঘাত এড়ানোর ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যক্তিগত স্পষ্ট মতামত ছিল। ভারতীয় বাঘ বাল্মীকের স্বপ্ন দেখা ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছাতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে আগামীর ভারত।
চিনের বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করার এবং সেজন্য বাঘ ‘চাষ’ করার উদ্যোগের তিনি তীব্র সমালোচক ছিলেন। আমাদের দেশে বাঘ-বনের আশপাশে বেড়ে ওঠা জনসংখ্যা তাঁকে চিন্তিত রাখত সর্বক্ষণ। এত বড় দেশে বন্যপ্রাণের স্বাভাবিক বিচরণের জন্য কিছু নিরুপদ্রব জায়গা নির্দিষ্ট থাকবে, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। পর্যটনকে কখনও সংরক্ষণের বিরোধী বলে মনে করেননি। নিয়ম মেনে পর্যটন বরং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে অর্থবহ ভূমিকা নিতে পারে, একথাই বলে গেছেন বরাবর।
অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বইতে তাঁর ভাবনার কথা লিখে রেখে গেলেন বাল্মীক। তাঁর লেখা ৩০-এর বেশি বইয়ের মধ্যে ‘টাইগার ফায়ার: ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ার্স অব দ্য টাইগার ইন ইন্ডিয়া’ আমার মতে ভারতীয় বন্যপ্রাণ নিয়ে যাঁদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ আছে তাঁদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য বই। শুধুমাত্র বাঘ সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা নয়, ভারতীয় বাঘের ইতিহাস, বাঘের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নানা দিক, এককথায় বাঘ নিয়ে তাঁর ভাবনার বিচিত্র ক্ষেত্র উজাড় করে দিয়েছেন এই বইতে। তাঁর আত্মজীবনী ‘টাইগার: মাই লাইফ, রণথম্বোর অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নিশ্চিতভাবেই তাঁর এই জঙ্গলময় রূপকথার জীবনের আর এক অনন্য দলিল।
১৯৯৭ সাল, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি, টিভিতে ‘ল্যান্ড অফ দ্য টাইগার’ দেখে চমকে গেলাম। সে আজকের মোবাইলের যুগ নয়, হাতে হাতে উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত ক্যামেরা বা ফোনের যুগও নয়। হাতের মুঠোয় তখন পশুপাখির পলক ফেলার ‘রিল’ দেখা যেত না। ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে কী মমতায় ধরেছিলেন বন্যপ্রাণের চলাফেরা! বাঘিনীর শিকার ধরে এনে তার বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে– এদৃশ্য আজকের মতো সহজলভ্য ছিল না তখন। রাতের অন্ধকার বা ভোরের আলোয় ভারতীয় বন্যপ্রাণের যে বৈচিত্রকে তিনি এই তথ্যচিত্রে ধরেছিলেন, তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। ওই তথ্যচিত্রেই প্রথম স্পষ্টভাবে দেখেছিলাম, বাঘকে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে ঘুম পাড়িয়ে রেডিও কলার পরানোর দৃশ্য। বাঘকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া ভারতীয় সংস্কৃতির নানা খণ্ড দৃশ্য আলোড়িত করেছিল তাঁর চিন্তাচেতনাকে।
চেতনাকে জাগিয়ে তোলাই তো একজন সংরক্ষণবিদের প্রধানতম কাজ। আজীবন অক্লান্তভাবে সেই চেষ্টাই করে গেছেন বাল্মীক। ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাঁর মৃত্যুতে প্রকাশ্যে শোকপ্রকাশ করেনি দেখে অবাক হইনি। তবে একথা নিশ্চিত জানি, ভারতের নানা প্রান্তে আজ অবধি টিকে থাকা প্রতিটি বন্যপ্রাণ তাঁর মৃত্যুর খবরে দু’-ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে। আর সেই অদৃশ্য ভালোবাসার জলবিন্দুই বল্মীক থাপারের পরম পাওয়া।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
বাস্তবকে তো শুধুমাত্র আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। পরমাণু এবং তার সংশ্লিষ্ট কণাদের গতিবিধি অনুমান করা বড় সহজ কাজ নয়। লীলা মজুমদার আর প্রফেসর নারলিকারের কল্পনার সমান্তরাল পৃথিবীরা বুঝি-বা এক বাঁকে এসে মেশে, যেখানে কল্পনা এসে বিজ্ঞানের হাত ধরে। জন্ম নেয় কল্পবিজ্ঞান।